Latest News

এত ভয় কীসে মোদীজি? চৌকিদার চোর হ্যায়!

অমল সরকার

গত সাড়ে তিন দশকে এ দেশে রাজনীতিতে (Indian Politics) যে সব স্লোগান লোক মুখে ভাইরাল হয়েছে সেগুলির অন্যতম হল ‘গলি গলি মে শোর হ্যায়, রাজীব গান্ধী চোর হ্যায়।’বিষয় ছিল, বোফর্স কামান কেলেঙ্কারি (Bofors Scandal)। অভিযোগ ছিল, সুইডিস কোম্পানি এবি বোফর্সের কাছ থেকে কামান কেনায় ঘুষ নিয়েছেন অস্ত্রদালাল থেকে আমলা, রাজনীতিকেরা এবং তারা প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধীর কাছের মানুষ। আরও অভিযোগ করা হয়েছিল অস্ত্র দালাল ইতালিয় নাগরিক অট্টাভিও কত্রোচ্চি রাজীব পত্নী সনিয়ার ঘনিষ্ঠ।

Image - এত ভয় কীসে মোদীজি? চৌকিদার চোর হ্যায়!

‘গলি গলি মে…’ স্লোগানটির কপিরাইটের দাবিদারদের একটি দল বিজেপি। অস্ত্র কেনাকাটায় অনিয়ম এবং স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে অভিযোগ মাত্র সাত বছর বয়সি বিজেপিকে তুমুল শক্তি জুগিয়েছিল, ঘুঁচেছিল তাদের রাজনীতিকে একঘরে থাকা দশা। বাম-জনতা-বিজেপি জোট রাজীব গান্ধীকে ক্ষমতাচ্যূত করেছিল ১৯৮৯-র লোকসভা ভোটে। এ দেশে সরাসরি দুর্নীতির ইস্যুতে ভোট এবং সরকারের পতন সেই প্রথম।

রাজীবকে হটিয়ে প্রধানমন্ত্রী হওয়া বিশ্বনাথ প্রতাপ সিংয়ের মুখে শুনেছি জনমনে বোফর্স কেলেঙ্কারি কেমন প্রভাব ফেলেছিল। সেই নির্বাচনে নিজের রাজ্য উত্তরপ্রদেশে প্রচারের সময় একদিন ময়দান লাগোয়া ডাকঘরটি বন্ধ দেখে বিশ্বনাথ প্রতাপ জনতার উদ্দেশে জানতে চান, ভরদুপুরে পোস্ট অফিস বন্ধ কেন? জনতার জবাব ছিল ‘বোফর্স হো গয়া, বোফর্স হো গয়া।’ ডাকঘরের কর্তার বিরুদ্ধে স্বল্প সঞ্চয় প্রকল্পের টাকা মেরে দেওয়ার অভিযোগে তদন্ত চলছিল তখন। সেই সব দিনে মানুষ অনিয়ম, দুর্নীতিকে বোফর্স কেলেঙ্কারির সঙ্গে এক করে দেখত।

সেই বোফর্স কেলেঙ্কারিতে রাজীব গান্ধী দূরে থাক, তাঁর পরিবার এবং লতায়পাতায় সম্পর্কিত কারও বিরুদ্ধেও ঘুষ নেওয়ার অভিযোগ প্রমাণিত হয়নি। ২০০৫-এ প্রয়াত প্রধানমন্ত্রীকে ক্লিনচিট দিয়েছে সিবিআই।

এর চাইতেও আজকের ভারতে রাজীবের যে ভূমিকাটি আলোচনায় আসা উচিত তা হল, বোফর্স কেলেঙ্কারির সত্যান্বেষণে তাঁর ভূমিকা। সুইডিস রেডিও কেলেঙ্কারির কথা ফাঁস করেছিল ১৯৮৭-র ১৬ এপ্রিল। রাজীব বিরোধীদের দাবি মেনে সংসদের যৌথ তদন্ত কমিটি গঠন করেছিলেন সে বছরের অগাস্টে।

