
অমল সরকার
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়-সহ বিরোধী শিবিরের আট নেতা গত রবিবার প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীকে (Narendra Modi) চিঠি লিখে আপ নেতা মণীশ সিসোদিয়ার গ্রেফতারির প্রতিবাদ জানিয়েছেন। একই বিষয়ে আলাদা করে প্রধানমন্ত্রীকে চিঠি দিয়েছেন তামিলনাড়ু ও কেরলের মুখ্যমন্ত্রীরা।

সেই চিঠিতে কোনও কংগ্রেস নেতার সই নেই। কারণ, কংগ্রেসকে বলা হয়নি। বললেও কংগ্রেসের কেউ তাতে সই করতেন না। কারণ, বিরোধী শিবিরে একমাত্র কংগ্রেস আম আদমি পার্টির বিরুদ্ধে কেন্দ্রের বিজেপি সরকারের পদক্ষেপকে খোলাখুলি সমর্থন জানিয়েছে।
গত শুক্র ও শনিবার সিবিআই ও ইডির নিশানায় ছিল লালুপ্রসাদ যাদবেব পরিবার ও পার্টি। রাষ্ট্রীয় জনতা দল প্রধান ছাড়াও তাঁর স্ত্রী, পুত্র ও বিবাহিত কন্যাদের শ্বশুরবাড়িতে পর্যন্ত অভিযান চালিয়েছে দুই কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা। লালু প্রসাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ, রেলমন্ত্রী থাকাকালে চাকরি দেওয়ার বিনিময়ে তিনি ও তাঁর পরিবার চাকরিপ্রার্থীদের কাছ থেকে জমি-জায়গা লিখিয়ে নিয়েছেন। ইডির দাবি, নয়ছয়ের অঙ্ক প্রায় ছ’শো কোটি টাকা।
লালুপ্রসাদের পরিবারে ইডি-সিবিআইয়ের হানাদারিকে কংগ্রেস সভাপতি মল্লিকার্জুন খাড়্গে প্রতিহিংসার রাজনীতি বলে উল্লেখ করেছেন। বলেছেন, ইডি-সিবিআই দিয়ে বিরোধীদের কণ্ঠরোধ করছে মোদী সরকার।
খাড়্গের দু’দিন আগে বলা কথাগুলিই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়দের প্রধানমন্ত্রীকে লেখা এক সপ্তাহ আগের চিঠির ছত্রে ছত্রে আছে। তাঁরা নাম করে করে দেখিয়েছেন শুভেন্দু অধিকারী, মুকুল রায়দের মতো বিরোধী দলের কোন কোন নেতা বিজেপিতে যোগ দেওয়ার পর তাঁদের বিরুদ্ধে চলা দুর্নীতির তদন্ত থামিয়ে দিয়েছে ইডি-সিবিআই।
সেই ইডি-সিবিআই যখন আপ নেতা সিসোদিয়া এবং তেলেঙ্গানার মুখ্যমন্ত্রী কে চন্দ্রশেখর রাওয়ের কন্যা কে কবিতার বিরুদ্ধে তদন্তে সক্রিয় কংগ্রেস তখন চুপ। অন্যদিকে, লালুপ্রসাদের পরিবার ও পার্টির বিরুদ্ধে অভিযান নিয়ে রা কাড়ছে না বিরোধী শিবিরের অ-কংগ্রেসি নেতারা।
সিসোদিয়া, কবিতা, লালুপ্রসাদদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গুরুতর। দুর্নীতির সঙ্গে আপোস চলে না। স্বাধীনতা দিবসে লালকেল্লা থেকে প্রধানমন্ত্রী মোদী দেশকে দুর্নীতি মুক্ত করার সংকল্প ঘোষণা করেছেন। যদিও জলের মতো পরিস্কার, দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াইয়ের নামে এমন ‘আমরা-ওরা’-র কূ-রাজনীতির কোনও নজির দেশে নেই।
