পদক জিতে তেরঙা হাতে মনু ভাকের। রবিবার শ্যাতেরোঁতে। (ছবিঃ এপি)
শেষ আপডেট: 28th July 2024 18:59
অলিম্পিকের আয়োজক সাধারণত হয় একটা শহরে। তার মানে যে সব ইভেন্ট সেই শহরের গণ্ডিতেই হবে, এমন নয়। এবারেই যেমন প্যারিস অলিম্পিকের ফুটবল ম্যাচ হচ্ছে ফ্রান্সের মার্সেই, লিয়ঁ, সেন্ট এঁতিয়ের মত বিভিন্ন জায়গায়। সোনার পদকের ম্যাচ অবশ্য প্যারিস সাঁ জার্মার ঘরের মাঠ পার্ক-দে-প্রিন্সেসেই হবে। মার্সেইয়ের সৈকতে হচ্ছে সেলিং বা নৌকাবাহন প্রতিযোগিতা। হ্যান্ডবল হচ্ছে লিলেঁ শহরে। ওদিকে সার্ফিং প্রতিযোগিতা তো সরে গিয়েছে পৃথিবীর এক অন্য গোলার্ধে! দশ হাজার মাইল দূরে, অস্ট্রেলিয়ার উত্তর-পুবে, প্রশান্ত মহাসাগরের তাহিতি দ্বীপের ফ্রেঞ্চ পলিনেশয়া অঞ্চলে আয়োজন করা হয়েছে সার্ফিং-এর।
প্রায় একইভাবে, শ্যুটিং ইভেন্টের কপালেও আর প্যারিসের সান্নিধ্য জোটেনি।
এবারের প্যারিস অলিম্পিকের উদ্যোক্তাদের নজর ছিল, যত কম খরচে আগে থেকে তৈরি থাকা স্টেডিয়াম বা ভেন্যুতে ইভেন্ট করা যায়। এদিক দিয়ে ব্যতিক্রম শ্যুটিং। একেবারে ঝাঁ চকচকে শ্যুটিং রেঞ্জ তৈরি করা হয়েছে। কিন্তু সেসব আইফেল টাওয়ারের পাড়া থেকে বহু দূরে। প্যারিস থেকে ২৭০ কিলোমিটার দূরে ছোট্ট শহর শ্যাতেরোঁর উপকন্ঠে, বিস্তীর্ণ এক ফাঁকা জমিতে তৈরি হয়েছে অলিম্পিক শ্যুটিং সেন্টার। প্যারিস থেকে ঘন্টাদুয়েকের ট্রেন। তারপর আবার সড়কপথে যেতে হবে আধঘন্টা। সবুজ ফাঁকা প্রান্তরের মাঝে অনেকটা জায়গা জুড়ে একইসঙ্গে তিন-চারটে শ্যুটিং রেঞ্জ বানানো হয়েছে এখানে। যাতে সব ইভেন্ট একসঙ্গে হয়ে যায়।
ফাঁকা প্রান্তরের মাঝে, এরকম পাণ্ডববর্জিত জায়গায়, অলিম্পিক পদক জিততে কেমন লাগে?
আজ, উত্তরটা পেয়ে গেলেন মনু ভাকের।
অলিম্পিক যেখানে হয়, সে পৃথিবীর দুর্গমতম প্রান্ত হলেও, সারা পৃথিবীর নজর একধাক্কায় সেদিকে চলে যায়। শ্যাতেরোঁতেও আন্তর্জাতিক মিডিয়ার ভিড়। হাজার ক্যামেরার ঝলকানি। উচ্ছ্বসিত সাংবাদিকদের অভিনন্দন। স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীর শুভেচ্ছা। মনু ভাকেরের জন্য আজ মজুত সবই। তিনি কি পিছনের দিকে আর তাকাবেন? দরকার নেই তো। আবার তাকাতেও পারেন। ওই দিনগুলো না থাকলে, আজ ফ্রান্সের এই ছোট্ট শহরের প্রান্তে গড়ে ওঠা শ্যুটিং রেঞ্জ তাঁর কাছে জীবনের শ্রেষ্ঠ মুহূর্ত হয়ে ধরা দিতে পারত?
