চোট-আঘাতে বিদ্ধ ফুটবলারেরা
শেষ আপডেট: 29th January 2025 19:50
রূপক মিশ্র
ছেলেবেলার ক্লাব স্যান্টোসেই ফিরে গেলেন নেইমার। বার্সেলোনায় যে খ্যাতির দ্যুতি ছড়িয়ে পড়েছিল, পিএসজি-তে তা ফিকে হয়ে আসে। আর সৌদি আরবের আল-হিলালে পুরোপুরি যায় উবে। এই মানের ক্রমিক অধোগতি, তার খলনায়ক চোট-আঘাত। হাঁটু, পাঁজর, গোড়ালি, পেশি—শরীরের নানান অঙ্গপ্রত্যঙ্গ বিভিন্ন সময় জুড়ে আহত, চোটগ্রস্ত হয়েছে। আর কখনও দু’মাস, কখনও তিন মাস, কখনও-বা একটা গোটা মরশুম মাঠের বাইরে কাটাতে হয়েছে নেইমারকে। যার সাম্প্রতিক নজির চলতি সিজনে আল-হিলালের সভ্য-সমর্থকেরা ভালোই আঁচ পেয়েছেন। মাত্র দুটি ম্যাচে মাঠে নেমেছেন নেইমার। তারপর ফের স্ট্রেচারে শুয়ে সাইডলাইন ধরে চলে গেছেন ড্রেসিংরুমে।
শুধু ব্রাজিলের এই তারকা ফুটবলার নন। বিশ্ব ফুটবলেব এমন অনেক তারকাই চোট-আঘাতের জেরে তাঁদের কেরিয়ারে ইতি টেনেছেন। আদ্রিয়ানো থেকে রোনাল্ডো, হ্যাজার্ড থেকে মাইকেল ওয়েন—এমন ভাগ্যবিড়ম্বিত ফুটবলারদের তালিকা কম লম্বা নয়।
১. মার্কো ভান বাস্তেন
নেদারল্যান্ডের স্ট্রাইকার। ফুটবলের অন্যতম ‘কমপ্লিট নাম্বার নাইন’। এসি মিলানের হয়ে জিতেছেন অসংখ্য খেতাব। ১৯৮৮ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের বিরুদ্ধে ভলিতে করা তাঁর গোল ফুটবলের লোককথায় জায়গা করে নিয়েছে। গোড়ালির চোটের জেরে বুট জোড়া চিরতরে তুলে রাখতে বাধ্য হন। তখন বাস্তেনের বয়স ৩০ বছর। হ্যাঁ, মাত্র তিরিশেই ফুটবলকে চিরবিদায় জানিয়েছিলেন এই ডাচ-লেজেন্ড! তাঁর অবসরের পর ফ্যাবিও কাপেলো কান্নাভেজা গলায় বলেছিলেন, ‘বাস্তেনের আগাম অবসর শুধু তাঁর দুর্ভাগ্য নয়, ফুটবলের ইতিহাসেও এক অন্ধকার দিন!’
২. রোনাল্ডো
রোনাল্ডো মানে শুধুই ক্রিশ্চিয়ানো নন, ব্রাজিলের ‘এল ফেনোমেনন’ও বটে। কী জেতেননি তিনি! বিশ্বকাপ, বালঁ দ্য, গোল্ডেন বুট সমেত একাধিক লিগ খেতাব—রোনাল্ডোর ঝুলি সাফল্যের স্তবকে মোড়া। ১৯৯৮ সালে উয়েফা কাপের সেমিফাইনালে নাস্তানাবুদ হওয়ার পর আলেজান্দ্রো নেস্তার মতো ডিফেন্ডার বলতে বাধ্য হন: ‘এই ম্যাচে আমার জীবনের সবচেয়ে মর্মান্তিক অভিজ্ঞতা।‘ ২০০৩ সালে ওল্ড ট্র্যাফোর্ডে হ্যাটট্রিক করেন রোনাল্ডো। আলেক্স ফার্গুসনের টিমকে লেজে খেলানোর পর ম্যাঞ্চেস্টার ইউনাইটেড সমর্থকেরা রোনাল্ডোকে ‘স্ট্যান্ডিং ওভেশন’ দেন। একজন ফুটবলারের সাফল্যের খতিয়ান শুধুমাত্র রংচঙে খেতাবে ধরা থাকে না, তা যখন সংক্রামিত হয় গ্যালারি এবং গ্যালারি ছাড়িয়ে বাইরের সমাজে, তখনই সেই খেলোয়াড় ‘লোকোত্তর’ অভিধা অর্জন করেন। রোনাল্ডো পেয়েছিলেন সেই সম্মান। ২৩ বছর বয়সে গোড়ালিতে পরপর দুটো মারাত্মক আঘাত তাঁর কেরিয়ারকে থমকে দেয়। যে উচ্চতায় যেতে পারতেন, তার খানিকটা পৌঁছেই নেমে আসতে বাধ্য হন রোনাল্ডো।
