শেষ আপডেট: 6th October 2024 12:03
দ্য ওয়াল ব্যুরো: তরুণ মজুমদারের ছবি দাদার কীর্তির কথা মনে পড়ে? দুর্গা সপ্তমীর সন্ধেয় বেঙ্গলি ক্লাবের মেয়েরা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের চিত্রনাট্য উপস্থাপন করছেন। তার পর মহুয়া রায়চৌধুরীর সেই অনবদ্য নাচের দৃশ্য—‘বধূ কোন আলো লাগল চোখে..।’ তবে দাদার কীর্তিতে উৎসব পর্বই মুখ্য নয়। ঘটনাপ্রবাহে ছুঁয়ে যাওয়া মাত্র। নাচ, গান ও কৌতুক ছাড়া তা আলাদা করে দাগ কেটে যায়নি। তরুণ মজুমদারের ভালবাসা ভালবাসা ছবিতেও এসেছিল দুর্গা পুজোর প্রসঙ্গ। ঠিক যেমন পুজো প্রসঙ্গ এসেছিল ইদানিংকালের ছবি ‘দুর্গেশগড়ের গুপ্তধনে’।
কিন্তু এরকম হাজারো ছবির ভিড়ে দুর্গাপুজোয় মন কেড়ে নেওয়া এক ডজন বাংলা ছবির তালিকা রইল ছয় দশক জুড়ে।
উমা (২০১৮): সৃজিত মুখোপাধ্যায়
প্রবাসী বাঙালি সিঙ্গল ফাদার হিমাদ্রীর মেয়ের উমার বড় ইচ্ছে, কলকাতার দুর্গাপুজো দেখবে। কিন্তু দুরারোগ্য অসুখে আক্রান্ত উমার হাতে আর সময় নেই পুজো পর্যন্ত বেঁচে থাকার। তাই সুইজারল্যান্ড থেকে মেয়েকে নিয়ে কলকাতার দুর্গাপুজো দেখাতে আনেন বাবা। পুজো নয়, অকালবোধন। ভরা গ্রীষ্মে আয়োজিত হয় নকল পুজো। উমা এই পরিকল্পনার কথা জানে না, সে তার মতো করেই মেতে ওঠে পুজোয়, আর তাকে ঘিরে মেতে ওঠে গোটা একটা পরিবার, এলাকা, একটা টিম। শহর জুড়ে আলোর মালা গেঁথে দেয় সে টিম, কেবল উমার জন্য। যিশু সেনগুপ্ত ও তাঁর মেয়ে সারা সেনগুপ্তর অভিনয় যেন সত্যি হয়ে ওঠে এই ছবিতে।
বিসর্জন (২০১৭): কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায়
হিন্দু মেয়ে পদ্মার সঙ্গে মুসলিম নাসিরের অনন্য এক প্রেম গড়ে ওঠে দুর্গাপুজোর আবহে। তবে এ প্রেমের মূল সুরই হল ভাসান। নির্মম বিসর্জন। জলে ডুবে যাওয়া মা দুর্গার মুখে ভেসে ওঠে জয়া আহসানের মুখ। সে দৃশ্যকল্প ভোলা যায় না। সিঁদুরমাখা মুখে বিষাদের ছায়ার খেলা ঢাকতে পারে না নাকের বিরাট নথও। এ ছবির মুখ্য চরিত্রে জয়া এবং আবির দুরন্ত অভিনয় করলেও, গণেশ মণ্ডলের চরিত্রে স্বয়ং পরিচালক যেন সবাইকে ছাপিয়ে গিয়েছেন। দুর্গাপুজোও এ ছবির এক চরিত্র হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে যেন।
