যুবভারতীতে আজ একটি যুগের অবসান।
শেষ আপডেট: 6th June 2024 16:35
দ্য ওয়াল ব্যুরো: ১৯ বছর। ১৫০ ম্যাচ। ৯৪ গোল। পৃথিবীতে এই মাপকাঠিতে তাঁর স্থান চার নম্বরে। তাঁর আগে আছেন স্রেফ তিনজন। লিওনেল মেসি, ইরানের আলি দেয়ি ও সবার ওপরে ক্রিশ্চিয়ানো রোনাল্ডো। তাঁর নিচে কারা রয়েছেন? রোমেলু লুকাকু, রবার্ট লেওয়ানডস্কি, নেইমার, লুই সুয়ারেজ, অলিভিয়ের জিরু...।
আজ, ইতিহাসের একটা অধ্যায়ের শেষে পেন বন্ধ করে রাখার দিন। একটা যুগ শেষ হতে চলেছে ভারতীয় ফুটবলে। সুনীল ছেত্রী যুগ।
বৃত্তের যে বিন্দু থেকে শুরু হয়েছিল, খেলার দুনিয়ায় সেই বিন্দুতেই শেষ হওয়াটা সবার ভাগ্যে জোটে না। সচিন তেণ্ডুলকররা ব্যতিক্রম। শেষ ম্যাচের জন্য ডালি সাজিয়েছিল ওয়াংখেড়ে। সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায় টেস্ট থেকে অবসর নিয়েছিলেন নাগপুরে। ভিভিএস লক্ষ্মণ নিঃসাড়ে শেষ টেস্ট খেলেছিলেন অ্যাডিলেডে। কিন্তু সুনীলের জন্য আজ গ্যালারি সম্ভবত কানায় কানায় ভরিয়ে দেবে যুবভারতী। যতই তাঁর ছোটবেলা কাটুক দিল্লিতে, এখন থাকেন বেঙ্গালুরুতে। যায় আসে না। সুনীল ছেত্রী নামটার ফুটবল-রেকর্ড বইতে লেখা শুরু এই কলকাতায়। সেই ২০০২ সালে, প্রথম যোগ দিয়েছিলেন মোহনবাগানে। উজাড় করে ভালবেসেছিল কলকাতা ময়দান। তারপর কলকাতায় আর বেশি খেলেননি সুনীল। চলে গিয়েছিলেন জেসিটিতে। তিনি আজও বলেন, ওটাই তাঁর কেরিয়ারের টার্নিং পয়েন্ট। ছিপছিপে, তরুণ সুনীলকে নিজের মত করে তৈরি করেছিলেন জেসিটির তৎকালীন কোচ সুখবিন্দর সিংহ।
কলকাতায় ফিরেছিলেন সুনীল। কিন্তু বেশিদিনের জন্য নয়। তারপর হয়ত এক মরসুম খেলেছেন ইস্টবেঙ্গলে। ততদিনে সুনীলের জন্য উজ্জ্বল হতে চলেছে পশ্চিম আকাশ। একের পর এক ইউরোপ ও আমেরিকার ক্লাব থেকে সুনীলের জন্য প্রস্তাব আসতে শুরু করে। সুযোগ পান ক্রিশ্চিয়ানো রোনাল্ডোর পুরনো ক্লাব স্পোর্টিং লিসবনে। কানসাস সিটি উইজার্ডে সইসাবুদও সারেন সুনীল। মরসুমের মাঝে একটা প্রদর্শনী ম্যাচে ম্যাঞ্চেস্টার ইউনাইটেডের বিরুদ্ধে বদলি হিসেবে নেমেছিলেন সুনীল। তারপরের ঘটনা ঠিক শ্যামলালের পক্ষেও বলা কঠিন। যে কারণেই হোক, অতলান্তিকের ওপারে সুনীলের কেরিয়ার আর এগোয়নি। দেশে ফিরে কলকাতায় নবাব ভট্টাচার্যের চিরাগ ইউনাইটেডে যোগ দিয়েছিলেন। পরের মরসুমে দ্বিতীয়বারের জন্য আসেন মোহনবাগানে। সেই শেষ। ২০১২ সালের পর আর কখনও কলকাতার ক্লাবের হয়ে খেলেননি সুনীল।
