আজ অবধি কোনও ইংরেজ ম্যানেজার দলকে দেশের বাইরে কোনও বড় টুর্নামেন্টের ফাইনালে তুলতে পারেননি। গ্যারেথ সাউথগেটই একমাত্র!
শেষ আপডেট: 12th July 2024 14:30
স্রেফ একটা রাত। স্রেফ একটা রাতের নব্বই মিনিটেই রাতারাতি পাল্টে গিয়েছেন গ্যারেথ সাউথগেট।
ভুল লিখলাম। গ্যারেথ সাউথগেট কি পাল্টেছেন? ইংল্যান্ড ম্যানেজার যেমন ডর্টমুন্ডে নেদারল্যান্ডসকে হারানোর পরে সাংবাদিক সম্মেলনে বললেন, 'আমাদের সবারই একটু ভালবাসা পেতে ইচ্ছে করে, তাই না?' অন্যদিন প্রশ্নের ঝড় বয়ে যায়। সেদিন যেন ঝড় থেমে রোদ উঠেছে। 'যখন তুমি দেশের জন্য কিছু করো, তুমি নিজেকে একজন গর্বিত ইংরেজ মনে করো, তারপর দেশের খবরের চ্যানেলের দিকে তাকিয়ে দেখো, শুধুই সমালোচনা চলছে, এগুলো খুব কঠিন। তাই এরকম একটা রাত অন্তত ভক্তদের জন্য উপহার দেওয়াটা আমাদের কাছে অনেক', বললেন সাউথগেট।
ইংরেজ সাংবাদিকরা আপাতত খানিক রণে ভঙ্গ দিয়েছেন। ব্রিটিশ মিডিয়ায় লেখালেখি চলছে, আরে, এবার তো মুদ্রার উল্টোদিকটা দ্যাখো। এমনিতে সাউথগেটের ভাবমূর্তি খারাপ নয়। কখনও ভক্তদের সঙ্গে ঝামেলায় জড়াননি। খুব একটা বিতর্কে দেখা যায় না। ইউরোতে শুরু থেকে তাঁর দলের খেলা দেখে মিডিয়া ইংল্যান্ডকে ফালাফালা করে ফেললেও কখনোই মেজাজ হারাননি সাউথগেট। বরং বিয়ারের কাপ-টাপ উড়ে আসায় দুঃখ পেয়েছেন, জানিয়েছেন। কিন্তু তার চেয়েও বড় কথা, ম্যানেজার হিসেবে গ্যারেথ সাউথগেট যা করে দেখিয়েছেন, মোটামুটি আধুনিক ব্রিটিশ ফুটবলের ইতিহাসে যা কার্যত নজিরবিহীন!
একটুও বাড়িয়ে বলা নয় কিন্তু!
ফুটবল খেলাটার উৎপত্তি ব্রিটেনে কিনা, সেই নিয়ে খানিক তর্ক চলে। তারপরেও ঐতিহাসিকরা মোটামুটি একমত, আধুনিক ফুটবলের আজকের রূপের পিছনে অনেকটাই দায়ী ইংলিশ চ্যানেলের ওপারে লম্বাটে দ্বীপ। পৃথিবীর প্রাচীনতম ফুটবল ক্লাব ধরা হয় ইংল্যান্ডের শেফিল্ড এফসিকে। শোনা যায়, ভারতে যখন মহাবিদ্রোহের আগুন একটু থিতু হয়েছে, সেই ১৮৫৭ সালের অক্টোবরে প্রথম তৈরি হয়েছিল শেফিল্ড। আজও পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি ফুটবল ক্লাব রয়েছে সম্ভবত ইংল্যান্ডেই। পৃথিবীর প্রাচীনতম ফুটবল লিগও খেলা হয় ইংল্যান্ডে। প্রিমিয়ার লিগের জনপ্রিয়তা আকাশছোঁয়া। এমনকি প্রথম আন্তর্জাতিক ফুটবল ম্যাচও খেলেছে ইংল্যান্ড। খোদ ফিফা মনে করে, গ্লাসগোর পশ্চিম স্কটল্যান্ড ক্রিকেট ক্লাবের মাঠে ১৮৭২ সালের ৩০ নভেম্বর হওয়া ইংল্যান্ড বনাম স্কটল্যান্ড ফুটবল ম্যাচটি সম্ভবত ফুটবল ইতিহাসের প্রথম আন্তর্জাতিক খেলা।
অথচ ইংল্যান্ড জাতীয় দলের ট্রফি-ভাগ্য দেখলে এসব তথ্য অবিশ্বাস্য মনে হবে। আজ অবধি কেবলমাত্র একটিবার বিশ্বকাপ জিতেছে ইংল্যান্ড। ১৯৬৬ সালে। সেবার দেশের মাটিতেই আয়োজিত হয়েছিল বিশ্বকাপ। ওই একবারই বিশ্বকাপ হয়েছে ইংল্যান্ডে। তখনও অবশ্য ট্রফির নাম জুলে রিমে ট্রফি। ইংল্যান্ডের অধিনায়ক ছিলেন ববি মুর। গর্ডন ব্যাঙ্কস, জিওফ হার্স্ট, ববি চার্লটন, মার্টিন পিটার্স, অ্যালান বলের তারকাখচিত ইংল্যান্ডের