টোকিও, ২০২১। কোভিডের আগ্রাসী দামামা। অলিম্পিক চলছে, অথচ দর্শকদের প্রবেশ সীমিত। চারদিকে তটস্থ ভাব। তার মাঝেই, স্বপ্নের ডানায় ভর দিয়ে হিসে কষছিলেন মনু। জীবনের প্রথম অলিম্পিক। বয়স মাত্র ১৯! যে বয়স স্বপ্ন দেখার। যে বয়স স্বপ্নকে নতুন করে তৈরি করার। মনুর সামনে ছিল সেই স্বপ্নকে ছুঁয়ে ফেলার হাতছানি। ন্যাশনাল রাইফেল অ্যাসোসিয়েশন অফ ইন্ডিয়া চোদ্দজন শ্যুটারের নাম নিশ্চিত করেছিল। তাতেই অন্যতম সেরা নাম ছিলেন ১৯ বছরের মনু। ২০১৮-তে গোল্ড কোস্ট কমনওয়েলথ গেমসে ২৪০.৯ পয়েন্ট নিয়ে সোনা জিতেছেন। সঙ্গে সৌরভ চৌধুরী। জাকার্তা এশিয়ান গেমসে সোনাজয়ী। ছিলেন সঞ্জীব রাজপুত। ছিলেন দিব্যাংশ সিংহ পনোয়ার, এলাভেনিল ভালারিবন। এবারে প্যারিসেও একটুর জন্য হতাশ করলেন যিনি।
পদকের ঝড় তুলে দিয়েছিল ভারত। টোকিও ভারতীয় অলিম্পিকের ইতিহাসে সোনাবাঁধানো জায়গা জুড়ে থাকবে। সাতটি পদক পেয়ে শেষ করেছিল ভারত। সোনায় মুড়ে দেশ বরণ করেছিল নীরজ চোপড়াকে। অথচ নিঃশব্দে দিল্লিতে এসে নেমেছিলেন শ্যুটাররা। একটিও পদক আসেনি।
শ্যুটিং বরাবর ভারতের সোনার খনি। এথেন্স, বেজিং, লন্ডন... পর পর তিন অলিম্পিকে ভারতকে পদকের স্বাদ জুগিয়েছিল বন্দুক। বিজেন্দ্র সিংহ, সুশীল কুমাররা ছিলেন। কিন্তু ভারতের পদক প্রত্যাশা সবচেয়ে বেশি থাকত শ্যুটিং-এ। রিওতে প্রথম ছেদ পড়ে। অভিনব বিন্দ্রা, গগন নারাং, জিতু রাই, গুরপ্রীত সিং, হিনা সিঁধু। কত রথীমহারথীদের নাম! অথচ একটিও পদক এল না ভারতের। রিওতে সব মিলিয়েই ভারতের ফল ছিল ভয়াবহ। পেলে-গ্যারিঞ্জা-নেইমারের শহরে মাত্র দুই পদকেই সন্তুষ্ট থাকতে হয়েছিল পি ভি সিন্ধু, সাক্ষী মালিককে। কিন্তু টোকিওতে সর্বস্তরে ভাল ফল হলেও দুনিয়াটা এলোমেলো হয়ে গিয়েছিল ১৯ বছরের মনু ভাকেরের।
জন্ম হরিয়ানার ঝাঝর জেলার এক গ্রামে। বাবা রামকিষণ ভাকের ইঞ্জিনিয়ার। চাকরি করেন মার্চেন্ট নেভিতে। ছোট থেকেই খেলাধুলোয় উৎসাহ মনুর। অথচ দেশে যেসব খেলায় বেশি ভিড় জমে, তাতে তিনি নেই। টেনিস ভালবাসেন। স্কেটিং করতেও ভালবাসতেন। শেষে বাবা রামকিষাণ কী মনে হতে, মেয়েকে একটি স্পোর্টস রাইফেল উপহার দিয়েছিলেন। এই এক উপহারেই যে মেয়ের বাকি জীবনটা পাল্টে যাবে, এতটা বোধ হয় রামকিষাণ আন্দাজ করতে পারেননি।