বোফর্স কামান। ফাইল চিত্র

রাজীব এবং আজকের নরেন্দ্র মোদীর (Narendra Modi) সরকারের মধ্য মিল একটিই। দু’জনেই সংসদে চূড়ান্ত সংখ্যাগরিষ্ঠতার অধিকারী। লোকসভায় ৫৪৩ আসনের মধ্যে কংগ্রেসের ঝুলিতে ছিল ৪১৪। বিজেপির ৩০৩-সহ মোদীর এনডিএ-র হাতে আছে ৩২৯ আসন। খুব কম প্রধানমন্ত্রীই এমন সংখ্যাগরিষ্ঠতা ভোগ করেছেন।

তবু মুখে রা কাড়ছেন না নরেন্দ্র মোদী। বিরোধীদেরও মুখ খুলতে দিতে রাজি নন তিনি। রাজ্যসভায় চেয়ারম্যান জগদীপ ধনকড়, লোকসভায় স্পিকার ওম বিড়লারা যেন সরকার ও শাসক দলের গোলকিপার। সরকারের জালে কিছুতেই বিরোধীদের বল ঠেলতে দিতে রাজি নন তাঁরা। জগদীপ ধনকড়ের চাটুকারিতা অজানা নয়। ফের সাংবিধানিক পদে বসে তিনি যেন নিজেকে নতুন করে চেনাতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন। বিচারপতি নিয়োগ বিতর্কে একদিকে তিনি সুপ্রিম কোর্টের মুণ্ডপাত করে সংসদের অধিকার ফলাতে ব্যস্ত, অন্যদিকে, আদানি ইস্যুতে আলোচনার সুযোগ না দিয়ে রাজ্যসভায় সদস্যদের অধিকারে কবর খুঁড়ছেন।

আসন্ন জি-২০ সম্মেলনে নরেন্দ্র মোদীর ঘনিষ্ঠ যে সব শিল্পপতিকে দেশের মুখ আলো করতে বিশ্ব দরবারে পেশ করার পরিকল্পনা রয়েছে গৌতম আদানি তাঁদের অন্যতম। সেই আদানি গ্রুপের বিরুদ্ধে মার্কিন গবেষণা সংস্থা হিন্ডেনবার্গের অভিযোগ ঘিরে গোটা বিশ্বে ইতিমধ্যেই ভারতের মুখ পুড়েছে।

রাজীব গান্ধী ও তাঁর পরিবারের বিরুদ্ধে বোফর্স কামান কেলেঙ্কারিতে নাম জড়িয়ে যে অভিযোগ তোলা হয়েছিল তা ছিল অনেকটা পেলের নারকেলকে বল বানিয়ে ফুটবল খেলার মতো। অর্থাৎ যা আমরা চোখে দেখিনি, রচনা বইয়ে পড়েছি।

বোফর্স কেলেঙ্কারিতে অভিযুক্ত ইতালিয় ব্যবসায়ী অট্টাভিও কত্রোচ্চির সঙ্গে রাজীব, সনিয়াদের প্রকাশ্য বা গোপন কোনও সম্পর্কই কখনও সামনে আসেনি। পুরোটাই ছিল অভিযোগ, যা থেকে নিজেকে কলঙ্কমুক্ত করতে প্রয়াত প্রধানমন্ত্রী সংসদের যৌথ কমিটিকে দিয়ে তদন্ত করিয়েছিলেন।

অন্যদিকে, আদানি ও মোদীর সম্পর্ক গোটা দেশ জানে। গুজরাতের বাইরে আম ভারতীয় নরেন্দ্র মোদী ও গৌতম আদানিকে বলতে গেলে একই সঙ্গে চিনেছে। আদানিদের প্লেনে চেপেই ২০১৩-র গোড়ায় গুজরাতের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী ভারত বিজয়ের রাজনৈতিক সফর শুরু করেছিলেন। এমনকী, প্রধানমন্ত্রী হিসাবে শপথ নিয়ে আমদাবাদ-দিল্লি আকাশ পথ পাড়ি দিয়েছিলেন এই শিল্পপতির বিমানেই। আর বিগত নয় বছরে আমরা দেখেছি কীভাবে রাজনীতিতে নরেন্দ্র মোদী এবং দেশের শিল্প সাম্রাজ্যে গৌতম আদানির উদয় হয়েছে।

