তুরস্কের বিরুদ্ধে বল দখলের লড়াইতে পেপে। ডর্টমুন্ডে। (ছবিঃ এএফপি/গেটি ইমেজেস)
শেষ আপডেট: 24th June 2024 18:08
কেপলার লাভেরান দে ফেরেইরা লিমা। পাসপোর্টে তাঁর নামটা এই এত্ত বড়। কেউ চেনে? তাঁর নিজের দেশেই এত বড় নাম বললে খুব একটা কেউ চিনবেন না। তাঁর নিজের দেশে অবশ্য এত বড় নামকে ছোট করে নেওয়ারও চল নেই। আবার আছেও। যে দেশের হয়ে তিনি খেলেন, সেদেশে তিনি জন্মাননি। আবার জন্মেছেন যে দেশে, সেখানে ফুটবলটা মানুষের অস্তিত্ব, সত্তা, স্বপ্নে মিশে থাকে। সেদেশে ভাল নামকে ছোট করে নেওয়াই দস্তুর।
ব্রাজিল। ফুটবলের তর্কাতীত তীর্থক্ষেত্র। সেদেশে এডসন আরান্তেস দো নাসিমেন্তোকে লোকে জানে 'পেলে' বলে, আর্থার আনতোনেস কোয়েম্ব্রাকে বিশ্বখ্যাত নাম 'জিকো', রিকার্ডো আইজ্যাকসন দস স্যান্তোসকে ফুটবলদুনিয়া জানে 'কাকা' নামে। তাঁর নামটাও ফুটবলদুনিয়ায় অন্য। ওই নামেই তিনি বিখ্যাত। 'পেপে'।
পর্তুগাল দলে পেপের পাশে খেলেন ব্রুনো ফেরনান্দেজ, বার্নার্দো সিলভা। কিন্তু যে যাই হোক, সবাই ক্রিশ্চিয়ানো রোনাল্ডো নামক মধ্যগগনে গনগন করা সূর্যের আলোয় খানিক আড়ালে। রোনাল্ডোর বয়স ৩৯। ম্যাঞ্চেস্টার, মাদ্রিদের সেই ক্ষিপ্রতা আর নেই। চমৎকার কিছু পাস বাড়াতে পারেন, কিন্তু পায়ের জালে তাঁকে আটকে দেওয়ার স্ট্র্যাটেজি নিয়েই নামে সব দল। তবু রোনাল্ডো যেখানেই যাবেন, আছড়ে পড়ে ভক্তের ঢল। ডর্টমুন্ডে তুরস্ক-পর্তুগাল ম্যাচের মাঝেও রীতিমত পাঁচজন ভক্তদের নিয়ে হিমশিম খেতে হল নিরাপত্তারক্ষীদের। সবাই স্বপ্নের হিরোর সঙ্গে একটা সেলফি তুলতে চায়। অথচ ম্যাচে কার্যত সারা মাঠ জুড়ে দাপিয়ে বেড়ালেন পেপে। তাঁর জন্য কোনও নিরাপত্তারক্ষীকে বিশেষ ব্যস্ত হ'তে হয় না। ম্যাচের পরে পর্তুগাল কোচ রবের্তো মার্তিনেজ ঠারেঠোরে স্বীকার করে নিলেন, 'আপনি যদি নিরপেক্ষ ফুটবল-ভক্ত হ'ন এবং পেপেকে খেলতে দেখেন, তাহলে বলে না দিলে আপনি বিশ্বাসই করবেন না, পেপের বয়স ৪১ বছর!'
ব্রাজিলের একেবারে পুবে, অতলান্তিকের ধারে মাসেইও শহরে জন্ম পেপের। বিখ্যাত জ্যোতির্বিজ্ঞানী জোহানেস কেপলারের নামের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বাবা নাম রাখেন কেপলার। ডাক নাম ছিল পেপিনহো। সেই থেকেই ছোট করে পেপে। মাসেইওর একটি ক্লাবে ফুটবল খেলতেন পেপে। সেখান থেকেই আঠারো বছর বয়সে পর্তুগালের মাদেইরা দ্বীপের মারিতিমো ক্লাবে খেলার জন্য পর্তুগালে চলে আসতে হয় তাঁকে। আজ ক্রিশ্চিয়ানো রোনাল্ডোর জন্মস্থান হিসেবে যে দ্বীপপুঞ্জকে চেনে সারা দুনিয়া। আজও মাদেইরার বিমানবন্দরের নাম 'ক্রিশ্চিয়ানো রোনাল্ডো আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর'। পেপে নিজেই বলেছেন, 'ক্রিশ্চিয়ানো যেদিন অবসর নেবে, আমিও সেইদিন খেলা ছাড়ব। যদ্দিন ও থাকবে, ওকে সাহায্য করার জন্য আমি আছি।'
৪১ বছর বয়সে এবারের ইউরোতে খেলছেন পেপে। তিনিই এবারের সবচেয়ে বয়োজ্যেষ্ঠ ফুটবলার। শুধু তাই নয়। ইউরোয় যতগুলো দেশ খেলছে, তার অন্তত এক তৃতীয়াংশ দেশের বয়সও পেপের চেয়ে কম!
