জুয়ান সেবাস্তিয়ান ভেরন
শেষ আপডেট: 17th March 2025 17:19
দ্য ওয়াল ব্যুরো: পুরো নাম এর্নেস্তো রাফায়েল গেভারা দে লা সের্না। কখনও ‘চে গেভারা’—কখনও-বা আরও সংক্ষেপে ‘চে’ নামে তাঁকে গোটা দুনিয়া চেনে। পুঁজিবাদের বিরোধী, সমাজতান্ত্রিক মতাদর্শের প্রতীক। মুক্তমনা। সমস্ত সংকীর্ণতার ঊর্ধ্বে উঠে মানুষকে মানুষের সম্মান দিতে ও সেই সম্মান প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছেন। আজীবন। ছিলেন ডাক্তার। ভালবাসতেন কবিতা লিখতে, গান শুনতে। একইসঙ্গে ক্রীড়ামোদী, বিশেষ করে ফুটবল-অন্ত-প্রাণ।
হবেন না-ই বা কেন! জন্ম ও বেড়ে ওঠা আর্জেন্টিনায়। রক্তে লাতিন আমেরিকার সংস্কৃতির ধারা বহমান। যেখানে দোলা তোলে ফুটবলের ছন্দ, গ্যালারিজুড়ে বয়ে চলা টানটান উত্তেজনা। তীব্র শ্বাসকষ্ট আজন্মকাল। তবু চিকিৎসকদের নিদান উপেক্ষা করে নেমে পড়তেন মাঠে। খেলতেন গোলরক্ষক হিসেবে৷
সেই সূত্রেই আর্জেন্টিনার ফুটবলের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ঢুকে পড়েছিলেন চে। ছোঁয়াচ থেকে বাদ যাননি মারাদোনাও। শুধু ‘মার্কিন-বিরোধী’ বললেই যথেষ্ট বলা হয় না, স্বঘোষিতভাবে ‘সর্বশক্তি দিয়ে মার্কিন-বিদ্বেষী’ বলে যিনি নিজের পরিচয় দিতেন।
২০০০ সাল নাগাদ ফিদেল কাস্ত্রোর সঙ্গে গড়ে ওঠে নিবিড় সখ্য, যখন মাদকাসক্তি থেকে নিস্তার পেতে কিউবার শরণাপন্ন হন কিংবদন্তি ফুটবলার। আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন কাস্ত্রো স্বয়ং৷ ‘দেশে সত্যি ডাক্তার জুটল না?’—প্রশ্নের জবাবে কিউবার প্রেসিডেন্টকে মারাদোনা বলেছিলেন: ব্যাপারটা তেমন নয়৷ আসলে যদি কোনওভাবে চিকিৎসায় ভুলচুকের কারণে মৃত্যু হয় তাঁর, সেই যন্ত্রণা আর অনুতাপ সহ্য করা অসম্ভব জেনে আর্জেন্টিনার সমস্ত ক্লিনিক নাকি আগেভাগে হাত তুলে নিয়েছিল। চিকিৎসকরা অন্যত্র যেতে বলেছিলেন। সাফ জানিয়েছিলেন—দেশের কেউই তাঁর আসক্তি নিয়ে কাটাছেঁড়া করবে না!
কাস্ত্রো তো এলেন পরে। মারাদোনা কিন্তু তার অনেক আগে থেকেই বামপন্থী এবং অতি অবশ্যই চে গেভারার অনুরাগী। নিছক কমিউনিজম নয়, সমাজ-সংসারে ‘ন্যায়ের ধারণা’ও তাঁর মনে গড়ে উঠেছে চে-র লেখা বই পড়ে। সার্বিয়ার চলচ্চিত্র নির্মাতা এমির কুস্তুরিকাকে দেওয়া একটি সাক্ষাৎকারে একথা জানিয়েছিলেন মারাদোনা। সেই কারণে কখনও মিছিলে গাভেরার প্ল্যাকার্ড নিয়ে, কখনও-বা চুরুট মুখে চে-র ছবি আঁকা উল্কি হাতে সর্বসমক্ষে এসেছেন তিনি।
শুধু ফুটবল নয়, দেশের সামগ্রিক সংস্কৃতির আইকন মারাদোনা। চে গাভেরাকে নিয়ে তাঁর উচ্ছ্বাস পরের প্রজন্মের ফুটবলারদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়বে, এটাই স্বাভাবিক। আর বাস্তবিক হয়েওছিল তাই। মারাদোনার সূত্রে চে এবং বামপন্থার প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিলেন একদল উঠতি খেলোয়াড়৷ তাঁদেরই একজন ভেরন। জুয়ান সেবাস্তিয়ান ভেরন। খেলেছেন ইন্টার মিলান, ম্যাঞ্চেস্টার ইউনাইটেডের মতো ক্লাবে। ১৯৯৬ সাল থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত জাতীয় দলের জার্সি গায়ে মাঠে নেমেছেন। বিশ্বকাপে দেশের প্রতিনিধিত্ব করেছেন। মিডফিল্ডার, প্লেমেকার। অ্যাটাকিং মিডফিল্ড থেকে সেন্ট্রাল মিডফিল্ড—মাঝমাঠে বিভিন্ন ভূমিকায় সমান স্বচ্ছন্দ। সেট পিস নেওয়ার ক্ষেত্রেও সুবিদিত তিনি।