লালুপ্রসাদের দল ও পরিবারে ইডি-সিবিআইয়ের হানাদারির সঙ্গে বিহারে বিজেপির রাজনৈতিক স্বার্থ রক্ষার বিষয়টি এখন আর গোপন নেই। এই মামলার সূত্রপাত হয়েছিল ২০১৭-র গোড়ায় যখন বিহারে ক্ষমতায় ছিল লালুপ্রসাদের রাষ্ট্রীয় জনতা দল ও নীতীশ কুমারের জনতা দল ইউনাইটেডের জোট সরকার। কয়েক মাস পরেই সেই তদন্ত থেমে যায় নীতীশ কুমার ফের বিজেপির সঙ্গে বন্ধুত্ব পাতিয়ে সরকার গড়ার পর। প্রমাণের অভাবে মামলাটিও গুটিয়ে ফেলা হয়েছিল।
সেই থমকে যাওয়া তদন্ত ফের শুরু হয় গত বছরের মাঝামাঝি সময়ে নীতীশ কুমার আবার লালুপ্রসাদের হাত ধরার পর। গেরুয়া শিবির বুঝতে পারছে, ২০২৪-এ এই জোট তাদের কাছে কতটা বিপদের কারণ হতে পারে। বিজেপি জানে লালুপ্রসাদ সহজে বশ্যতা মানবেন না। কিন্তু দুর্নীতির ইস্যুতে বিহারের শাসক মহাজোটে ফাটল ধরানো অসম্ভব নয়। লালুপ্রসাদের হাত ধরায় নীতীশ কুমারের পার্টি ক্রমশ ভাঙছে।
ইডি, সিবিআই, আয়করের মতো কেন্দ্রীয় এজেন্সিকে বিরোধীদের বিরুদ্ধে ব্যবহারের অভিযোগ নতুন নয়। দুর্নীতিতে অভিযুক্ত নেতার সাতখুন মাফ হওয়ার নজিরও অতীতে অনেক আছে। ইউপিএ জমানায় রাজ্যসভার বিরোধী নেতা বিজেপির অরুণ জেটলি প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংকে চিঠি লিখে যথার্থ অভিযোগ করেছিলেন, ইউপিএ মন্ত্রিসভায় জায়গা পেতেই মুলায়ম সিং যাদবের বিরুদ্ধে তদন্ত থামিয়ে দিয়েছে সিবিআই। দিল্লির পালা বদলের পর ছবিটা কেমন দাঁড়িয়েছে?
বিষয়টি বোঝাতে একটু পুরনো পরিসংখ্যান তুলে ধরছি। ২০১৪-তে মোদী সরকার ক্ষমতাসীন হওয়ার পর থেকে ২০২১-এর ডিসেম্বর পর্যন্ত সাত বছরে বিরোধী দল এবং সরকারের সমালোচক মিলিয়ে ৫৭০ জনকে নিশানা করে কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থাগুলি। একই সময়ে বিজেপি-সহ এনডিএ শরিক নেতাদের মাত্র ৩৯ জনের বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু করে তারা।
সেখানে দ্বিতীয় ইউপিএ সরকারের পাঁচ বছরে বিরোধী শিবিরের ৮৫ জনের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগে মামলা ঠুকেছিল মনমোহন সরকার। অর্থাৎ মননোহন সরকারে তুলনায় মোদী সরকারের জমানায় বিরোধীদের নিশানা করার হার ৩৪০ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। স্বভাবতই দুর্নীতি বিরোধী অভিযানের নামে রাজনৈতিক প্রতিহিংসা চরিতার্থ করার অভিযোগটি ফুৎকারে উড়িয়ে দেওয়ার অবকাশ নেই।