পেপে কোথায় আলাদা? সোজা রাস্তায় এই প্রশ্নের উত্তর পাওয়া কঠিন। পরিশ্রম? প্রতিভা? স্নায়ু? ধুরন্ধর ফুটবল মস্তিষ্ক? কোচ মার্তিনেজ কিন্তু একটা চমৎকার ব্যাখ্যা দিয়েছেন। তুরস্ককে ৩-০ গোলে হারিয়ে উঠে সাংবাদিক বৈঠকে তিনি বলেছেন, 'পেপে চব্বিশ ঘন্টাই পেশাদার। আমরা কিছু খেলোয়াড়কে জানি, যারা হয়ত দু'-তিনঘন্টা প্রস্তুতি নেয়। বাকিটা সে নিজের মত কাটায়। অথচ পেপে এটা ভাবে যে, ও কতক্ষণে বিশ্রাম পাবে, শরীর কতক্ষণে আবার কাজ করবে, কতক্ষণ ঘুমোবে। ওর একটাই লক্ষ্য। আরও একটা বছর খেলা, তারপর আরও একটা। ও ফুটবলের জন্যই বাঁচে। ওই চব্বিশ ঘন্টার প্রস্তুতিই পেপেকে আলাদা করে দেয়।'
অভিজ্ঞরা বলাবলি করছেন, সম্ভবত সবচেয়ে বেশি বয়সে ইউরো খেলার রেকর্ডটা তাঁর ঝুলিতেই যেতে চলেছে। এরপরেও মনে হয় না পেপের চেয়ে বেশি বয়সী কাউকে এত শীর্ষমানের প্রতিযোগিতায় দেখা যাবে। তুরস্কের বিরুদ্ধে মাঠ জুড়ে খেললেন, একাই তুর্কিনাচন নাচা তুর্কি ফুটবলারদের সামনে বাধা হয়ে দাঁড়ালেন, দুর্দান্ত কিছু পাস বাড়ালেন। ওইদিন দেশের হয়ে ১৩৮ ম্যাচ খেলে ফেললেন পেপে। অথচ এককালে তাঁকে বারবার শুনতে হত, তিনি তো ঠিক খাঁটি পর্তুগিজ নন! ২০১৪ সালের বিশ্বকাপে জার্মানির কাছে চার গোল খেয়ে হারের পর যেটা নিয়ে স্বয়ং হোসে মোরিনহো অবধি খোঁচা দিতে ছাড়েননি। বলেছিলেন, 'আমার মনে হয় পেপে যে আদৌ পর্তুগিজ নয়, ওতেই ওর ওপর চাপ বেড়ে যায়। ওকে একটা নির্দিষ্ট ধাঁচে গড়েপিটে নিতে চেষ্টা চলে। যেটা ও করে না।'
দ্য স্পেশ্যাল ওয়ানের মতিগতি বোঝা দুষ্কর! এমন কিন্তু বলার কারণ নেই। অনেকগুলো মজার দিক আছে। যেমন, ব্রাজিল এককালে ছিল পর্তুগিজদের উপনিবেশ। আজও ব্রাজিলের সরকারি ও জাতীয় ভাষা পর্তুগিজ। বস্তুত,পর্তুগালের চাইতেও পর্তুগিজভাষী লোক বেশি আছে ব্রাজিলে। পেপেই যে প্রথম ব্রাজিলীয় যিনি পর্তুগালে খেলেন, এমনও নয়। এর আগে বিশ্ববিখ্যাত পর্তুগিজ মিডফিল্ডার ডেকোও ছিলেন আদতে ব্রাজিলীয়। ২০০১ সালে মাদেইরার ক্লাবে যোগ দিয়ে পর্তুগালে ক্লাব ফুটবলে হাতেখড়ি পেপের। কিন্তু তাঁর প্রতিভা চেনাতে দেরি হয়নি। ২০০৪ সালেই তাঁকে সই করায় পর্তুগালের অন্যতম নামী ক্লাব পোর্তো। তখন পোর্তোর সোনালি সময় চলছে। কোচ তরুণ হোসে মোরিনহো। ২০০৪ সালের চ্যাম্পিয়ন্স লিগ ফাইনালে মোনাকোকে ৩-০ গোলে হারিয়ে সেবার ইউরোপ সেরার শিরোপা জিতে নিয়েছিল পোর্তো।
