
আমাদের দেশে নামকরণ নিয়ে বিতর্ক আছে বহুদিন যাবৎ। একেবারে সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ‘রাজীব খেল রত্ন’ খেতাবের নাম বদলে দেওয়ায় নতুন করে মাথাচাড়া দিয়েছে সেই বিতর্ক। বিজেপি সরকারের বক্তব্য পরিষ্কার। রাজীব গান্ধী কোনও ক্রীড়াব্যক্তিত্ব ছিলেন না। সুতরাং তাঁর নামে খেলোয়াড়দের খেতাব দেওয়া অর্থহীন। তার বদলে ওই পুরস্কারের নাম হয়েছে ‘মেজর ধ্যানচাঁদ খেল রত্ন’। আপাতদৃষ্টিতে যুক্তিতে ফাঁক নেই। ধ্যানচাঁদের মতো ক্রীড়া প্রতিভা ভারতে তো বটেই, বিশ্বে খুব কম জন্মেছেন। রাজীব গান্ধী যে দলের নেতা ছিলেন, সেই কংগ্রেসও সরকারি সিদ্ধান্তের বিরোধিতায় গলা চড়াতে পারেনি। তবে কংগ্রেসের মুখপাত্র শামা মেহমুদ বিজেপিকে কটাক্ষ করে বলেছেন, আগে নরেন্দ্র মোদী স্টেডিয়ামের নাম বদলানো উচিত ছিল।
বিজেপি আমলে অবশ্যই একটা নতুন ব্যাপার ঘটেছে। কোনও জীবিত নেতার নামে স্টেডিয়ামের নামকরণ করা আগে কখনও হয়নি। তবে নামকরণের ব্যাপারে কংগ্রেসের সঙ্গে কারও তুলনাই চলে না। ২০১৩ সালে এক আরটিআইয়ের জবাবে জানা গিয়েছিল, কেন্দ্রের মোট ১২ টি ও রাজ্যের ৫২ টি প্রকল্পের সঙ্গে নেহরু-গান্ধী পরিবারের কারও না কারও নাম জড়িত। এছাড়া ২৮ টি টুর্নামেন্ট, ১৯ টি স্টেডিয়াম, পাঁচটি বিমান ও জাহাজ বন্দর, ৯৮ টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, ৫১ টি পুরস্কার, ১৫ টি ফেলোশিপ, ১৫ টি অভয়ারণ্য ও উদ্যান, ৩৯ টি হাসপাতাল, ৭৪ টি রাস্তা এবং ভবনের সঙ্গে জওহরলাল নেহরু, ইন্দিরা গান্ধী বা রাজীব গান্ধীর নাম যুক্ত আছে।
২০১৪ সালে এনডিএ সরকার ক্ষমতায় আসার পরে শুরু হয় নামবদলের পর্ব। এব্যাপারে সবচেয়ে উৎসাহী যোগী আদিত্যনাথ। তিনি কোনও কিছুর নামের সঙ্গে মুসলমান নেতা, রাজা বা রাজবংশের সম্পর্ক রাখতে চান না। তাঁর আমলে নামকরণ হয়ে উঠেছে মেরুকরণের মাধ্যম। তাই মুঘলসরাই জংশনের নাম হয়েছে দীনদয়াল উপাধ্যায়। এলাহাবাদের নাম বদলে হয়েছে প্রয়াগরাজ। একসময় অযোধ্যা ছিল ফৈজাবাদ জেলার অধীনে। এখন জেলার নাম হয়েছে অযোধ্যা। ফৈজাবাদ তার অন্তর্গত একটা ছোট জায়গা মাত্র। গুজরাতের আমেদাবাদ শহরের নাম পাল্টে কর্ণাবতী করার দাবি উঠেছে। বিজেপির সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক সি টি রবি সম্প্রতি কর্নাটকের মুখ্যমন্ত্রী বাসবরাজ বোম্মাইয়ের কাছে আবেদন জানিয়েছেন, রাজ্যে ইন্দিরা ক্যান্টিনগুলির নাম বদলে করা হোক ‘অন্নপূর্ণেশ্বরী ক্যান্টিন’।
বিজেপির একসময়কার শরিক শিবসেনাও এ ব্যাপারে কম যায় না। ১৯৯৫ সালে রাজ্যে ক্ষমতায় এসেই তারা ভিক্টোরিয়া টার্মিনাস, প্রিন্স অব ওয়েলস মিউজিয়াম ও বিমানবন্দরের নাম বদলে দেয়। সেগুলির সঙ্গে জুড়ে দেওয়া হয় মারাঠা বীর শিবাজির নাম।
আমাদের বাংলাতেও নাম নিয়ে রাজনীতি কমবেশি হয়েছে। একসময় বামফ্রন্ট সরকার হ্যারিংটন স্ট্রিটের নাম বদলে রেখেছিল হো চি মিন সরণী। ওই রাস্তাতেই অবস্থিত আমেরিকার কনস্যুলেট। তাদের খানিক বিব্রত করার জন্যই রাস্তার নতুন নাম রাখা হয়েছিল। কারণ হো চি মিন একসময় ছিলেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পয়লা নম্বর শত্রু। তাঁর আমলে ভিয়েতনামে সেনা অভিযান চালাতে গিয়ে আমেরিকা বেধড়ক মার খেয়েছিল।
একটা কথা মানতে হবে যে, বামপন্থীরা অন্তত সরকারি প্রকল্প, ভবন বা রাস্তার সঙ্গে তাঁদের নেতাদের নাম যুক্ত করেননি। তৃণমূল কংগ্রেসও তেমনটা করেনি। অবশ্য তাদের সামনে সুযোগও কম। তৃণমূলের কোনও মতাদর্শগত গুরু নেই। তাদের মধ্যে একা মমতাই সর্বময় কর্তৃত্বের অধিকারী। তাঁর নামে এখনও কোনও কিছুর নামকরণ হয়নি।
আসলে নামকরণের রাজনীতির পিছনে একপ্রকার ভুল ভাবনা আছে। রাস্তা, ভবন বা প্রকল্পের সঙ্গে কোনও নেতার নাম যুক্ত থাকলেই তাঁর মতাদর্শ প্রচার হয় না। আমাদের দেশের যে কোনও বড় শহরেই মহাত্মা গান্ধীর নামে অন্তত একটি রাস্তা আছে। কিন্তু তাঁর আদর্শে বিশ্বাসী কতজনকে খুঁজে পাওয়া যাবে। কোনও দল যদি জনহিতকর কাজ করে, বিচক্ষণতার পরিচয় দেয়, তবেই মানুষ তাকে বিশ্বাস করে। শুধু নেতাদের নাম ভাঙিয়ে কোনও দল চলে না।