সামনে ফাইনালে মুখোমুখি হয়েছিল পশ্চিম জার্মানি। সেই দলে ছিলেন মাত্র কুড়ি বছরের ফ্রাঞ্জ বেকেনবাউয়ার। লন্ডনের ওয়েম্বলিতে নব্বই মিনিট অবধি ২-২ চলার পর অতিরিক্ত সময়ে জিওফ হার্স্টের পর পর দুই গোলে চ্যাম্পিয়ন হয় ইংল্যান্ড। হ্যাটট্রিক করেছিলেন হার্স্ট (পশ্চিম জার্মানি প্রথমার্ধে এক গোলে গিয়ে যাওয়ার পরে ১৮ মিনিট নাগাদ প্রথম গোলটি করেছিলেন হার্স্ট)। আজ অবধি বিশ্বকাপ ফাইনালে হ্যাট্রটিক করার ঘটনা মাত্র দুইবারই ঘটেছে। দ্বিতীয় হ্যাটট্রিক করেন ২০২২ সালে, কাতার বিশ্বকাপ ফাইনালে, ফরাসি তারকা কিলিয়ান এমবাপে।
তারপরে বিশ্বকাপ, ইউরোর মাঠে বহু গোল হয়েছে। অথচ একবারের জন্যও দুই ট্রফির একটিও লন্ডনের হিথরো বিমানবন্দরে এসে নামেনি। বস্তু, ২০২০ সাল অবধি ইংল্যান্ড কখনও বিশ্বকাপ বা ইউরোর ফাইনালেও ওঠেনি। ২০১৮ সালে অবশ্য চতুর্থ স্থানে ছিল ইংল্যান্ড। তার আগে একবারই চার নম্বর অবধি উঠেছিল তারা। সেই ১৯৯০ সালের, ইতালি বিশ্বকাপে। ফাইনালে দিয়েগো মারাদোনার আর্জেন্তিনাকে হারিয়ে কাপ জিতেছিল লোথার ম্যাথাউস, জুরগেন ক্লিন্সমানের পশ্চিম জার্মানি। তৃতীয় স্থানের ম্যাচেও রবার্তো বাজ্জো, কার্লো আন্সেলোত্তির ইতালির কাছে হেরে যায় ব্রায়ান রবসনের ইংল্যান্ড।
সে তুলনায় দেখলে, গ্যারেথ সাউথগেট কার্যত ইতিহাসের দোরগোড়ায় দাঁর করিয়ে দিয়েছেন ইংল্যান্ডকে। বিশ্বকাপে চতুর্থ স্থানে তুলেছেন। কিন্তু তার চেয়েও বড় কথা, যে টুর্নামেন্টের ফাইনালে অবধি কোনওদিন উঠতে পারেনি ইংরেজরা, সেই ইউরোতে পর পর দুইবার ফাইনালে তুলে দিয়েছেন। শুনতে আশ্চর্য লাগলেও অন্তত পরিসংখ্যানের বিচারে কার্যত ইংল্যান্ডের সর্বকালের সেরা ম্যানেজার-অধিনায়ক জুটি হবার মুখে গ্যারেথ সাউথগেট ও অধিনায়ক হ্যারি কেন। অন্তত দেশের বাইরে এই প্রথম কোনও বড় টুর্নামেন্টের ফাইনালে উঠল ইংল্যান্ড!
ইতালিতে ১৯৯০ সালের বিশ্বকাপে তৃতীয় স্থানের ম্যাচে ব্রায়ান রবসনের ইংল্যান্ড দলে ছিলেন গ্যারি লিনেকার। বিবিসিতে লিনেকার সাফ জানিয়েছেন, ইংলিশ ফুটবলের জন্য এটা একটা বিরাট ব্যাপার। তাঁর কথায়, 'দেখুন, আগেরবারেও ফাইনালে উঠেছিল, এবারেও ফাইনালে উঠেছে। আগেরবারটা না হয় ওয়েম্বলিতেই ছিল। চূড়ান্ত হতাশ হয়েছিলাম আমরা। এটাও খুবই কঠিন ফাইনাল হতে চলেছে। কিন্তু ওরা ইতিহাসের কিনারায় দাঁড়িয়ে। আজ অবধি কোনও ইংরেজ দল বিদেশের মাটিতে কোনও বড় টুর্নামেন্ট জেতেনি!'
গ্যারেথ সাউথগেট জানেন, বার্লিনে অনেকগুলো ইতিহাসের খালি পাতা অপেক্ষা করে থাকবে তাঁর জন্য। লুইস দে লা ফুয়েন্তের স্পেন শক্ত গাঁট। ডেকলান রাইস যেমন বলেছেন, খেলোয়াড়রা আর কিছু না হোক, স্রেফ সাউথগেটের জন্যই জিততে চান। সেই ২০১৬ সাল থেকে ইংল্যান্ডের দায়িত্বে রয়েছেন সাউথগেট। সামনের ডিসেম্বরেই তাঁর সঙ্গে ইংল্যান্ড বোর্ডের চুক্তি শেষ হচ্ছে। বার্লিনে গ্যালারিতে থাকবেন স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী কিয়ের স্টার্মার। গতবারের ওয়েম্বলির ভুল আর ভুল করেও করতে চান না তিনি।