এখন আর ব্রাজিল-পর্তুগাল দ্বৈরথে পড়তে হয় না পেপেকে। বলা হয়ে থাকে, এই প্রজন্মের অন্যতম সেরা ডিফেন্ডার পেপে। মাঠে অত্যন্ত আগ্রাসী ফুটবল খেলেন তিনি। রিয়াল মাদ্রিদের হয়ে ২২৯ ম্যাচ খেলে ফেলেছেন পেপে। ২০১৯ সালে ফের ফিরেছেন নিজের পুরনো ক্লাব পোর্তোয়। ৪০ পার করে খেলেছেন চ্যাম্পিয়ন্স লিগে। যা একটা রেকর্ড। অথচ অবসর তাঁর ভাবনায় নেই। মাঠে তিনি যতটা আগ্রাসী, মাঠের বাইরে তিনি ততটাই বিনয়ী। যখন প্রথম ব্রাজিল থেকে লিসবন বিমানবন্দরে এসে নামেন, ভরসা ছিল সামান্য কিছু টাকা। আজকের দিনে যেটা মাত্র পাঁচ ইউরোর সমতুল। আসার পথে খুব খিদে পেয়েছিল ছোট্ট পেপের। ভেবেছিলেন, স্যান্ডউইচ খাবেন। কিন্তু লিসবনে নেমে দেশে মা-কে ফোন করতে গিয়েই খরচ করে ফেলেছেন টাকা। একটি স্যান্ডউইচের দোকানে গিয়ে পেপে বলেন, তাঁর কাছে টাকা নেই, কিন্তু খিদে পেয়েছে খুব। কাউন্টারে থাকা মেয়েটি সহৃদয় হয়ে একটা স্যান্ডউইচ বিনাপয়সায় দিয়েছিলেন। ওই ঘটনা আজও ভোলেননি পেপে। অনেকটা রোনাল্ডোর মতোই। যিনি আজও মনে রেখেছেন, তাঁর লড়াইয়ের দিনগুলোর কথা। সামান্য একটু বার্গারের জন্য রোনাল্ডোও রাতের অন্ধকারে যেতেন ম্যাকডোনাল্ডসের একটি দোকানে। কাউন্টারে থাকা মেয়েটি তাঁকে পড়ে থাকা বার্গার দিয়ে দিত বিনামূল্যে।
২০০৭ সালে প্রথম পর্তুগালের নাগরিকত্ব পান পেপে। ব্রাজিল দল থেকে কখনও তাঁকে ডাকেনি। ব্রাজিলে যদিও তখন তারার মেলা। পেপের বাবা অবশ্য বলেছেন, ২০০৬ সালে তৎকালীন ব্রাজিল কোচ দুঙ্গা পেপের জন্য আগ্রহী ছিলেন। কিন্তু শেষ অবধি পর্তুগাল জাতীয় দলেই ডাক পান পেপে। তখন পর্তুগালের কোচ অপর এক বিশ্বজয়ী ব্রাজিলীয়, লুই ফেলিপে স্কোলারি। দলে রয়েছেন লুই ফিগো, রুই কোস্তা, রিকার্ডো কার্ভালহো, নুনো গোমেজ। রয়েছেন তরুণ ক্রিশ্চিয়ানো রোনাল্ডো। তখনও পেপেকে দলে নেওয়া নিয়ে বিতর্ক হয়েছিল। পর্তুগালের আমজনতা চায়নি। অথচ আজ দুই দশক পরে, পেপে তাঁদের নয়নের মণি। রোনাল্ডোর অভ্রভেদী জনপ্রিয়তার গনগনে আঁচের সঙ্গে পাল্লা দিয়েই সারা মাঠ জুড়ে নিজেকে প্রমাণ করে চলেছেন পেপে।
যদিও, নিজের শিকড় কিন্তু আজও অস্বীকার করেন না পেপে। ২০২১ সালের এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ব্রাজিলীয়রা জীবনকে বেশি উপভোগ করে, পর্তুগিজরা কাজকে। আমরা... আমরা তো পরিযায়ী, আমরা শুধু একটু ভাল জীবনযাত্রাই খুঁজি!'