বেলাশেষে (২০১৫): নন্দিতা রায়, শিবপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়
পুজোর আবহে গড়ে ওঠা নিখাদ পারিবারিক ছবির আসল টুইস্ট হল, বৃদ্ধ বিশ্বনাথ মজুমদারের ডিভোর্স চাওয়া। ৪৯ বছরের দাম্পত্যের শেষে এ কথা বলবেন বলেই দুর্গাপুজোয় সব ছেলেমেয়েদের ডেকে পাঠান তিনি। সবাই একজোট হয়ে হইচই শুরু হলেও, কৌতূহলের পারা চড়তেই থাকে কী বলবেন তাঁদের বাবা! ডিভোর্সের ইচ্ছার কথা জানতে পেরে তো সবার মাথায় হাত। এর পরে কী হয়, তাই নিয়েই ছবি। সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় ও স্বাতীলেখা সেনগুপ্তর অনবদ্য অভিনয় এ ছবির সম্পদ। দু'জনেরই শেষবেলার ছবি এই বেলাশেষে। এ-ছাড়াও ছিলেন ঋতুপর্ণা সেনগুপ্ত, অপরাজিতা আঢ্য, খরাজ মুখোপাধ্যায়, মনামী ঘোষ।
দশমী (২০১২): সুমন মৈত্র
পুজোর পাঁচদিনে কীভাবে বদলে যায় দুই বন্ধুর জীবন, তাই নিয়েই ছবির গল্প। তুলি আর অভির ছোট্টবেলার বন্ধুত্ব থেকে বড়বেলার প্রেম, দ্বন্দ্ব, সমস্যা-- এর সবই ধরা পড়ে উত্তর কলকাতার দুর্গাপুজোর আবহে। কোয়েল মল্লিক, ইন্দ্রনীল সেনগুপ্ত, পীযূষ গঙ্গোপাধ্যায়, লকেট চট্টোপাধ্যায়ের এই ছবি আজও বহু বাঙালির নস্টালজিয়া।
অন্তরমহল (২০০৫): ঋতুপর্ণ ঘোষ
জমিদার ভুবনেশ্বর চৌধুরীর প্রথমা স্ত্রী মহামায়া সন্তানের জন্ম দিতে পারেননি। তাই ভুবনেশ্বর দ্বিতীয়বার বিয়ে করেন যশোমতীকে। এই অবস্থায় চলে আসে দুর্গাপুজোর মরশুম। বাড়িতে শুরু হয় পুজো। মূর্তি গড়তে আসেন কুমোর। জমিদার বাড়িতে শর্ত ছিল, মায়ের মুখ গড়তে হবে কুইন ভিক্টোরিয়ার আদলে। কারণ ব্রিটিশদের তুষ্ট করাই ছিল ভুবনেশ্বরের উদ্দেশ্য। কিন্তু কুমোর অভিষেক বচ্চন প্রতিমা বানানো শেষ করার পরে চমকে যান সকলে। যশোমতীর ভূমিকায় সোহা আলি খানকে দারুণ মানিয়েছিল। দুর্গাপুজো ও প্রাচীন বাংলার সংস্কারের প্রেক্ষাপটে প্রেম-পরকীয়া নিয়ে জমে ওঠে এ ছবি! রূপা গঙ্গোপাধ্যায় ও জ্যাকি শ্রফের অভিনয় ছিল উপরি পাওনা।
দেবীপক্ষ (২০০৪): রাজা সেন
পুজোর পটভূমিকায় এক ধর্ষিত মেয়ের গল্প বলার সাহস দেখান পরিচালক। কারণ দুর্গাপুজো মানে তো কেবলই আনন্দ ও মিলনের উৎসব নয়। শুভ-অশুভের লড়াইয়ের শেষে দুষ্টের বিনাশ করে বিজয়ী হন মা দুর্গা। এই ছবিতেও শাস্তি হয় দোষীদের। দুর্গা ও অসুরের লড়াইকেই বাস্তবের আঙ্গিকে ব্যবহার করেছেন পরিচালক। ঋতুপর্ণা সেনগুপ্তর এ ছবিতে শতাব্দী রায় ও কোয়েল মল্লিকও দারুণ অভিনয়ের ছাপ রেখেছিলেন।