এ নিয়ে বিরোধীরা যতই চিল চিৎকার করুক, নরেন্দ্র মোদী দমবার পাত্র নন। তাঁর আসল উদ্দেশ্য করাপশনের বিরুদ্ধে ধর্মযোদ্ধা সেজে কমিউনাল পলিটিক্সকে দেশের ডিএনএ-র মধ্যে ঢুকিয়ে দেওয়া। যে কাজে তিনি অনেকটাই সফল। সাম্প্রদায়িক রাজনীতি দেশকে গ্রাস করলে দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াই দুর্বল হতে বাধ্য। রাম মন্দির তো আছেই, মোদীর লক্ষ্য, জি-২০-র মঞ্চকে ব্যবহার করে ‘বিশ্বগুরু’ এবং বিরোধীদের দুর্নীতির বিরুদ্ধে ‘অবতার’ সেজে ২০২৪-এর ভোটে নিজেকে হাজির করা।
আশ্চর্যের বিষয় হল, এমন জটিল পরিস্থিতিতে বিরোধী দলগুলি রাজনৈতিক অস্পৃশ্যতার রোগে আচ্ছন্ন। সবাই বিপন্ন বুঝেও একে অপরের কাঁধে হাত রাখতে দ্বিধান্বিত তারা। একদিকে, বিরোধী শিবিরের একাংশ নরেন্দ্র মোদীর ধ্বংসাত্বক রাজনীতি মোকাবিলার থেকেও কংগ্রেস বিরোধী মঞ্চ গড়তে বেশি তৎপর। অন্যদিকে, কংগ্রেস মনে করছে, রাহুল গান্ধীর নেতৃত্বে সফল ভারত জোড়ো যাত্রার পর বাকি বিরোধীদের দায়িত্ব তাদের হাতে হাত রাখা।
৪৫-৫০ বছর আগে ইন্দিরা গান্ধীর স্বৈরাচারী শাসনের মুখেও গোড়ায় বিরোধীরা এমনই দ্বিধাবিভক্ত ছিল। তখন গণতন্ত্রের বিপন্নতাই ছিল সবচেয়ে বড় বিপদ। আজ অঘোষিত জরুরি অবস্থায় তা আরও বেশি বিপন্ন। সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ধর্মনিরপেক্ষতা, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি, ব্যক্তি স্বাধীনতার বিপন্নতা। চার-সাড়ে চার দশক আগে জয়প্রকাশ নারায়ণ ছিলেন, যিনি গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের ডাক দিয়ে শর্তহীনতার শর্তে বিরোধীদের এক ছাতার তলায় আনতে পেরেছিলেন। সেই বিরোধীদের মধ্যে আজকের বিজেপি ছিল পুরনো দল ভারতীয় জনসংঘ পরিচয় নিয়ে। এজন্য জেপিকে শুরুতেই ঘনিষ্ঠদের সমালোচনার মুখে পড়তে হয়েছিল। অনুগামীদের কেউ কেউ সাবধান করেছিলেন, মুক্তমঞ্চের সুযোগ নিয়ে আরএসএস বিরোধী পরিসরে জায়গা করে নেবে।
সেই জেপির কথাতেই, ১৯৭৭-এর লোকসভা নির্বাচনে জনসংঘ তাদের কট্টর হিন্দুত্বপন্থী মতাদর্শকে তাই প্রচারে প্রাধান্য দেয়নি। জনতা পার্টির সদস্যপদের যে কাগজে সবাইকেই সই করতে হয়েছিল, তাতে লেখা ছিল, ‘আমি মহাত্মা গান্ধীর মূল্যবোধ ও আদর্শে সম্পূর্ণ বিশ্বাসী এবং একটি সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য নিজেকে উৎসর্গ করব।’ বাজপেয়ী, আদবানিরা মেনে নিয়েছিলেন জেপির কথা। বিদায় নিয়েছিল ইন্দিরার সরকার।