আটানব্বইয়ের বিশ্বকাপে দুর্দান্ত পারফরম্যান্সের সুবাদে ইউরোপের নজরে আসেন ভেরন। ১৫ মিলিয়নের চুক্তিতে ইতালির ক্লাব পার্মায় সই করেন। পরের বছর জেতেন কোপা ইতালিয়া ও উয়েফা কাপ। এক মরশুমে জোড়া ট্রফি। তা সত্ত্বেও পার্মা ছাড়েন ভেরন৷ যোগ দেন লাজিও-য়। আর এখানেই শুরু হয় এক তিক্ত ও বিতর্কিত অধ্যায়।
‘মুসোলিনি’, ‘হিটলার’, ‘অক্ষশক্তি’, ‘বিশ্বযুদ্ধ’—নামগুলো যতই ধূসর হয়ে যাক না কেন, প্রভাব যেন কিছুতেই মোছে না৷ মুসোলিনির জমানা অস্ত গিয়েছে। কিন্তু ফ্যাসিবাদ কি ঘুচেছে? স্বৈরতন্ত্র কি পুরোপুরি বিলীন? শাসকের চেহারায় অন্য রূপে অন্য রঙে হাজির হয় স্বৈরাচারের নব নব সংজ্ঞা। জনমানসেও তার ছাপ রয়েছে। মতাদর্শ অজর, শাশ্বত। আর তার অনুগমন আর আনুগত্যের বাসনা সমাজের শিরায়-উপশিরায় নিত্য বহমান।
লাজিও সমর্থকদের একটা অংশ এর বড় প্রমাণ৷ অকাট্য প্রমাণ৷ ফুটবল সমাজে সেই অংশের পরিচিতি ‘লাজিও আল্ট্রাস’ হিসেবে। দক্ষিণপন্থী, বর্ণবিদ্বেষী, জাতিবিদ্বষী এবং অতি অবশ্যই প্রতিক্রিয়াশীল। বামপন্থার তীব্র বিরোধী। কোনও লুকোছাপা নয়৷ ঠারেঠোরে বুঝিয়ে দেওয়া নয়। প্রকাশ্যে ফেস্টুন, টিফো-র মাধ্যমে নিজেদের বিদ্বেষ জাহির করত তারা৷ ব্যানারে ‘স্বস্তিক’ এবং বিবিধ ফ্যাসিস্ট প্রতীকের ছাপ মেরে রাখত। খেলা চলাকালীন সদলবলে ঠোকা হত কুখ্যাত, বিতর্কিত ‘রোমান স্যালুট’। যদিও সবচেয়ে নিন্দনীয় কাণ্ডটি ঘটেছিল ১৯৯৮ সালে।
ইতিহাস বলছে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ইহুদিদের হত্যার জন্য নাৎসিরা এক্সটারমিনেশন ক্যাম্প (নির্মূল শিবির) বানিয়েছিল৷ তার মধ্যে সবচেয়ে বড় হত্যাকেন্দ্রটি তৈরি হয় পোল্যান্ডে৷ নাম অশউইৎজ কনসেনট্রেশান ক্যাম্প। দশ লাখেরও বেশি মানুষ সেখানে মারা যান। আর এই জায়গা ও ঘটনার অনুষঙ্গ টেনে লাজিও সমর্থকেরা ১৯৯৮ সালে একটি ব্যানার টাঙায়, যেখানে গোটা গোটা অক্ষরে লেখা ছিল: ‘অশউইৎজ তোমাদের দেশ, ওভেন তোমাদের ঘর’। ইতালির ফুটবল ফেডারেশন এই ঘটনার তীব্র নিন্দা করেই ক্ষান্ত থাকেনি, বিষবৃক্ষ সমূলে উপড়ে ফেলতে পরপর বেশ কয়েক সপ্তাহ ধরে ম্যাচ শুরুর আগে ‘আনা ফ্রাঙ্কের ডায়েরি'র শুরুর কিছু ছত্র রেকর্ড করে জোরে জোরে শোনানোর নির্দেশ পর্যন্ত দেয়।
এমন পরিস্থিতিতে লাজিওতে যোগ দেন ভেরন। যিনি ঘোষিতভাবে বামপন্থী এবং চে গেভারার অনুগামী। শুধু তাই নয়৷ চে-র মস্ত একটা উল্কি ডানদিকের বাহুতে খোদাই করে রেখেছিলেন তিনি৷ প্রথম দিকে বিষয়টি নজরে না এলেও ধীরে ধীরে সমর্থকরা সবকিছু জানতে পারেন। আর জানামাত্র জারি হয় ফতোয়া। নির্দেশ ছিল খুব স্পষ্ট: হয় ট্যাটুটা মুছে ফেলার ব্যবস্থা করো, নয়তো ঢেকে রাখার দায়িত্ব নাও৷ শুধু ম্যাচ চলাকালীন নয়, ট্রেনিং গ্রাউন্ডেও। এক সেকেন্ডের জন্যও যাতে চে গেভারার উল্কি দুনিয়ার নজরে না আসে!
