শেষ আপডেট: 15th July 2024 15:12
কাছাকাছি থাকলে হয়তো মেরেই দিতেন আলেজান্দ্রো ম্যাগদেলেনা। হয়তো মারতেন না, প্রবল ভর্ৎসনা করতেন। কিংবা বলতেন, তুমি কী ফুটবলের বোঝো হে! তোমাদের দেশ তো ফিফা ক্রম তালিকায় ১২৪! তাদের দেশের একজন ফুটবল সাংবাদিকের লিওনেল মেসির অবসর নিয়ে প্রশ্ন মনে আসার সাহস হয় কী করে!
আলেজান্দ্রো আর্জেন্টিনার নামী দৈনিক ডিপটির্ভো মুন্দিয়াল নামক একটি নামী দৈনিকের সিনিয়র সাংবাদিক। জাতীয় দল যেখানে খেলতে যায়, সেখানেই যান গ্র্যাবিয়েল বাতিস্তুতার মতো দেখতে সুদর্শন এই মেঠো সাংবাদিক।
হোয়াটসঅ্যাপ কলে সোমবার ভারতীয় সময়ে সকাল সাড়ে এগারোটার সময় আধো আধো ইংরাজিতে বলছিলেন, ‘‘আমার ভাইয়ের খুব শরীর খারাপ, আমেরিকায় কোপার গ্রুপ পর্বের ম্যাচ কভার করে ফের বুয়েনস আয়ার্সে চলে এসেছি। না হলে শনিবার মিয়ামির হার্ড রক স্টেডিয়ামের প্রেস বক্সে আমিও অব্যর্থভাবে থাকতাম।’’
কাতারে বিশ্বকাপ কভার করতে গিয়েই আলাপ। দারুণ হাসিখুশি, খুব মিশুকেও। এমনিতে সদালাপী মনে হলেও আর্জেন্টিনার ফুটবল সাংবাদিক বলে মনে একটা অহংবোধ রয়েছে। জার্মানদের মধ্যে প্রবল জাত্যাভিমান কাজ করে কথা বলার সময়। সেই অহং থেকেই বলছিলেন, ‘‘কোপাতে কেন লিও অবসর নিতে যাবে! ওঁর মতো কিংবদন্তির কিংবদন্তির অবসর মঞ্চ আর যাইহোক কোপা আমেরিকা হতে পারে না। আমরা লিওকে ২০২৬ আমেরিকা বিশ্বকাপেও চাই। হারুক বা জিতুক, ওঁর কাছে আমাদের আরও চাওয়ার কিছু নেই। দেশবাসীকে সব দিয়েছে, দু্বার কোপা, একটা বিশ্বকাপ, একটা অলিম্পিক্স ফুটবলে সোনা। আর কী চাই ওই লোকটার থেকে?’’
সোমবার কোপা জয়ের শেষে মেসির ক্রন্দনরত মুখের ছবি ভাইরাল হয়ে গিয়েছে সোশ্যাল সাইটে। যিনি এতটাই ধনী যে আফ্রিকা মহাদেশের তিনটি দেশ একদিনে কিনে নেওয়ার ক্ষমতা রাখেন, যাঁর ক্যারিশমা সারা বিশ্বের কাছে আগ্রার তাজমহলের মতো দীপ্তিময়। যিনি মোট সাতবার ব্যালন ডি’অর জিতেছেন। সেই তিনি কিনা চোটে ৬৫ মিনিটে উঠে গিয়ে এমনভাবে শিশুর মতো কাঁদছেন। কী করে হতে পারে? মার্কার একটা প্রতিবেদনে দেখলাম মেসিকে ‘ঈশ্বরের পুত্র’ বলে বর্ণনা করা হয়েছে। ঈশ্বরও নাকি ভক্তের চরম দুঃখের দিনে নিভৃতে চোখের জল ফেলেন।
