ঋষি সুনকের ভাগ্য ফেরাতে কি ভোট দেবেন হ্যারি কেনরা?
শেষ আপডেট: 28th June 2024 18:37
জার্মানিতে ইউরো খেলতে এসে ইংল্যান্ড দল যেখানে শিবির ফেলেছে, সেটা আদতে একটা গলফ রিসর্ট। সবুজ গালিচা ছড়ানো বিস্তীর্ণ উদ্যানে ঘেরা। একনজরে দেখলে মনে হবে, পৃথিবীর সমস্ত নৈঃশব্দ্য যেন নিবিড়ভাবে প্রকৃতির কোলে ঘুমিয়ে রয়েছে। সবুজ প্রান্তরের মাঝে একচিলতে ছোট্ট শহর ব্ল্যাঙ্কেনহাইন। মাত্র হাজার সাতেক লোকের বাস। কাছেই মাত্র ১৪ কিলোমিটার দূরে রয়েছে বিখ্যাত ঐতিহাসিক শহর ওয়েইমার। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরে যে শহরে স্বাক্ষরিত হয়েছিল জার্মান রাইখের প্রথম গণতান্ত্রিক সংবিধান। আজও সেই সময়টাকে ইতিহাস বইতে বলা হয় 'ওয়েইমার প্রজাতন্ত্র'। ব্ল্যাঙ্কেনহাইনে ইংল্যান্ডের গলফ রিসর্টের নামটাও 'ওয়েইমারার ল্যান্ড স্পা অ্যান্ড গলফ রিসর্ট'।
ব্ল্যাঙ্কেনহাইন থেকে ইংল্যান্ডের কাছাকাছি ইউরো খেলার মাঠ লাইপজিগ। প্রায় একশো চব্বিশ কিলোমিটার দূরে। বাসে গেলে ঘন্টাখানেকের একটু বেশি লাগে। যদিও ইংল্যান্ডের ম্যাচ সেখানে পড়েনি। গ্রুপের তিন ম্যাচ ইংল্যান্ড খেলেছে আরও দূরে গিয়ে; গেলশেনকার্খেন, কোলন ও ফ্র্যাঙ্কফুর্টে। প্রবল জাঁকজমকের আয়োজন সেখানে। দলে দলে ইংরেজ সমর্থকরা ভিড় করেছেন তিন শহরে। অথচ এর ফাঁকেও উঁকি দিচ্ছে গণতান্ত্রিক কর্তব্য। ইউরোকে ছাপিয়ে এই মুহূর্তে ব্রিটিশ দ্বীপপুঞ্জের সবচেয়ে বড় খবর, ব্রিটেনের সাধারণ নির্বাচন। আগামী ৪ জুলাই, বৃহস্পতিবার যে নির্বাচনে নির্ধারিত হতে চলেছে ঋষি সুনকের ভাগ্য।
অবশ্য লন্ডনের রাজনৈতিক মহলে কান পাতলে অন্য কথা শোনা যাবে। মোটের ওপর সমস্ত রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের সাফ কথা, ভাগ্য নতুন করে নির্ধারিত হওয়ার কিছু নেই। ঋষি সুনকের ভাগ্য নির্ধারিত বহু আগেই হয়ে গিয়েছে। এই নির্বাচনে কেবল শিলমোহরটুকু পড়বে। সমস্ত পূর্বাভাস বলছে, এবারে ঘটি ওলটাচ্ছে ঋষি সুনকের। তবে তাতেও সবটা বলা হয় না। অঙ্ক যদি মিলে যায়, তাহলে সম্ভবত এক ধাক্কায় একেবারে ধুয়ে-মুছে যেতে চলেছে সুনকের রক্ষণশীল বা কনজার্ভেটিভ দল। প্রায় ১৪ বছর পরে টোরিদের হঠিয়ে বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে ফিরতে চলেছে লেবার দল।
ভারতের মত খাতায়-কলমে ব্রিটেনেও বহুদলীয় গণতন্ত্র বলবৎ রয়েছে। তবে একাধিক দল থাকলেও বিশ শতকের গোড়া থেকে মুখ্যত দুই দলের মধ্যে লড়াইটা হয়। একদিকে কনজার্ভেটিভ দল বা টোরি, অন্যদিকে শ্রমিক দল বা লেবার। জোট সরকার পারতপক্ষে হয় না। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে প্রথম জোট সরকার গড়তে হয়েছিল ২০১০ সালে। গর্ডন ব্রাউনের পরে প্রথমবার লিবারেল ডেমোক্র্যাট নেতা নিক ক্লেগের সঙ্গে হাত মিলিয়ে সরকার গড়েছিলেন টোরি নেতা ডেভিড ক্যামেরন। সেই থেকে রক্ষণশীলরা ক্ষমতায় রয়েছেন লন্ডনে। দশক পেরিয়ে গিয়েছে তারপর। বিস্তর জল বয়েছে টেমস দিয়ে। চোদ্দ বছরে পাঁচবার প্রধানমন্ত্রী বদল করতে হয়েছে। ডেভিড ক্যামেরনের পর টেরেসা মে, তারপর বরিস জনসন, পরে