প্রিমিয়ার লিগের রেফারি
শেষ আপডেট: 13th January 2025 16:43
দ্য ওয়াল ব্যুরো: অ্যান্থলি টেলর, মাইকেল অলিভার, অ্যান্ডি ম্যাডলি, সাইমন হুপার… সপ্তাহশেষে টিভির পর্দায় বিশ্ব ক্লাব ফুটবল দেখার নেশা থাকলে নামগুলির সঙ্গে আপনি কমবেশি পরিচিত হলেও হতে পারেন। এঁরা প্রত্যেকে রেফারি। চেলসি বনাম আর্সেনাল, ম্যাঞ্চেস্টার ইউনাইটেড বনাম ম্যাঞ্চেস্টার সিটি… প্রিমিয়ার লিগের মারকাটারি সমস্ত ম্যাচে থাকে এঁদেরই শ্যেনদৃষ্টি।
যদি প্রশ্ন ওঠে: এই রেফারিদের মধ্যে কোন বিষয়ে মিল রয়েছে, তবে উত্তর খুঁজতে বেগ পেতে হবে। কিন্তু একটু খেয়াল করলেই বুঝবেন, প্রিমিয়ার লিগের দায়িত্বে থাকা রেফারিদের সকলেই শ্বেতাঙ্গ, একজনও কৃষ্ণাঙ্গ নন। আজ বলে নয়। সাবেক ব্রিটিশ ফুটবল ঐতিহ্য হাতেগোনা কালো চামড়ার রেফারিকে মান্যতা দিয়েছে।
হাঁটু মুড়ে ‘ব্ল্যাক লাইফ ম্যাটার্স’ বলে সহমর্মিতা দেখানো হোক কিংবা খেলা শুরুর আগে ব্যানার-ফেস্টুনে ‘নো রুম ফর রেসিজম’ লিখে বার্তা প্রদর্শন… মাঠের বাইরে ভব্যতা-বাহারে ইংল্যান্ডের ফুটবল অ্যাসোশিয়নের জুড়ি মেলা ভার। কিন্তু কৃষ্ণাঙ্গ রেফারি বাছাইয়ের ক্ষেত্রে বরাবর চোখে ঠুলি পরে রেখেছে তারা। আর এখানেই প্রশ্ন উঠবে: কেন?
ইতিহাস বলছে, ২০২০-২১ মরশুম বাদ দিলে, এক বছর নয়, দু’বছর নয়, আজ থেকে পাক্কা আঠারো বছর আগে শেষবার কোনও কৃষাঙ্গ রেফারি প্রিমিয়ার লিগের ম্যাচ পরিচালনার দায়িত্ব পেয়েছিলেন। তাঁর নাম উরাই রেনে। ১৯৯৭ সালে তিনি চুক্তিবদ্ধ হন। ১৭০টি ম্যাচ খেলানোর পর ২০০৮ সালে অবসর নেন উরাই। এরপর সময় গড়িয়েছে। কিন্তু আর কোনও অ-শ্বেতাঙ্গ রেফারির ভাগ্যে শিকে ছেঁড়েনি।
এরই সূত্রে, ২০২০-২১ সালের সমীক্ষায় একটি ভয়ংকর তথ্য সামনে আসে। দেখা যায়, প্রিমিয়ার লিগ এবং চ্যাম্পিয়নশিপ—ইংলিশ ফুটবল-পিরামিডের উপরের দুই থাকে ৪০ জন রেফারিকে বেছে নিয়েছিল এফএ। তার মধ্যে কৃষ্ণাঙ্গ প্রতিনিধির সংখ্যা শূন্য! শুধু রেফারিই নন, ম্যাচ রেফারি কিংবা লাইন্সম্যানদেরও সক্কলে শ্বেতাঙ্গ।