অন্য কোনও খেলোয়াড় হলে হয়তো মাঠে পর্যন্ত নামতে দিত না আল্ট্রা-বাহিনী। কিন্তু যেহেতু ফুটবলারের নাম ভেরন, যিনি গত মরশুমেই দু'খানা ঘরোয়া টুর্নামেন্ট পার্মার হয়ে জিতেছেন, এ মরশুমে যোগ দিয়েছেন তাদের ক্লাবে, তাই স্রেফ ট্রফি-জয়ের গন্ধে ভেরনের ফতোয়া কিঞ্চিৎ ঢিলেঢালা রাখা হয়েছিল।
এই পরিস্থিতিতে ভেরন পড়লেন মুশকিলে। ততদিনে দলবদলের সময়সীমা পেরিয়ে গিয়েছে। চাইলেও অন্য ক্লাবে যোগ দিতে পারবেন না। ফ্রি এজেন্ট হিসেবে একটা আস্ত মরশুম নষ্ট করাটাও বুদ্ধিমানের কাজ নয়৷ তাই উপায় না দেখেই সমর্থকদের নির্দেশ মেনে নেন তিনি। যদিও এই ডামাডোলের সামান্যতম ছাপ তাঁর ফুটবলে পড়তে দেননি ভেরন। ম্যাচের পর ম্যাচ যায়৷ একটার পর একটা দুর্দান্ত পারফরম্যান্স উপহার দেন আর্জেন্টিনার বামপন্থী ফুটবলার। হয়ে ওঠেন দলের মিডফিল্ড মায়েস্ত্রো। অনেকটা তাঁর সুবাদেই ওই মরশুমের সিরি আ খেতাব ঘরে তোলে লাজিও। মিলান, জুভেন্তাসের মৌরসীপাট্টায় রোমান ক্লাবটি আচমকা থাবা বসায়।
ট্রফি সেলিব্রেশন শেষ৷ মরশুমও খতম৷ ভেরন ভেবে চলেছেন কী করবেন—লাজিওতে থাকবেন? ইতালির অন্য কোনও ক্লাবে সই করবেন? নাকি ইংল্যান্ডে পাড়ি দেবেন? বড় বড় ক্লাব ততদিনে টেবিলে অফার রেখেছে।
এমন একটি দিনে ট্রেনিং সেরে বেরিয়ে আসছিলেন ভেরন। তাঁর মুখোমুখি এসে দাঁড়ায় একদল আল্ট্রা সভ্য-সমর্থক। এরপর কী হল সেটা না হয় কথোপকথনের মেজাজে বলা যাক:
সমর্থকরা জিজ্ঞেস করলেন, ‘তোমার গায়ে কি এখনও সেই ট্যাটুটা আছে?’
সভয়ে, কিছুটা অস্বস্তি নিয়ে খানিক ভাবলেন ভেরন৷ তারপর সত্যিটা বলেই ফেললেন, ‘আছে।’
কিছুক্ষণ নিস্তব্ধতা।
এবার পাল্টা প্রশ্ন ছুড়ে দিলেন ভেরন, ‘সবকিছু চুকেবুকে গেছে। তোমাদের নির্দেশ মেনেও নিয়েছি। এখন এসব আবার জিজ্ঞেস করছ কেন?’
‘আমরা ওটা দেখতে চাই।’—ভণিতা ছাড়াই ভেসে এল জবাব।
সাহস বুকে নিয়েই গায়ের জামা খুলে ফেললেন ভেরন। ডান বাহুতে তখনও জ্বলজ্বল করছে চে গেভারার উল্কি। ততদিনে যেন আরও উজ্জ্বল, আরও দীপ্যমান।
কয়েক সেকেন্ড, মাত্র কয়েক সেকেন্ডেরই বিরতি। তারপর ‘চড়াও হওয়া’ সমর্থক, জাতিবিদ্বেষী, বর্ণবিদ্বেষী যারা, ঘোষিতভাবে ফ্যাসিজম-পন্থী যারা, আর্জেন্টিনার দাপুটে মিডফিল্ডারকে বাকস্তব্ধ রেখে তারা একে একে সেই ট্যাটুতে চুমু দিতে থাকে। আর কিচ্ছুটি বলে না কেউ৷ সবশেষে বিদায় নেওয়ার আগে একজন শুধু কানে কানে শুনিয়ে যায়: ‘ভেরন, তোমায় আমরা ক্ষমা করে দিয়েছি।’
লাজিওর স্টেডিয়ামের বাইরে, যেখানে উড়েছে নাৎসিবাদের পতাকা, উঠেছে অ্যান্টি-সেমিটিক স্লোগান, সেখানে দাঁড়িয়ে ফ্যাসিবাদকেও একদিন নত হতে হয়েছিল চে গেভারার কাছে… ফুটবলের কাছে৷