মেসির হয়তো মনে পড়ে গিয়েছিল ২০১৬ সালের কোপা আমেরিকার ফাইনালে চিলির বিরুদ্ধে পেনাল্টি মিস করার ঘটনা। সেদিন এতটাই দুঃখ পেয়েছিলেন অবসরই নিয়ে ফেলেন। বলেছিলেন, ‘‘দেশকে আর আমি কোনওদিন বিশ্বকাপ কেন, কোপাও দিতে পারব না! আমার সেই ক্ষমতা নেই।’’
একজন চ্যাম্পিয়ন কতটা ব্যর্থ হলে তাঁর নিজের আত্মবিশ্বাস তলানিতে এসে ঠেকে, সেদিন বুঝেছিল খেলার দুনিয়া। তারপর অবশ্য দেশবাসীর ডাকে মেসি ফিরে এসে ৫ বছরের মাথায় আর্জেন্টিনাকে কোপা চ্যাম্পিয়ন ও ২০২২ সালে কাতার বিশ্বকাপে চ্যাম্পিয়ন করেছিলেন।
তারপরেও সোমবারের দিনটি মেসির কাছে একপ্রকার অভিশপ্তই। তার একটাই কারণ, ফাইনালে দলের জয়ের পিছনে তাঁর কোনও ভূমিকা লেখা থাকল না। এটা একজন চ্যাম্পিয়নের কাছে বড় বেদনার।
সুপারস্টাররা ব্যর্থতাকে খুব ভয় পান। তাঁরা হারতে জানেন না। ঘুমিয়ে ঘুমিয়েও স্বপ্ন দেখেন সাফল্যের চাঁদে হেঁটে বেড়াচ্ছেন। মেসির ক্ষেত্রেও কোপা ফাইনালে কলম্বিয়ার বিরুদ্ধে ম্যাচটিতে চোট পেয়ে মাঠ ছাড়ার সময় মেসির মনে হয়েছে, তিনি নেই কী করে দল জিতবে! রিজার্ভ বেঞ্চে বসে দলের হার দেখার চেয়ে ইন্টার মিয়ামির বন্ধ ড্রেসিংরুমে বসে চোখের জল ফেলা অনেকবেশি ভাল!
মেসির মতো আর্জেন্টিনার রাজপুত্রের মধ্যে অপরাধবোধ দেখে পেশাদার ফুটবলারদের চোখের কোনও চিকচিক করে উঠবে। অর্থ দিয়ে সব হয় না, মনের ভেতরে সাফল্যের একটা স্পৃহাও থাকতে হয়। আর্জেন্টিনার অধিনায়ক মেসি আরও একবার খেলার জগৎকে সেটি প্রমাণ করলেন। সাফল্যে তোমার কোনও অবদান না থাকলে জীবন বৃথা মনে হবে। তাও তুমি আবার দলের নেতাও!
আমেরিকা বিশ্বকাপে মেসি খেলবেন কিনা, সেটিও একটি বড় প্রশ্ন। তিনি সম্প্রতি আভাসই দিয়েছেন, আমার ফুটবল কেরিয়ার শেষের পথে! তারপর কোপা আমেরিকায় তাঁর চোট যা ভুগিয়েছে, তিনি নিজেও বুঝতে পারছেন, এবার থামতে হবে। মন দিলেও শরীর দিচ্ছে না। কিন্তু ওই যে, মেগাস্টারদের কাছে অবসর ঘোষণা মৃত্যুর মতো নির্মম। সিদ্ধান্ত নিতে গেলে কতগুলো রাত জাগতে হবে, তিনি নিজেও জানেন না। তবে এও ঠিক, এবার যদি মেসি অবসরও নেন, তাতেও তিনি পিছন ফিরলে তৃপ্তিই পাবেন।
একটা সময় মারাদোনার সঙ্গে তাঁর তুলনায় অপরাধবোধে ভুগতেন। মনে মনে ভাবতেন, দিয়েগো যা দিয়েছেন দেশকে, তিনি পারেননি। কিন্তু শেষ পাঁচটি বছর ৩৭-র মেসির জীবনকে এক লহমায় বদলে দিয়েছে। এবার থামলেও গ্যালারিতে গর্বভরা মুখের মেসিকেই আমরা পাব, সেখানে কোনও গ্লানি থাকবে না, একটুও না!