জয়ের পরে উচ্ছ্বাস 'লা রোজা' শিবিরে।
শেষ আপডেট: 10 July 2024 03:13
সৌরদীপ চট্টোপাধ্যায়
এরকম একটা সেমিফাইনাল দেখার জন্যই তো রাত জাগা যায়!
স্রেফ ষোলো বছর! স্রেফ ষোলো বছরের এক কিশোরের কাছে হারতে হল ফরাসি বাহিনীকে! লামিন ইয়ামাল! ওয়ান্ডারকিড! ইউরোর ইতিহাসে সবচেয়ে অল্পবয়সীর গোল। নতুন করে লেখা হবে রেকর্ড বইতে!
২০০৮ সালে স্পেন যখন ইউরো চ্যাম্পিয়ন হয়, লামিন ইয়ামাল তখন সদ্য এক বছরের শিশু! জন্ম ২০০৭ সালে। বাবা মরোক্কো থেকে আগত অভিবাসী, মা নিরক্ষীয় গিনির। সামনের শনিবার ১৭ বছরে পা দেবেন ইয়ামাল। এত অল্প বয়সে আজ অবধি কেউ ইউরোতে গোল করেনি। বস্তুত, ইউরোয় খেলেইনি। ইয়ামাল সর্বকনিষ্ঠ। অথচ বার্সেলোনার হয়ে সিনিয়র দলে এই মরসুমে ৩৭ ম্যাচ খেলা হয়ে গিয়েছে ইয়ামালের। এটাই প্রথম।
শুরুতে অবশ্য এরকম ফুটবল আশা করা যায়নি। টুর্নামেন্ট জুড়ে যাচ্ছেতাই খারাপ খেলেছে ফ্রান্স। কার্যত একটাও গোল না করে সেমিফাইনালে উঠেছে ‘লা ব্লুজ!’ দিদিয়ের দেশোঁ অতএব সেমিফাইনালে কোনও বাড়তি ঝুঁকিতে যাননি। আঁতোয়া গ্রিজম্যানকে বসিয়ে উসমান দেম্বেলেকে শুরু থেকে নামিয়েছেন। পর্তুগালের বিরুদ্ধে দেশোঁ এমবাপেকে একটু পিছন থেকে খেলিয়েছিলেন। অনেকে ভেবেছিল, আজ অলিভিয়ের জিহুর কপাল খুলতে পারে। কিন্তু শেষ অবধি স্প্যানিশ আর্মাডার বিরুদ্ধে ওই রাস্তায় আর যাননি দেশোঁ। জানতেন, স্পেনকে মাঝমাঠে চেপে দ্রুতগতিতে প্রতি-আক্রমণে উঠতে হবে৷ ফলে সরাসরি ৪-৩-৩ ছক সাজিয়েছিলেন। ডানদিকে মাঝমাঠে কন্তের থেকে সরাসরি গতি বাড়িয়ে প্রেস করবেন দেম্বেলে, সেন্টার ফরোয়ার্ডে কোলো মুয়ানি, বাঁ দিক থেকে এমবাপে।
দেশোঁর ভাবনা পরিষ্কার। তিনি জানতেন, বল দখলের লড়াইতে মাঝমাঠে হয়ত ফ্রান্স লড়ে যেতে পারবে। রাবিয়ো, চৌয়ামেনি, কান্তে আছেন। ওদিকে স্পেনের পেদ্রি নেই। রদ্রি আর ফাবিয়ানের সামনে দানি ওলমোকে নামিয়ে ৪-২-৩-১ ছক সাজিয়েছিলেন লুই দে লা ফুয়েন্তে। সামনে একা মোরাতা, ডানদিকে লামিন ইয়ামাল। এই অবস্থায় স্পেন আক্রমণেই জোর দেবে। বিশেষ করে এতদিন দেশোঁ যেটা বলে কলার-টলার তুলছিলেন, ফ্রান্স একটাও মাঠে গোল খায়নি… ফুয়েন্তে শুরু থেকেই রক্ষণের ওই বাস্তিলে ফাটল ধরাতে চাইবেন। ফলে পাল্টা আক্রমণের টুকরো সুযোগের দিকে শ্যেনদৃষ্টি রাখতে হবে এমবাপেদের!
দেশোঁর এই ছক কিন্তু দুর্দান্তভাবে কাজে দিল। ফ্রান্স মাঝমাঠে চাপ বাড়াবে বুঝেই সটান আক্রমণে ঝাঁঝ বাড়িয়েছিলেন ফুয়েন্তে। লামিন ইয়ামালকে ডানদিকটা ছেড়ে দিয়ে বাঁয়ে ফাবিয়ান রুইজ আর উইংসে নিকো উইলিয়ামসকে দিয়ে ফরাসি রক্ষণ এলোমেলো করতে চেয়েছিলেন। ফল হল উল্টো। কড়া চ্যালেঞ্জ করে বল পেতেই বিদ্যুৎ গতিতে প্রতি আক্রমণ তুলল ফ্রান্স। স্পেনীয় রক্ষণ এটা আশাই করেনি। মাত্র ৯ মিনিটের মধ্যেই আয়মেরিক লাপোর্টে ও কুকুরেলাকে টপকে হেডে বল জালে ঢোকান কোলো মুয়ানি। ইউরোয় এবারের ফ্রান্সের প্রথম মাঠের গোল!