পাল্টে গিয়েছিল তাঁর। বেশিদিন লাগেনি। ২০১৭ জুনিয়র এশিয়ান চ্যাম্পিয়নশিপেই রুপো জেতেন তিনি। জাতীয় স্তরে একবার এক প্রতিযোগিতায় ন'খানা সোনার পদক জিতেছিলেন মনু। হারিয়েছিলেন তৎকালীন ভারতবিখ্যাত শ্যুটার হিনা সিঁধুকে। ২০১৬ রিও অলিম্পিকে ভারতের অন্যতম পদক আশা ছিলেন হিনা। তাঁর রেকর্ডও ভেঙে দেন মনু। মেক্সিকোতে আন্তর্জাতিক শ্যুটিং স্পোর্ট ফেডারেশন বিশ্বকাপে মহিলাদের ১০ মিটার এয়ার পিস্তল ইভেন্টে তাবড় তারকা শ্যুটারদের হারিয়ে সোনা নিয়ে দেশে ফেরেন তিনি। তারপরের সাফল্য গোল্ড কোস্ট। সোনার উপকূলে সোনা জিতেছিলেন তিনি।
এশিয়ান গেমস আর কমনওয়েলথ গেমস সাধারণত একই বছরে হয়। কমনওয়েলথ গেমস এপ্রিলে, এশিয়ান গেমস তারপর আগস্ট-সেপ্টেম্বরে। ২০১৮ এশিয়ান গেমসেও অন্যতম পদক প্রত্যাশী ছিলেন মনু। শেষ অবধি ফাইনালে ষষ্ঠ স্থানে শেষ করেন। সোনা জিতেছিলেন তাঁরই সতীর্থ, রাহি স্বর্ণবৎ। বস্তুত, রাহিই প্রথম ভারতীয় মহিলা, যিনি শ্যুটিং-এ এশিয়ান গেমস থেকে সোনা এনেছেন।
কিন্তু মনুর নজর তখন আরও উঁচুতে। টোকিও। বিশ্বের শ্রেষ্ঠ মঞ্চ।
টোকিও অলিম্পিকে মনু ভাকেরের গল্প নিয়ে একটা সিনেমা হয়ে যেতে পারে। পিস্তলটাই কাজ করল না ঠিক করে। কোচ যশপাল রানা বলেছিলেন, 'মনু ভাকের এই প্রজন্মের অন্যতম সেরা প্রতিভা।' অথচ সেই সেরা প্রতিভারই বিচার হল যান্ত্রিক ত্রুটির মাপকাঠিতে। পদকের কাছাকাছিও পৌঁছলেন না মনু। পৌঁছলেন না রাহি, সৌরভ কেউই। চোখের জল মুছে বেরিয়ে যেতে হয়েছিল তাঁকে। তারপরের দুনিয়াটায় ওই জমে থাকা প্রত্যাশার চাপ যেন গিলে খেতে এসেছিল তাঁকে। পিস্তল ধরতেও আতঙ্কে ভুগতেন তিনি। ১৯ বছর বয়সে অলিম্পিকের মত মঞ্চে পদকের সাড়া জাগিয়েও চুরমার হয়ে যেতে হল। অলিম্পিক। শব্দটাই তখন কীরকম বিষিয়ে গিয়েছে তাঁর জন্য। পিস্তলের দুনিয়া থেকেই বেরিয়ে যেতে চাইতেন তিনি। প্রায় এক মাস শ্যুটিং-এর সঙ্গে আর সম্পর্ক রাখেননি তিনি।
ভালবাসা। প্যাশন। এগুলো কখনও দমকে বেড়ে যায়। কখনও স্রোত স্তিমিত হয়ে আসে। তখন দূরত্ব বাড়ে। মনে হয়, এই শেষ। কিন্তু ওই দূরত্বই পরে দূরত্ব কমাতে সাহায্য করে। দূরত্বই বুঝিয়ে দেয়, ভালবাসা কতটা প্রবল। শ্যুটিং রেঞ্জ থেকে দূরে থাকাতেই মনু বুঝতে পারেন, এই রেঞ্জ তাঁর কতটা আপন। কতটা ভালবাসেন এই খেলাকে। আবার শুরু করেন প্রস্তুতি। পুরোদমে। যে শব্দটা তাঁর জীবনে একটা বিভীষিকার মত হয়ে দাঁড়িয়েছিল, ওই শব্দকেই আবার জিতে নিতে চাইলেন তিনি। 'অলিম্পিক'।
আকাশের মুখ ভার প্যারিসে। কলকাতাতেও। তার মাঝেও শ্যাতেরোঁর শ্যুটিং রেঞ্জে নতুন করে ইতিহাসে এক লাইন লিখে এলেন মনু ভাকের। এবারের প্রথম অলিম্পিক পদক। প্রথম মহিলা হিসেবে শ্যুটিং-এ অলিম্পিক পদক। আজ অবধি যা হয়নি একবারও।