উৎসব (২০০০): ঋতুপর্ণ ঘোষ
দুর্গাপুজোকে কেন্দ্র করে পারিবারিক মিলনই এ ছবির মূল কাহিনি। দেশের বাড়িতে মায়ের কাছে আসে ছেলেমেয়েরা। ক'টা দিন আনন্দ করে আবার সকলের বাইরে ফিরে যাওয়া। কিন্তু এই পুজোর ক'টা দিনেও সম্পর্কের চোরাস্রোত থেমে থাকে না। বন্ধ দরজার ওপারে টানাপড়েন চলতেই থাকে। প্রেম-অপ্রেমের দ্বন্দ্বে উৎসবের ছায়ায় মিশে যায় গোপন স্পর্শ। প্রেম বয়ে যায় প্রজন্মে। আবার অন্যদিকে, মায়ের বাড়িকে প্রোমোটারের হাতে তুলে দেওয়ার জল্পনাও ঘনায়। প্রসেনজিৎ ও ঋতুপর্ণার দুরন্ত অভিনয়ের পাশাপাশি মাধবী মুখোপাধ্যায়, মমতা শঙ্কর, দীপঙ্কর দের অভিনয়ও প্রশংসিত হয়।
হিরের আংটি (১৯৯২): ঋতুপর্ণ ঘোষ
ঋতুপর্ণ ঘোষের প্রথম ছবি এই হিরের আংটি। শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের লেখা উপন্যাস নিয়ে তৈরি। দুর্গাপুজোর প্রেক্ষিতে ও পরিচালকের মুন্সিয়ানায় এই ছবির হাত ধরে গ্রামের পুজো এবং পারিবারিক মিলনোৎসব ঢুকে পড়ে দর্শকদের ড্রয়িংরুমে। রতনলালবাবুর বাড়ির পুজোর উৎসবের জাঁকজমকের পাশাপাশিই দানা বাঁধে টানটান এক রহস্য। পুজোর বাড়িতে উপস্থিত হয় গন্ধর্বকুমার। বাড়ির পৈতৃক সম্পত্তির উত্তরাধিকারী বলে দাবি করা সে গন্ধর্বকুমারের আসল পরিচয়ের মুখোশ খোলে শেষে গিয়ে। জানা যায় হিরের আংটির মাহাত্ম্য। বসন্ত চৌধুরি, মুনমুন সেন ও অয়ন বন্দ্যোপাধ্যায়ের এই ছবি আজও ছোট থেকে বড় সকলের প্রিয়।
জয় বাবা ফেলুনাথ (১৯৭৯): সত্যজিৎ রায়
ঠাকুরদালানে প্রতিমা গড়ছেন বৃদ্ধ শশী পটুয়া, ফেলুদা জিজ্ঞেস করছেন, ষষ্ঠীর আগে কাজ শেষ হবে কিনা। এ দৃশ্য জয় বাবা ফেলুনাথ সিনেমার পর্দা পেরিয়ে দেশ-কালের বেড়া টপকে চিরন্তন হয়ে উঠেছে প্রতি বছরের দুর্গাপুজোয়। কাশীর ঘোষালবাড়ির এই দুর্গাপুজোর পটভূমিতেই এগোয় সিনেমা। বাড়ির সবচেয়ে ছোট সদস্য রুক্মিণীকুমার ওরফে রুকুককে দুর্গাপুজোর পৌরাণিক কাহিনিও সহজ করে শোনান শশীবাবু। দর্শকরাও মজেন সেই কাহিনিতে। পাশাপাশি এগোয় গোয়েন্দাগিরি। তাতেও জুড়ে যায় দুর্গা প্রতিমা।
অ্যান্টনি ফিরিঙ্গি (১৯৬৭): সুনীল বন্দ্যোপাধ্যায়
