রুপোর পদক নিয়ে অ্যাডাম পিটি।
শেষ আপডেট: 29th July 2024 17:36
দ্য ওয়াল ব্যুরো: মানুষের সুযোগ প্রতিদিন আসে না। আর অলিম্পিক্সে খেলার সুযোগ তো এমনিতেই আরও কম আসে। আর সেই খেলায় জেতার সুযোগ? আরও কম। তাই জেতা-হারা নিয়ে আপশোস থাকলেও তা নিয়ে আটকে না থেকে পরের খেলার প্রস্তুতিই শুরু করেন বিশ্বের তাবড় প্রতিযোগীরা।
কিন্তু যদি এমন মুহূর্তের সামনে দাঁড়ানো যায়, যখন অলিম্পিকে ‘অমর’ হওয়ার সুযোগ হাতের সামনে এসে যায় এবং সে সুযোগ নিয়েও ফলাফল হাতছাড়া হয়ে যায় এক সেকেন্ডের ২০০ ভাগের এক ভাগ সময়ের কারণে, তার সান্ত্বনা বোধহয় কিছু হতে পারে না। গ্রেট ব্রিটেনের সাঁতারু অ্যাডাম পিটির অবশ্য হয়েছে। 'হেরে যাওয়া'র পরে গ্যালারিতে বসে থাকা প্রেমিকা হলি রামসি ও ৩ বছরের ছেলে জর্জের কাছে ছুটে গিয়ে আকুল কেঁদে নিজেকে শুদ্ধ করেছেন তিনি। এবং পরে অকপটে সাংবাদিকদের কাছে স্বীকার করেছেন, সন্তানের জন্য এই যে আবেগ, এই যে ভালবাসা-- তা শত অলিম্পিকও দিতে পারে না। তাঁর এত বছরের সাঁতারের কেরিয়ারও দিতে পারবে না।
অ্যাডাম পিটির অর্জন করা সোনার পদকের সংখ্যাটা হল ৩১। অলিম্পিক্সে তিনবার, বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপে আটবার, কমনওয়েলথ গেমসে চারবার এবং ইউরোপিয়ান প্রতিযোগিতায় এখন পর্যন্ত ১৬ বার সোনার পদক জিতেছেন ২৯ বর বয়সি অ্যাডাম। ইতিহাস গড়েছেন ইতিমধ্যেই। আর কোনওদিন যদি সাঁতারমুখো না-ও হন, তবু তিনি সাঁতারের কিংবদন্তিই থেকে যাবেন।
তবু এক অনন্য সুযোগ এসেছিল, গতকাল অলিম্পিক্সের মঞ্চে। সাঁতারের ১০০ মিটার ব্রেস্টস্ট্রোকের ইভেন্টে টানা তিনটি সোনা জয়ের মুখে দাঁড়িয়েছিলেন তিনি। দাঁড়িয়েছিলেন, ৩২ নম্বর সোনার পদক ঝুলিতে ভরার জন্য। । তাঁর আগে একমাত্র আমেরিকার সাঁতারু মাইকেল ফেল্প্সের এই কীর্তি রয়েছে, সাঁতারের একই ইভেন্টে টানা তিনটি সোনা জয় করা।
তবে এই কীর্তি ছুঁতে পারলেন না পিটি। দুবারের অলিম্পিক্স চ্যাম্পিয়ন পিটিকে পিছনে ফেলে সোনা হাতিয়ে নিলেন ইতালির নিকোলো মার্তিনেঙ্গি। তাঁর টাইমিং ছিল, ৫৯.০৩ সেকেন্ড। ১০০ মিটার ব্রেস্টস্ট্রোকের ইভেন্টে আট বছর পরে নতুন অলিম্পিক্স চ্যাম্পিয়ন পেল বিশ্ব। আর সেই নতুন পাওয়ার পিছনে ভেজা চোখে দাঁড়িয়ে রইলেন পিটি। তাঁর টাইমিং, ৫৯.০৫ সেকেন্ড। এক সেকেন্ডের ২০০ ভাগের এক ভাগ সময়।
