২ আগস্ট, ১৯৩৬: অলিম্পিক স্টেডিয়ামের স্ট্যান্ডে বসে খেলা দেখছেন 'ফুয়েরার' অ্যাডলফ হিটলার ও হেরমান গোয়রিং। (ছবিঃ এপি ফাইল)
শেষ আপডেট: 14th July 2024 14:55
ইউরোর হাইভোল্টেজ ফাইনাল। সত্তর হাজার দর্শকে একেবারে ভরে উঠবে গ্যালারি। বার্লিনের ঐতিহাসিক অলিম্পিক স্টেডিয়ামে আজ ফয়সলা হবে, কার হাতে উঠবে এবারের ইউরোর রুপোর ট্রফি!
'ঐতিহাসিক'-ই বটে। তবে সে ইতিহাস বিশেষ মনে করতে চান না জার্মান আমজনতা।
জার্মানিতে অবশ্য ইতিহাস নিয়ে রাখঢাক কম। বস্তুত, জার্মান ঐতিহ্যটাই সেরকম। যে ইতিহাসকে সম্পূর্ণ মুছে দিতে পারলে সম্ভবত দেশের গৌরব কয়েক গুণ বেড়ে যেতে পারত, সেই ইতিহাসকেই সযত্নে আগলে রাখে জার্মান সরকার। যে ইতিহাসের সামনে দাঁড়াতে ইস্পাতকঠিন মানুষও কেঁপে যেতে পারেন, সেই ইতিহাসের সামনে নিয়মিত নিয়ে যাওয়া হয় স্কুলপড়ুয়াদের। দেখানো হয়, মানব প্রবৃত্তি কতটা অন্ধকারে নামতে পারে। যাতে সবাই তা মনে রাখে। যাতে, সেই ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি অন্তত আর যেন না হয়!
জার্মানির আনাচেকানাচে আজও এইভাবে রক্ষিত রয়েছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ও নাৎসি অতীতের গল্প।
১৯৩৬ সাল। প্রেসিডেন্ট পল ভন হিন্ডেনবার্গের মৃত্যুর পরে জার্মান রাষ্ট্রের সর্বেসর্বা হয়েছেন অ্যাডলফ হিটলার। সমস্ত বিরুদ্ধমত নিষিদ্ধ। জাতিরাষ্ট্রের এক উদ্ভট ধারণার বশবর্তী হয়ে শুরু হয়েছে ইহুদিদের ওপর অত্যাচার। এদিকে সুচারুভাবে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ ও ওয়েইমার গণতন্ত্র থেকে বেরিয়ে এসে শুরু হয়েছে আর এক ভয়াবহ, বিধ্বংসী যুদ্ধের প্রস্তুতি। তার মাঝেই ১৯৩৬ সালের অলিম্পিকের আসর বসল বার্লিনে। যখন শহরকে বাছা হয়েছিল, নাৎসি দল তখনও ক্ষমতায় আসেনি। আসার পরে ইহুদিদের ওপর অত্যাচারের ঘটনা উল্লেখ করে অনেকে চেয়েছিলেন, বার্লিন থেকে অলিম্পিক সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হোক। কিন্তু 'ফুয়েরার' সম্পূর্ণ অন্য কথা ভাবছিলেন। ধুরন্ধর হিটলার দেখলেন, ভাবমূর্তি উদ্ধারের এই সুযোগ! সারা পৃথিবী থেকে খেলোয়াড়রা এলে নাৎসি জার্মানির নাম উজ্জ্বল হবে, তাঁরও নামডাক বাড়বে। অতএব রাইখস্ট্যাগ থেকে হুকুম হল, আদাজল খেয়ে অলিম্পিকের জন্য নেমে পড়তে হবে।
তার আগের অলিম্পিক হয়েছিল লস অ্যাঞ্জেলিসে। ১৯৩২ সালের সেই অলিম্পিকের আসর যখন বসছে, আমেরিকায় তীব্রভাবে চলছে আর্থিক মন্দা। যার ঢেউ প্রায় সারা বিশ্বে ছড়িয়েছিল। ফলে বহু দেশ আমেরিকা যেতেই পারেনি। সেই তুলনায় বার্লিনে জাঁক করতে পারলে দুর্দান্ত রাজনৈতিক চাল দেওয়া যাবে। এই সমীকরণ বুঝতে ভুল করেননি ফুয়েরার। ইতিহাসে রাজনৈতিক কলঙ্ক ঢাকতে খেলাকে হাতিয়ার করার ঘটনা বা 'স্পোর্টসওয়াশিং'-এর এটিই প্রথম বড়সড় ঘটনা!