বাংলা গান ও বাংলার সংস্কৃতিকে ভালবেসে ফেলা পর্তুগিজ সাহেব অ্যান্টনি হেন্সম্যানের কবিগান ছিল এ ছবির মূল বিষয়। বাংলার কবিয়ালদের চোখে শত্রু হয়ে উঠলেও, হার মানতে চাননি অ্যান্টনি। শুধু তাই নয়, বাংলাকে ভালবেসে, বাঙালির প্রেমে পড়ে, সে প্রেমের মন রাখতে দুর্গাপুজোর আয়োজন করেছিলেন সেই সাহেব। বিধর্মী সাহেবের পুজো নিয়ে সমাজে তোলপাড় পড়ে যায়। অ্যানেটনি উত্তমকুমারের অভিনয় আজও মনে রেখেছেন দর্শকরা। যোগ্য সঙ্গত করেছিলেন তনুজাও।
দেবী (১৯৬০): সত্যজিৎ রায়
পথের পাঁচালি মুক্তি পাওয়ার পাঁচ বছরের মধ্যেই প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়ের ‘দেবী’ কাহিনি অবলম্বনে ‘দেবী’ ছবিটি বানিয়েছিলেন সত্যজিৎ রায়। সত্যজিৎকে এই ছবির জন্য অনেক সমালোচনার মধ্যে পড়তে হয়েছিল। কারণ অত বছর আগে রক্তমাংসের মানুষকে 'দেবী' বলে মেনে নিতে অস্বস্তি হয়েছে অনেকেরই। শ্বশুর কালীকিঙ্কর স্বপ্নে তাঁর ছোট বৌমা দয়াময়ীকে দেবীরূপে দেখেছিলেন। এর পরেই পুত্রবধূর পুজো শুরু হয় অন্ধবিশ্বাসে। সেই ভুলের জেরেই ক্রমশ ছারখার হতে থাকে সব। ছবিতে ধুমধাম করে দুর্গোৎসব দেখানো হয়। দেবী রূপে শর্মিলা ঠাকুরের দুর্দান্ত অভিনয়ের পাশাপাশি এ ছবির সম্পদ ছিল ছবি বিশ্বাস, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, অনিল চট্টোপাধ্যায়, করুণা বন্দ্যোপাধ্যায়দের অভিনয়।
পথের পাঁচালী (১৯৫৫): সত্যজিৎ রায়
বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের উপন্যাস অবলম্বনে পরিচালক সত্যজিৎ রায়ের প্রথম ছবি ছিল ‘পথের পাঁচালী’। এই গল্পে খুব স্বাভাবিক ভাবে এসেছিল পুজো পর্ব। সে সময়ে গ্রামবাংলার দুর্গা পুজো কেমন ছিল সম্ভবত সেই প্রথম দেখা যায় পর্দায়। আর পুজোকে কেন্দ্র মন ছুঁয়ে যাওয়া কিছু দৃশ্য। যা বাঙালি মননে বড় ছাপ ফেলে গেছিল। আজও যা প্রাসঙ্গিক। নিশ্চিন্দপুর গ্রামের দুটি ছেলেমেয়ে অপু আর দুর্গার চোখ দিয়ে পুজোকে দেখেছিলেন সত্যজিৎ রায়। পুজোয় ঘরের মানুষের বাড়িতে ফেরার প্রতীক্ষার প্রহর যে কেমন তাও দেখা গেছিল সেই ছবিতে। সত্যজিৎ রায় দেখিয়েছিলেন, পুজোয় ধনী গরিবের ফারাক সাময়িক ভাবে কীভাবে মুছে যায়। পথের পাঁচালিতে শরতের ছবি আজও কিংবদন্তী। রেল লাইনের ধারে দিগন্ত জুড়ে কাশবন। আর তার মধ্যে দিয়ে ছুটে যাচ্ছে অপু-দুর্গা।