সেই আদানি এখন মোদীর বোঝা। আর মোদী বোঝা তাঁর দলের। গুজরাত দাঙ্গা নিয়ে বিবিসি-র যে তথ্যচিত্র নিয়ে অস্বস্তি এড়াতে ভারত সরকার সেটি প্রদর্শনের উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে, সেই রক্তপাতের ঘটনা মোদীর ক্ষমাহীন অপরাধ। সুপ্রিম কোর্ট ক্লিনচিট দিয়েছে বলেই তিনি গোধরায় করসেবকবাহী ট্রেনে আগুন এবং বদলার দাঙ্গার দায় অস্বীকার করতে পারবেন না। কারণ, প্রশাসকের রাজধর্ম পালনে ব্যর্থতার দায় আদালতের বিচারের আওতায় পড়ে না। তার বিচার করার দায় জনতার আদালতের। ভোটের ফল হাজির করে দাবি করাই যায় জনতাও তাঁকে ক্লিনচিট দিয়েছে। কিন্তু ১৯৪৬-এ বাংলায়, ২০০২-এ গুজরাতে দাঙ্গার নামে নরসংহারের ঘটনা চাপা দেওয়া কঠিন। হোসেন শহীদ সোহ্‌রাওয়ার্দী আর নরেন্দ্র মোদীর নাম একই সঙ্গে উচ্চারিত হবে।

মোদীর এই ভাবমূর্তিকে অস্ত্র করেই ২০১৪-য় দিল্লিতে ক্ষমতায় ফেরে বিজেপি, ২০১৯-এ তা দখলে রাখে। ১৭টি রাজ্যে একক শক্তিতে বিজেপির সরকার গঠনের পিছনেও আছে মোদীর ক্যারিসমা। এমন নেতার গায়ে কালি লাগলে তা আড়াল করার দায় দলের উপর বর্তায়।

কিন্তু রাজ্যসভায় চেয়ারম্যান ধনকড় এবং লোকসভায় স্পিকার ওম বিড়লা এই কাজে যতটা তৎপর, বিজেপির মন্ত্রী-সাংসদেরা ততটা সরব বলে মনে হচ্ছে না। অতীতে গোটা বিজেপি পরিবারকে যেভাবে প্রধানমন্ত্রীর পাশে দাঁড়িয়ে সরব হতে দেখা গিয়েছে, এবার সেই প্রতিরোধ লক্ষ্য করা যাচ্ছে না। হতে পারে সংসদে বিরোধীদের নগন্য শক্তিকে উপেক্ষা করাই গেরুয়া শিবিরের কৌশল। আর এটাও তো সত্যি, সংসদে নানা ইস্যুতে বিরোধীরা জোট বাঁধে, যৌথ বৈঠকে কৌশল ঠিক হয়, আবার রাত পেরনোর আগে বোঝাপড়ায় ফাটল ধরে যায়। সংসদের বাইরে বিরোধীদের বোঝাপড়া ঐক্যবদ্ধ লড়াই বলতে গান্ধী মূর্তির পাদদেশে অবস্থান বিক্ষোভে বসে খাবার ভাগ করে ব্রেকফাস্ট, লাঞ্চ করা। ফলে এই বিরোধীদের গুরুত্ব না দেওয়াও অস্বাভাবিক কিছু নয়।

তাতে অবশ্য এই সত্য চাপা থাকছে না যে বিবিসির তথ্যচিত্র এবং আদানিদের কেলেঙ্কারি বিজেপির সম্পদকেই বোঝা করে তুলেছে। আর তাতেই চুপসে গিয়েছে ৫৬ ইঞ্চি চওড়া বুক।

আদানিদের সংস্থায় এসবিআই এবং এলআইসির বিপুল বিনিয়োগের পিছনে অর্থনীতি ছাপিয়ে রাজনীতি কতটা, এ প্রশ্নের জবাব পাওয়া জরুরি। শেয়ারের দরে আদানিদের জালিয়াতির ঘটনা মার্কিন সংস্থার গবেষণায় ধরা পড়ল। কী করছিল ভারতের শেয়ার বাজার নিয়ামক সংস্থা সেবি?