তবে সব জয় যেমন জয় নয়, তেমনই সব পরাজয়ও নিছক পরাজয় নয়। কারণ এই পরাজয়ের শেষেও বিজয়মালা জুটেছে তাঁর গলায়। সে মালার নাম পরিবারের স্নেহ, মায়া সম্মান। তাই ইভেন্টের পরেই দর্শক সারিতে থাকা প্রেমিকা ও ছেলেকে গিয়ে জড়িয়ে ধরে, চোখের জলে সে হারের যন্ত্রণা ধুয়ে যায় পিটির। তিনি বলেন, এই আনন্দাশ্রুর যে প্রাপ্তিবোধ, তা বিশ্বের সমস্ত প্রাপ্তির চেয়ে বেশি।
পিটি বলেন, ‘আমার ছেলেকে যখন আমি জড়িয়ে ধরি, ওর কোঁকড়ানো চুলে মুখ ডুবিয়ে আদর করি, আবেগে ভেসে গিয়ে কেঁদে ফেলি... তার কোনও তুলনা হয় না। যে কোনও বাবা–মায়ের হৃদয়ই এটা অনুভব করবেন, এই ভালবাসা তাঁদের বুকেও আছে। এটা এতটাই অন্য ধরনের এক ভালবাসা, যা সাঁতার আমায় আর দিতে পারবে না, আমি সেটা আর চাইও না।'
অ্যাডাম পিটি সাঁতারের কিংবদন্তি হলেও, তাঁর লড়াইও যে খুব সহজ ছিল তা নয়। ২০২২ সালে পা ভেঙে গিয়েছিল পিটির। সেই বছর কমনওয়েলথ গেমসে চতুর্থ পোজিশন পান তিনি। অথচ সেই প্রতিযোগিতায় এর আগে একটানা আট বছর অপরাজিত ছিলেন তিনি। ন'নন্বর বছরের এই হার মেনে নিতে পারেননি। মানসিক সমস্যা এসে গ্রাস করে, বেড়ে যায় মদ খাওয়া। নিজেকে সাঁতার থেকেও সরিয়ে নেন তিনি।
পরিস্থিতি এমনই হয়, সুইমিং পুল দেখলেই আঁতকে উঠতেন একসময়ে। ব্যক্তিগত জীবনেও ঝড় বয়ে যায় তখনই। প্রেমিকা হলি রামসির সঙ্গে সম্পর্কও ভেঙে যায়।
সেই অবস্থা থেকে একটু একটু করে ফের শুরু হয় নিজের সঙ্গে নিজের লড়াই, নিজেকে জলে ফেরানোর লড়াই। পিটি অবশ্য জীবনের সে লড়াইয়ে হার মানেননি। সেরে উঠে, সব ভুলে, আবার নেমেছেন পুলে। আবারও পদক পেয়েছেন একটার পর একটা। প্রেমিকা-সন্তানও ফিরে এসেছে জীবনে। তবে সে জীবনের শেষের ইতিহাসটুকু অধরাই থেকে গেল। অলিম্পিক্সের খাতায় রেকর্ড করা আর হল না।
পিটি অবশ্য জানেন, পদক না পেলেও, তিনি তাঁর সর্বোচ্চ শক্তি দিয়ে লড়াই করেছেন। তাতে কোনও খামতি ছিল না। জীবনের আসল লড়াইয়ে তিনি জিতেই গেছেন। তাঁর কথায়, ‘আমার সবই সাঁতারকে দিয়েছি আমি, এর চেয়ে বেশি আর দিতে পারতাম না।’ তার পাশাপাশি তাঁর কাছে আছে সন্তানস্নেহের ধারায় সিক্ত হওয়ার মুহূর্ত। তাই আক্ষেপ কি আর তাঁকে মানায়!