লিজ ট্রস... কেউ থিতু হতে পারেননি ১০ নম্বর ডাউনিং স্ট্রিটে। ঋষি সুনক এসে খানিক হাল ধরেছেন। কিন্তু ইনফোসিস প্রতিষ্ঠাতা এনআর নারায়ণ মূর্তির জামাইয়ের নেতৃত্ব নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে ওয়েস্টমিনস্টারে। অসন্তোষ নাকি এমনই জায়গায় গিয়েছে যে, টোরি নেতারাই গাঁইগুঁই করছেন, লেবার সম্ভবত নজিরবিহীন সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে ফিরতে চলেছে সংসদে। প্রধানমন্ত্রী হতে চলেছেন লেবার নেতা কেয়ার স্টার্মার।
সাধারণত ভারতে ভোটের সময় বুথে গিয়ে ভোট দেওয়া আর পোস্টাল ব্যালট ছাড়া সেই অর্থে ভোট নেওয়ার উপায় নেই। বয়স্কদের জন্য বাড়ি বাড়ি গিয়ে ভোট নেওয়া হয়। কিন্তু ইংল্যান্ডে ভোট দেওয়ার একাধিক নিয়ম রয়েছে। চাইলে ডাকযোগে ভোট দেওয়া যায়, নয়ত কোনও তৃতীয় ব্যক্তিকে 'প্রক্সি' হিসেবে মনোনীত করে তাঁকে নিয়ে নিজের ভোট দেওয়ানো যায়। অতএব এবার মাঠে নেমেছে ফুটবল অ্যাসোসিয়েশন বা এফএ। বিশ্বের অন্যতম প্রাচীন এই ফুটবল সংস্থা ব্ল্যাঙ্কেনহাইনে বার্তা পাঠিয়েছে, যাতে ফুটবলাররা ভোট দেওয়ার আয়োজন শুরু করেন। যদি কাউকে তাঁরা প্রক্সি হিসেবে নিয়োগ করতে চান, তাহলে যেন আগাম জানিয়ে রাখেন সংস্থাকে।
রবিবার ৩০ জুন গেলশেনকার্খেনে স্লোভাকিয়ার মুখোমুখি হবে ইংল্যান্ড। জিততে পারলে পরের ম্যাচ ৬ জুলাই। ডুসেলডর্ফে ইংল্যান্ডের প্রতিপক্ষ হতে পারে সুইজারল্যান্ড বা ইতালি। তবে হেরে গেলে বিদায় নিতে হবে তাদের। সেক্ষেত্রে অবশ্য আর ভোটের ভাবনা থাকছে না। দেশে গিয়েই বুথে লাইন দিতে পারবেন ফুটবলাররা। যদিও কতজন আদৌ ভোট দেবেন, বোঝা যাচ্ছে না। রবিবার আবার ইংলিশ চ্যানেলের ওপারে ভোটযুদ্ধে নামছে ফ্রান্স। একইরকমভাবে আকস্মিক নির্বাচন ঘোষণা করে দিয়েছেন ফরাসি রাষ্ট্রপতি ইম্যানুয়েল ম্যাকরঁ। জল্পনা, তাঁর ঘটি ওল্টানোও একরকম নিশ্চিত। বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে আসতে চলেছেন উগ্র দক্ষিণপন্থী নেত্রী মেরি লাঁ পেন। যা নিয়ে ইতিমধ্যেই ফরাসি ফুটবল শিবির সরগরম। বিস্তর প্রশ্ন শুনতে হচ্ছে কিলিয়ান এমবাপেদের।
অবশ্য ফরাসি ক্রীড়াবিদরা এই নিয়ে কোনও রাখঢাকে যাচ্ছেন না। এই দিক দিয়ে অন্তত দক্ষিণ এশিয়ার চাইতে ফ্রান্সের পরিস্থিতি অনেকটাই আলাদা। রাজনীতি থেকে দূরে থাকা নয়, ইউরোর ধুন্ধুমার লড়াইয়ের মাঝেও রাজনীতি নিয়ে সচেতন থাকার বার্তা দিয়েছেন কিলিয়ান এমবাপে, মার্কাস থুরামরা। বলেছেন, উগ্র রাজনৈতিক শক্তিকে আটকানো দরকার। নাম না করলেও ইঙ্গিত স্পষ্ট। তাঁরা মেরি লাঁ পেনের দলকে আটকানোর কথাই বলতে চেয়েছেন। গত সপ্তাহে একটি ফরাসি সংবাদপত্রেও দেশের মানুষকে উগ্র দক্ষিণপন্থীদের ভোট দেওয়া থেকে বিরত থাকার আবেদন জানিয়েছেন একাধিক ফরাসি ক্রীড়া নক্ষত্র। যাদের মধ্যে রয়েছেন উইম্বলডন চ্যাম্পিয়ন মারিয়ন বার্তোলি।
ইংরেজদের অবশ্য রাজনীতি নিয়ে এতটা কথা শুনতে হচ্ছে না। তাঁদের খেলা দেখেই সাংবাদিকরা ক্ষুব্ধ। তবে এফএ জানিয়ে দিয়েছে, ভোট দিতে কাউকে জোরাজুরিও করা হবে না। যার ইচ্ছে হবে, তিনি দেবেন।