এত দ্রুত কাউন্টারে গোল হবে, ভাবতেই পারেননি ফুয়েন্তে। বলাবলি হচ্ছিল, এটাই দেশোঁর মোক্ষম চাল! এরপর আরও একটা দিয়ে দিলেই মানসিকভাবে ভেঙে যাবে স্পেন। ফ্রান্স যেমন একটাও গোল করেনি, তেমন গোল খায়ওনি এতদিন। কিন্তু ‘লা রোজা’-রা অন্য ধাতুতে গড়া। মাত্র ২১ মিনিটের মধ্যেই জবাব দিলেন বিস্ময় বালক লামিন ইয়ামাল। বয়স মাত্র ১৬! এমনই অবস্থা যে, রাত ন’টার পরে ইউরোর ম্যাচে লামালকে নামালে কোচের চিন্তা থাকছে, এতে জার্মানির শিশুশ্রম আইনে তাঁকে পড়তে হবে কিনা! প্রায় ২৫ গজ দূর থেকে ধনুকের মত বাঁক খাওয়ানো শট নিলেন, অন্তত এবারের ইউরোয় দ্বিতীয় এরকম গোল হয়েছে কিনা সন্দেহ। শুরুতে ফরাসি কিপার মাইগনান বুঝতেই পারেননি। বল ক্রসবারে লেগে ঢুকে আসে!
২৫ মিনিটে ফের ঝলক। সেই লামিন ইয়ামাল। কিন্তু এবারে পেদ্রির বিকল্প হিসেবে নামা দানি ওলমো। পায়ের খেলায় দু’জনে নাস্তানাবুদ করে সোজা শট নিলেন। হয়ত গোলে ঢুকত না। কিন্তু ক্লিয়ার করতে গিয়ে কৌন্দে বল ঢুকিয়ে দিলেন নিজেদের জালে।
আত্মঘাতী গোল কি? ভাবা হচ্ছিল! শেষে উয়েফা জানায়, গোলটা দেওয়া হল ওলমোকে। অর্থাৎ, একই ম্যাচে ফ্রান্স এবারের ইউরোতে প্রথম গোল করল, প্রথম (জোড়া) গোল খেল!
৫৭ মিনিটে ফুয়েন্তে জেসুস নাভাসকে তুলে নিতে বাধ্য হন। নামেন ভিভিয়ান। ততক্ষণে বাঁ দিকের দখল নিয়ে নিয়েছে স্পেন। কুকুরেল্লা উঠে যাচ্ছেন ওপরে। সটান জুড়ে দিচ্ছেন নিকো উইলিয়ামস। কার্যত আক্রমণের সবটাই হচ্ছে বাঁ দিকে। ডাইনে স্রেফ ইয়ামাল। একা ইয়ামালেই আজ শত বসন্তের পলাশ যেন খেলা করল মিউনিখের মাঠ জুড়ে। ৮১ মিনিটের মাথায় আবার একটা ধনুক শট নিয়েছিলেন ইয়ামাল। শেষ অবধি বাইরে দিয়ে যায়।
সামান্য সুযোগ পেলেই স্পেনের ডান উইংসের ফাঁকা থাকার সুযোগ নিয়ে বাঁ দিক ধরে পাল্টা আক্রমণে উঠেছে ফ্রান্স। স্পেন অতএব আর বেশি পাসের খেলায় যায়নি। দ্বিতীয়ার্ধে খেলা যত গড়িয়েছে, বল ধরে রাখতে চেয়েছে বেশি। দর্শকরা যদিও প্রথমার্ধের ঝলকের পরে দ্বিতীয়ার্ধে আরও গোলের আশায় ছিল। কিন্তু সময় যত গড়িয়েছে, তত সতর্ক হয়েছেন ফুয়েন্তে।
এই বিপদ আন্দাজ করে ৬২ মিনিটেই দেশোঁ পাল্টা চাল চেলেছিলেন। তুলে নিয়েছিলেন এনগোলো কন্তে, রাবিয়োঁ, কোলো মুয়ানিকে। নামলেন কামাভিঙ্গার সঙ্গে আঁতোয়া গ্রিজমান। তাতেও লাভ হল না। গ্রিজমানের ফর্ম খরা অব্যাহত। উল্টে কন্তেকে তুলে নিতেই আরও বেশি জায়গা পেয়ে যান রদ্রিরা। শেষ অবধি ২-১ গোলেই সেমিফাইনালে চলে গেল স্পেন।