৩. এডেন হ্যাজার্ড
রোনাল্ডো-মেসি ছায়াবৃত্তে থেকেও যারা আলাদা হতে চেয়েছেন, আলাদা হতে পেরেছেন, এডেন হ্যাজার্ড তাঁদের অন্যতম। চেলসির হয়ে দু’বার প্রিমিয়ার লিগ জেতা এই উইংগারের অস্ত্র ছিল ক্ষুরধার গতি, গতির আকস্মিক বদল (ফুটবলের ভাষায়: চেঞ্জ অফ পেস) আর ড্রিবলিং। তাই ক্রিশ্চিয়ানো রোনাল্ডো রিয়াল মাদ্রিদ ছাড়ার পর বিকল্প হিসেবে তাঁর নামই ক্লাবের মালিক ফ্লোরেন্তিনো পেরেজের কাছে পেশ করেন তৎকালীন ম্যানেজার জিনেদিন জিদান। কিন্তু গোড়ালিতে বার তিনেকের আঘাত এই স্বপ্নের ট্রান্সফারকে কিছুদিনের মধ্যে দুঃস্বপ্নে পরিণত করে। ২০২৩ সালের অক্টোবর মাসে মাত্র ৩২ বয়সে ফুটবলকে বিদায় জানান বেলজিয়ামের তারকা।
৪. মাইকেল ওয়েন
মাত্র ২১ বছর বয়সে বালঁ দ্য খেতাব অর্জন করেন মাইকেল ওয়েন। দ্রুত গতি, অনবদ্য হেডিং, ফিনিশিং দক্ষতা ওয়েনকে বিশ্বের অন্যতম প্রতিশ্রুতিমান স্ট্রাইকারে পরিণত করেছিল। কিন্তু লিভারপুলের হয়ে মাঠে নেমে লিডসের বিরুদ্ধে একটি ম্যাচে হ্যামস্ট্রিংয়ে চোট পান তিনি। এল্যান রোডের সেই রাত নিমেষে দুর্ভাগ্যের রাতে পরিণত হয়। ওয়েন পরে একটি সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন: ওই ম্যাচে তাঁর পা ভেঙে গেলে হয়তো কম কষ্ট পেতেন; সেক্ষেত্রে অন্তত কেরিয়ার জারি রাখার মোহ থেকে মুক্তি পেতেন তিনি!
৫. আদ্রিয়ানো
রোনাল্ডো-উত্তর ব্রাজিলের ফুটবল ইতিহাসে অন্যতম বিধ্বংসী স্ট্রাইকার। যেমন শারীরিক শক্তি, তেমন বুলেট হেডারের ক্ষমতা। বাম পায়ে বোমারু শটে বল জালে জড়াত নিমেষে। তুরগ গতি, ড্রিবলিংয়ে অতুলনীয়। ইব্রাহিমোভিচের মতে, আদ্রিয়ানোই একমাত্র স্ট্রাইকার যিনি পেনাল্টি বক্সের যে কোনও কোণ থেকে গোল করার ক্ষমতা রাখেন। ইন্টার মিলানের হয়ে সিরি আ জেতার পর আহত হন তিনি। তারপর ধীরে ধীরে ফুটবলের মানচিত্র থেকে অপসৃত হতে থাকেন আদ্রিয়ানো। অনেক বছর বাদে তাঁর কেরিয়ারের এমন উপসংহার নিয়ে প্রশ্ন করায় ব্রাজিলের তারকা স্ট্রাইকারটি হৃদয়বিদারক জবাব দিয়েছিলেন: ‘কেন আমি ফুটবলে ইতি টানলাম? বন্ধু, উত্তরটা খুব সোজা। আমার একটা গর্ত রয়েছে গোড়ালিতে; আরেকটা আমার হৃদয়ে!’