তিনজনই নিজেদের মধ্যে আলাপ-আলোচনা সেরে টেস্টকে আলবিদা জানিয়েছেন, বিষয়টা এমন নয়। কারণ ভিন্ন, উপলক্ষ্যও।
গ্রাফিক্স: শুভ্র শর্ভিন
শেষ আপডেট: 15 May 2025 10:02
রূপক মিশ্র
অদ্ভুত ক্রান্তিলগ্নে ভারতীয় ক্রিকেট (Indian Cricket)। একটি সিরিজ। আর সেখানেই টেস্ট ক্রিকেট (Test Cricket), অনেকের মতে খেলার অন্যতম কঠিন ফর্ম্যাট, সেখান থেকে বিদায় নিয়েছেন ভারতীয় দলের তিন মহীরূহ—আর অশ্বিন (R Ashwin), রোহিত শর্মা (Rohit Sharma) এবং বিরাট কোহলি (Virat Kohli)।
তিনজনই নিজেদের মধ্যে আলাপ-আলোচনা সেরে টেস্টকে আলবিদা জানিয়েছেন, বিষয়টা এমন নয়। কারণ ভিন্ন, উপলক্ষ্যও। অশ্বিন যেমন অ্যাডিলেডে খেলেও ব্রিসব্রেন থেকে বাদ পড়েন, তারপর সিরিজ চলাকালীন ফিরে আসেন দেশে।
রোহিতের ক্ষেত্রে ছবিটা আলাদা। প্রথম টেস্টে নামেননি। দ্বিতীয় সন্তানের জন্মের সময় স্ত্রীর পাশে থাকতে চান। দল অনুমতি দেয়। পরে অস্ট্রেলিয়ায় টিমের সঙ্গে যোগ দেন। কিন্তু একের পর এক ধরাশায়ী পারফরম্যান্সের জেরে আখেরে সিডনি টেস্টে বাদ পড়েন। এমসিজি-র বক্সিং ডে ম্যাচই খাতায়-কলমে হয়ে থাকল রোহিতের কেরিয়ারের সর্বশেষ টেস্ট।
অন্যদিকে বিরাট, যিনি সমালোচনার প্রচ্ছায়াতেও ছিলেন না, ঠিক কেন টেস্টকে গুডবাই জানলেন, সেটা তিন দিন বাদেও স্পষ্ট নয়। আগামী ইংল্যান্ড সফরে যাওয়ার কথা ছিল তাঁর। কিন্তু এরই মধ্যে ছন্দপতন। তালভঙ্গ। সকলকে চমকিত করে লাল বলের ক্রিকেট থেকে সরে দাঁড়ান কোহলি। অশ্বিনের যেমন অ্যাডিলেড, রোহিতের যেমন মেলবোর্ন, বিরাটের কেরিয়ারে দুঃস্বপ্নের মাইলফলক হয়ে থাকল সিডনি।
এই ‘অস্ট্রেলিয়া-যোগ’ এখানেই শেষ হতে পারত। ভারতের ক্রিকেটের ইতিহাসে একটা যুগ, নিদেনপক্ষে একটা অধ্যায়ের উপসংহার লেখা হল অস্ট্রেলিয়ার মাটিতে—খানিক কাকতালীয় ঢঙেই—এটুকু বলেই থেমে থাকা যেত!
কিন্তু ক্রিকেটের গবেষক যারা, অতীত-বর্তমানকে একসূত্রে মিলিয়ে ভবিষ্যতের রূপরেখা আঁকতে চান, তাঁদের বক্তব্য: শুধুই মঞ্চ সাজিয়ে ক্ষান্ত থাকেনি ক্যাঙারুর দেশ। তুলে ধরেছে আরেকটি সম্পর্ক। যে সূত্রে উস্কে উঠেছে আরও একটি জল্পনা, গভীরতর সংশয়।
ইতিহাস বলছে, টিম ইন্ডিয়ার ত্রিমূর্তির অবসর ক্রিকেটের পরিসরে বিস্ময়কর হলেও অ-ভূতপূর্ব কিছু নয়। এর আগেও একই সঙ্গে তিনজন ক্রিকেটার—অভিজ্ঞ, খ্যাতিমান—দল থেকে অবসর নেন। বিদায় জানান টেস্ট ক্রিকেটকে।
সেই দলের নাম: অস্ট্রেলিয়া।
অবসর নেন ত্রিমূর্তি: রড মার্শ, গ্রেগ চ্যাপেল এবং ডেনিস লিলি।
প্রথম জন নির্ভরযোগ্য উইকেটরক্ষক। পরের জন পোড়খাওয়া ব্যাটসম্যান এবং তিন নম্বর ক্রিকেটার বিধ্বংসী পেসার। প্রত্যেকে ১৯৮৩ সালে ঘরের মাটিতে পাকিস্তান সিরিজের পর টেস্ট ক্রিকেটকে বিদায় জানান। সিডনির ওই ম্যাচ শুধু অস্ট্রেলিয়া নয়, বিশ্বক্রিকেটের নিরিখে ঐতিহাসিক!