আদানি, আম্বানিরা মোদীর শোপিস, যাঁদের শিল্প-সাম্রাজ্যের সুবাদে ভারতকে বিশ্বের পঞ্চম বৃহৎ অর্থনীতি হিসাবে গড়ে তোলার কৃতিত্ব দাবি করে আসছে বিজেপি। অন্যদিকে, বিশ্ব ধনপতির তালিকায় তাদের স্থান হওয়ার পিছনে মোদী সরকারের ভূমিকা নিয়ে বারে বারেই প্রশ্ন উঠেছে। ‘নির্ভীক’ নরেন্দ্র মোদীর তদন্তের মুখোমুখি হতে তাই কি এত ভয়?

মোদীকে সম্ভবত তাড়া করে বেড়াচ্ছে বোফর্সের ভূত। জেপিসি বা সংসদের যৌথ তদন্ত কমিটির সদস্য ঠিক হয় দলগুলির প্রতিনিধিত্বের অনুপাতে। বোফর্স কেলেঙ্কারির তদন্তে গঠিত জেপিসি-র চেয়ারম্যান কংগ্রেস নেতা বি শঙ্করানন্দ কমিটিতে দলের সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে রিপোর্টে রাজীব গান্ধীকে নির্দোষ বলেছিলেন। ডিসেন্ট বা আপত্তি নথিভুক্ত করেছিলেন এআইএডিএমকে সাংসদ অলাদি অরুণা। জেপিসি-র সেই ক্লিনচিট রাজীবকে রক্ষা করতে পারেনি। লোকসভা ভোটে পতন হয় তাঁর সরকারের। কংগ্রেসের আসন ৪১৪ থেকে ১৯৭-এ নেমে যায়।

তারপর আরও পাঁচটি জেপিসি হয়েছে এদেশে। শেয়ার দালাল হর্ষদ মেহেতার দাবি করেছিলেন প্রধানমন্ত্রী নরসিংহ রাওকে নিজের হাতে টাকা বোঝাই অ্যাটাচি দিয়েছেন। সেই অভিযোগ নিয়ে সংখ্যালঘু রাও সরকারের তৈরি জেপিসি মূল অভিযোগটি না মানলেও বেশ কিছু সুপারিশ করেছিল। পরের নির্বাচনেই দেশবাসী কংগ্রেস সরকারকে বিদায় জানায়।

ইউপিএ জমানায় মোবাইলের টুজি স্প্রেকট্রাম বণ্টন এবং ভিভিআইপি হেলিকপ্টার কেনাতে অনিয়মের অভিযোগ নিয়ে তদন্তে গঠিত জেপিসি-র রিপোর্টের পরিণতি সকলের জানা। কংগ্রেসের চেয়ারম্যানেরা নানাভাবে অপকর্ম আড়ালের চেষ্টা করলেও জনতার মার থেকে সরকারকে রক্ষা করতে পারেনি। ২০১৪-র ভোটে কংগ্রেসের নেতৃত্বাধীন ইউপিএ-র হার ছিল দুর্নীতির দায়ে সরকার পতনের দ্বিতীয় নজির।

আদানিদের শেয়ার মূল্য জালিয়াতির জেরে ওই সংস্থায় এলআইসি এবং স্টেট ব্যাঙ্কের বিপুল বিনিয়োগের ভবিষ্যৎ নিয়ে শঙ্কা তৈরি হয়েছে। দেশবাসীর স্বার্থেই তাই সংসদীয় কমিটি কিংবা সুপ্রিম কোর্টের নজরদারিতে বিশদ তদন্ত হওয়া দরকার। তাতে কান টানলে মাথা আসার মতো আদানিদের সঙ্গে মোদীর নামও জুড়ে যাওয়ার শঙ্কাতেই কি তদন্ত এড়াচ্ছে সরকার? রাহুল গান্ধী বলতেই পারেন, ‘চৌকিদার চোর হ্যায়’ ঘোর বাস্তব। সেই স্লোগান, ‘…..রাজীব গান্ধী চোর হ্যায়’ মিথ্যা প্রমাণ করেছে তদন্ত। তদন্তে এত ভয় কীসে মোদীজি!

মোদীর বিশ্রী দিন

You might also like