এর কারণ অনুসন্ধানে কোমর বেঁধে নামে ফুটবল অ্যাসোশিয়েশন। দেখা যায়, কৃষ্ণাঙ্গ সম্প্রদায়ের মধ্যে রেফারির ভূমিকায় কাজ করা নিয়ে কোনও প্রণোদনা নেই। আর এর মূল কারণ হচ্ছে, অনুপ্রেরণার ঘাটতি, রোল মডেলের অভাব। একা উরাই রেনে কোনও পরিস্থিতি পাল্টাতে পারেননি, তা সম্ভবও না। কৃষ্ণাঙ্গ কমিউনিটি তাঁকে ‘ব্যতিক্রমী’ বলে দেগে দিয়েছিল এবং একযোগে সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, এই দুনিয়া তাদের জন্য নয়। পেশা হিসেবে মানুষ সবসময় নির্ভরযোগ্য কোনও পরিসর খোঁজে। রেফারিংয়ের দুনিয়া কালো চামড়ার মানুষদের সেই নির্ভরতার আশ্বাস দিতে পারেনি।
শুধুমাত্র ক্ষমতাসীন আধিকারিকদের বিশ্লেষণ নয়, উলটো দিক থেকেও পাল্টা সমীক্ষা চালানো হয়। ‘ব্ল্যাক, এশিয়ান অ্যান্ড মিক্সড এথনিসিটি রেফারি সাপোর্ট গ্রুপ’ নামে একটি সংগঠন এই বিষয়ে ২০২০ সালে একটি রিপোর্ট জমা দেয়। সেখানে মারাত্মক অভিযোগের সুরে জানানো হয়, ব্রিটিশ ফুটবল অ্যাসোশিয়েশনের কিছু শীর্ষস্থানীয় আধিকারিক, যাঁদের হাতে রেফারিদের প্রমোশনের দায়িত্ব ন্যস্ত রয়েছে, তাঁরা নিজেরাই বর্ণবিদ্বেষী!
অর্থাৎ কিনা সর্ষের মধ্যেই ভূত! রিপোর্টে প্রমাণ সহযোগে দেখানো হয় কীভাবে সেই সমস্ত কর্তাব্যক্তিরা স্কেলিং করতে গিয়ে কৃষ্ণাঙ্গ রেফারিদের প্রতি অবমাননাকর মন্তব্য ছুড়ে দিয়েছেন। তার মধ্যে একটি ছিল: ‘তোমরা (কৃষাঙ্গরা) প্রত্যেকে জোরে ছুটতে পারো। ব্যাস! এইটুকুতেই তোমরা দক্ষ।‘ অর্থাৎ, বৌদ্ধিক বা মানসিক কোনও গুণাগুন নয়, শারীরিক কসরতেই কৃষাঙ্গরা দড়—এমন ছকেবাঁধা হীন মন্তব্য এসেছিল খোদ ওপরমহল থেকে… যাদের হাতে নিয়োগের ভার, পদোন্নতির দায়িত্ব, তাদের মুখ থেকে। বাকিটুকু সহজেই অনুমেয়!
কৃষাঙ্গ জনগোষ্ঠীদের মতে, বর্ণবিদ্বেষ এমন একটি বিষয় যা বংশপরম্পরায় কিংবা প্রজন্ম-ভেদে বাহিত হয়ে থাকে। ফলে গোড়া থেকেই বর্ণবিদ্বিষ্ট এফএ আধিকারিকেরা এমন ‘বদ রক্তে’র ধারা চালু করে দিয়ে গেছেন, যা আজও পরিস্রুত হল না।
তবে এরই মধ্যে কিছুটা হলেও আশার আলো দেখা দিয়েছে। ২০২০-২১ মরশুমে উরাই রেনের পর প্রথমবার রেফারির বাঁশি মুখে মাঠে নামেন কৃষ্ণাঙ্গ অ্যাকিল হওসনকে। কিন্তু এর জন্য অপেক্ষা করতে হয় দীর্ঘ ১৫ বছর। ১৯৯২ সাল থেকে চালু হওয়া গোটা প্রিমিয়ার লিগ জমানায় এই দুজন… সাকুল্যে দুজন কৃষ্ণাঙ্গ রেফারি ম্যাচ পরিচালনার বরাত পেয়েছেন। এই তথ্য ‘আশার আলো’ নাকি ‘ব্যতিক্রমী বিকিরণ’ সেটা নিয়ে কাটাছেঁড়া করবে পনেরো বছর পরের প্রজন্ম।