যেমন ভাবনা, তেমন কাজ। ঢেলে সাজানো হয়েছিল বার্লিন শহরকে। রাতারাতি বানানো হল একাধিক স্টেডিয়াম। যার মধ্যে প্রধান ছিল অলিম্পিক স্টেডিয়াম, অলিম্পিকের উদ্বোধন ও মূল ট্র্যাক অ্যান্ড ফিল্ডের আসরের প্রধান মঞ্চ। নকশা করেছিলেন বিখ্যাত জার্মান স্থপতি ওয়ার্নার মার্খ ও তাঁর ভাই, স্থপতি ওয়াল্টার মার্খ। ইনি পরে নাৎসি নেতা হেরমান গোয়রিং-এর 'কারিনহল' প্রাসাদ, কায়রোর অলিম্পিক স্টেডিয়াম-সহ একাধিক স্থাপত্য বানিয়েছিলেন। শুরুতে প্রায় এক লক্ষ দর্শক বসার জায়গা ছিল স্টেডিয়ামে। স্রেফ ফুয়েরার ও তাঁর পারিষদদের জন্য বানানো হয়েছিল আলাদা একটা স্ট্যান্ড। ২৬০০ কর্মী দিনরাত এক করে কাজ করেছিলেন। শোনা যায়, নাৎসি সরকারের নির্দেশ ছিল, 'আর্য জাতির শ্রমিকদেরই কাজে নিতে হবে।'
অলিম্পিক শেষ অবধি সফলভাবেই আয়োজিত হয়েছিল। রোমের কলোসিয়ামের মত চোখধাঁধানো স্থাপত্যে মোহিত করে দিয়েছিল নতুন এই অলিম্পিক স্টেডিয়াম। পুরো স্টেডিয়াম ছেয়ে গিয়েছিল নাৎসি পতাকায়। অলিম্পিক প্রতীকের নিচে জ্বলজ্বল করত স্বস্তিকা। নাৎসি সরকার সরকারিভাবে 'ইহুদিদের অংশগ্রহণে বাধা দেওয়া হবে না' বলে জানালেও বলা বাহুল্য, নানাভাবে জার্মান ইহুদি খেলোয়াড়দের আটকানো হয়। শেষ অবধি হিটলারের আর্য শ্রেষ্ঠত্ব তত্ত্বকে চুরমার করে দিয়ে সেই অলিম্পিকের সর্বাধিক পদক জিতেছিলেন কৃষ্ণাঙ্গ মার্কিন অ্যাথলিট জেসি ওয়েনস!
পরের বছর, ১৯৩৭ সালে বার্লিন সফরে আসেন ফ্যাসিস্ট ইতালির সর্বাধিনায়ক বেনিতো মুসোলিনি। প্রায় আট লক্ষ লোকের সামনে তাঁকে এই স্টেডিয়াম প্রাঙ্গনেই অভিবাদন জানিয়েছিলেন ফুয়েরার।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষে কার্যত ধ্বংসস্তুপে পরিণত হয়েছিল বার্লিন। মিত্রশক্তির লাগামছাড়া বোমাবর্ষণে গুঁড়িয়ে গিয়েছিল জার্মান রাজধানী। কিন্তু ভাগ্যক্রমে, রক্ষে পেয়ে যায় অলিম্পিক স্টেডিয়াম। সামান্য ক্ষয়ক্ষতি অবশ্য ছিল। কিন্তু বড় রকমের কিছু নষ্ট হয়নি। যুদ্ধের পরে বার্লিন শহরকে চার ভাগে ভাগ করে মিত্রবাহিনী। অলিম্পিক স্টেডিয়াম পড়েছিল ব্রিটিশদের ভাগে। ১৯৪৬ সালে অবশ্য খানিক মেরামতির পরে স্টেডিয়াম পুনরায় খোলার ব্যবস্থা করে ব্রিটিশ সরকার। কিন্তু ১৯৯৪ সাল অবধি ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর সদর দফতর ছিল স্টেডিয়াম-চত্বর। নিয়মিত সেনা প্যারেড হত। ধুমধাম করে রানির জন্মদিনও পালন করতেন ব্রিটিশ সেনাকর্তারা। তবে, মাঠে খেলাধুলোয় আপত্তি করেনি তারা। বার্লিনের ফুটবল সংস্কৃতি মিউনিখ বা ডর্টমুন্ডের মত প্রবল নয়। তবে স্থানীয় ক্লাব হার্থা বার্লিনের খেলা হত এই মাঠে। আজও অলিম্পিক স্টেডিয়াম হার্থা বার্লিনের ঘরের মাঠ হিসেবে ব্যবহৃত হয়!