আরএসএস, জনসংঘকে সঙ্গে নেওয়ার ব্যাখ্যা হিসাবে জেপি বলেছিলেন, আমি বিশ্বাস করেছিলাম, বিরোধী রাজনীতির মূল স্রোতে এসে ওরা সাম্প্রদায়িক রাজনীতি ত্যাগ করতে বাধ্য হবে।
সেটা হয়নি। জনতা পার্টি ভেঙে গেলে অটল বিহারী বাজপেয়ী, লালকৃষ্ণ আদবানিরা জনসংঘের বাকিদের নিয়ে ভারতীয় জনতা পার্টি গড়ে তোলেন। নরেন্দ্র মোদীর হাতে পড়ে যে পার্টি আজ ভারতের বিপুল জনতার যন্ত্রণার কারণ।
ধর্মনিরপেক্ষতার আদর্শে বিশ্বাসী শরিকদের নিয়ে টলমল জোট সরকার চালাতে না হলে ‘ভারতরত্ন’ বাজপেয়ী কতটা ‘অসাম্প্রদায়িক’ ভাবমূর্তি নিয়ে ভাবতেন বলা মুশকিল। কিন্তু তাঁর সরকারের আর্থিক নীতির সীমাহীন নির্মমতা ভোলার নয়।
প্রাক-নির্বাচনী জোট ছাড়াই ভোটে সেই সরকারের পতন ঘটাতে অনেক বড় ভূমিকা নিয়েছিলেন প্রয়াত জ্যোতি বসু, হরকিষেন সিং সুরজিতেরা। ভোটের পর কংগ্রেসের নেতৃত্বে ইউপিএ সরকার গঠনেরও আসল কারিগর ছিলেন এই দুই প্রবীণ সিপিএম নেতা। ইউপিএ-তে যোগ না দিয়েও জোট গঠনে তাঁরা এতটাই মুখ্য ছিলেন যে সনিয়া গান্ধীর যাবতীয় আপত্তি উপেক্ষা করে মুলায়ম সিং যাদবকে মন্ত্রিসভায় স্থান করে দিয়েছিলেন সুরজিৎ। বিদেশিনী ইস্যুতে সনিয়ার মুণ্ডপাত করা মুলায়মকে কিছুতেই সরকারে নিতে রাজি ছিল না কংগ্রেস। আমেরিকার সঙ্গে পরমাণ চুক্তির বিরোধিতা করে বামেরা প্রথম ইউপিএ সরকারের উপর থেকে সমর্থন প্রত্যাহার করে নিলে কংগ্রেসের পাশে দাঁড়িয়েছিল বাম-বন্ধু মুলায়মই।
আবার বসু-সুরজিৎদের উদ্যোগে তৈরি কংগ্রেস ও বিজেপি বিরোধী তৃতীয় ফ্রন্টের ধাক্কায় নির্বাচনে পতন হয়েছিল নরসিংহ রাও সরকারের। ১৯৯৬-এর সেই লোকসভা ভোটের পর দল চাইল না বলে প্রধানমন্ত্রী হলেন না জ্যোতি বসু। কিন্তু বাজপেয়ীকে ১৩ দিনের মাথায় দিল্লির কুর্সি থেকে বিদায় দিয়ে দু-দুটি যুক্তফ্রন্ট সরকারের প্রাণভোমরা হয়েছিলেন বসু, সুরজিৎ, সিপিআইয়ের এবি বর্ধন, ইন্দ্রজিৎ গুপ্তরা।
গান্ধীবাদী জয়প্রকাশ নায়ায়ণ ক্ষমতার রাজনীতি থেকে শতহস্ত দূরে থাকতেন। কিন্তু চরম বিপদের সময় দেশকে বাঁচিয়েছেন শাসকের বিকল্প নির্মাণ করে। জ্যোতি বসু, হরকিষেন সিং সুরজিতদের দল চায়নি পার্টি কেন্দ্রীয় সরকারে যোগ দিক। সেই ভুলের মাশুল সিপিএমকে আজ গুনতে হচ্ছে অস্তিত্বহীনতার সংকটের মুখোমুখি হয়ে। দেশকে ভুগতে হচ্ছে জেপি, জেবির মতো নেতার অভাবে। এমন একজনও নেই যাঁর কথা বাকিরা শুনবে। এমনকী মোদী বিরোধিতায় সততা ও সাহস নিয়েও সংশয় রয়েছে কম-বেশি সব বিরোধী নেতা-নেত্রীর বিরুদ্ধেই।