অদ্ভুত আর মজাদার সেই ঘটনা। শুধু আশ্চর্যের নয়। তার কারণ, তিন জন ক্রিকেটার আলাপ-আলোচনা করে না হলেও কয়েক ঘণ্টা বা দিনের এদিক-ওদিকে জার্সি খুলে রাখার সিদ্ধান্ত নেন। চ্যাপেল সিডনি টেস্টের দ্বিতীয় দিনে নিজের অবসর জানিয়ে দেন। লিলি সেদিনই সন্ধেবেলা বিদায়-বার্তা ঘোষণা করেন। আর মার্শ, তিনজনের মধ্যে সবশেষে যিনি আলবিদা জানান, সিরিজ খতম হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করেছিলেন।
শুধুমাত্র স্থান-কালের বিচারে নয়। একদিকে অস্ট্রেলিয়া, অন্যদিকে ভারত—দু’দেশে দুই ধাঁচের গণ-অবসরের মধ্যে আগামী দিনে আরও একটি বিষয়ে মিল দাঁড়াতে পারে বলে অনুমান বিশেষজ্ঞদের। সেটা সত্যি হলে ভারতীয় ক্রিকেটের পক্ষে মোটেও শুভকর নয়। তার কারণ, লিলি-মার্শ-চ্যাপেল যখন ক্রিকেট থেকে সরে যান, অস্ট্রেলীয় ক্রিকেট অদ্ভুত এক পালাবদল লক্ষ্য করেছিল। অবিশ্বাস্য পুনর্গঠন চলে দীর্ঘ সময় ধরে। বিষয়টা স্রেফ তিন জন ক্রিকেটারের বদলি খোঁজা ছিল না। ছিল না শূন্যস্থান পূরণের। পরিবর্তে টিম অস্ট্রেলিয়ার ব্র্যান্ড তৈরি, অভিজ্ঞতা—যা টাকা দিয়ে কেনা যায় না—তাকে নতুন করে দলের রসায়নে মেশানো, দলের ডিএনএ উঠতি প্রজন্মের শিরায়-উপশিরায় চারিয়ে দেওয়া—সবকিছু কাজে করে দেখাতে বছরের পর বছর চলে যায়।
হিসেব বলছে, অধিনায়ক অ্যালান বর্ডারের অধীনে দীর্ঘ সময় ধরে চলেছিল এই ভাঙাগড়ার কাজ। প্রায় সাড়ে চার বছর বাদে পাতে দেওয়ার মতো কোনও সিরিজ জিতেছিল অজিরা। ১৯৮৯ সালের অ্যাসেজ জয়ের আগে শুধুই হার, হার আর হার। একের পর এক সিরিজ হাতছাড়া হতে থাকে। তিনবার নাকানিচোবানি খেতে হয় ওয়েস্ট ইন্ডিজের হাতে, দু’বার নাস্তানাবুদ করে ইংল্যান্ড ও নিউজিল্যান্ড। এমনকী সেই সময় মাঝারি মানের ভারতীয় দলকেও হারাতে পারেনি ক্যাঙারু বাহিনী!
ভারতীয় টিমের সামনেও সম্ভবত একই ধাঁচের কঠিন চ্যালেঞ্জ অপেক্ষা করছে। শুধু ইংল্যান্ড সফর নয়। তারপর রয়েছে দক্ষিণ আফ্রিকা, নিউজিল্যান্ড ট্যুর। রোহিতের পরিবর্ত খেলোয়াড় এখনও খুঁজে বের করতে পারেনি টিম ম্যানেজমেন্ট। বিরাটের ছেড়ে যাওয়া আসন পূর্ণ করার মতো ‘বীর’ কই? হন্যে বিসিসিআই, দিশেহারা নির্বাচকগোষ্ঠী। আগে উপযুক্ত উত্তরসূরী বেছে নেওয়া। তারপর ডিএনএ তৈরি, সংঘবদ্ধ দল পরিচালনা।
অস্ট্রেলিয়ার ভূত যেন কিছুতেই পিছু ছাড়ছে না!