অথচ কলকাতা তাঁকে ছাড়েনি। কলকাতার জামাই তিনি। মোহনবাগানে কেরিয়ার শুরুর সময়েই কোচ সুব্রত ভট্টাচার্যের মেয়ে সোনমের সঙ্গে পরিণয়সূত্রে বাঁধা পড়েন সুনীল। মহেন্দ্র সিংহ ধোনি যখন ক্রিকেটে ভারত অধিনায়ক, তখন ক্রিকেট-ফুটবল দুই খেলাতেই জাতীয় দলের দুই অধিনায়ক ছিলেন কলকাতার জামাই। দু'জনেরই কেরিয়ারের শুরু বাংলায়। ধোনি ভাঙা ভাঙা বাংলা জানেন। সুনীল কিন্তু ঝরঝরে বাংলা বলতে পারেন। এক দশকের ওপর কলকাতায় না খেলা সুনীল ইস্টবেঙ্গল ক্লাবের এক অনুষ্ঠানে এসে অকপটে বলে দেন, 'বেঙ্গালুরু ড্রেসিংরুমের ছেলেরা আমাকে যখনই জিজ্ঞেস করে, আমরা মোহনবাগান বা ইস্টবেঙ্গলের বিরুদ্ধে খেলব ছেত্রীদা, কী হবে; আমি সবসময় ওদের বলি, দল, ফুটবলার কোচ, সাপোর্ট সবাই তো থাকবেই বিপরীতে। কিন্তু তোমাদের যাদের বিরুদ্ধে খেলতে হবে, সেটা ওই গ্যালারি। কলকাতায় যদি ওই গ্যালারির সামনে নার্ভ ধরে রেখে খেলতে পারো, তবেই অর্ধেক যুদ্ধ জেতা হয়ে যাবে!'
বিরাট কোহলির খুব কাছের 'বন্ধু' সুনীল। দু'জনেই দিল্লির ছেলে, এখন ঘরোয়া লিগে খেলেন বেঙ্গালুরুতে। সুনীল থাকেনও সেখানেই। বিরাট সুনীলকে বলেন 'স্কিপ', সুনীল বিরাটকে ডাকেন 'চ্যাম্প' বলে। কিছুদিন আগে রয়্যাল চ্যালেঞ্জার্স বেঙ্গালুরুর অনুশীলনে হাজির হয়েছিল সুনীল। নিয়মিত ক্রিকেটের খবর রাখেন। একদিকে বিশ্বকাপের মঞ্চে এখন নিউ ইয়র্কে বিরাট। উল্টোদিকে, সুনীল দাঁত চেপে আজ লড়বেন বিশ্বকাপের মঞ্চে ওঠার জন্য। যোগ্যতা অর্জনের দ্বিতীয় পর্বে গ্রুপ এ'-তে ভারত রয়েছে দুই নম্বরে। ওপরে কাতার। বাকি তিন ধাপে রয়েছে ভারত, আফগানিস্তান ও কুয়েত। এই মুহূর্তে ১২১ পয়েন্টে থাকা ভারত আজ এই ম্যাচ জিততে পারলে তৃতীয় পর্বের রাস্তা অনেকটাই খুলে যাবে। যদিও চিন্তার জায়গা আছে। রক্ষণে সন্দেশ জিঙ্ঘন নেই। সুনীলের পাশে বিক্রমপ্রতাপ সিংহও থাকছেন না। কিন্তু ভাবছেন না সুনীল। আজ জয় ছাড়া আর কিছুই তাঁর চিন্তায় নেই। কোচ ইগর স্তিমাচও জানিয়েছেন, তৃতীয় রাউন্ডে উঠতে না পারলে, তিনি পদত্যাগ করবেন। এই ম্যাচ তাঁর জীবনেরও সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচ!
বিশ্বুযুদ্ধের মহড়ায় কেরিয়ারের শেষ ম্যাচে যুবভারতীতে শেষ বারের জন্য দেশের জার্সিতে নামবেন সুনীল। মহাকাব্যের শেষ সর্গের রণভূমির সাক্ষী থাকবে তাঁর শুরুর সাক্ষী কল্লোলিনী মহানগর।