
অনির্বাণ ভট্টাচার্য

তোমার ঘুম ভাঙল। তোমার সামনে একটা খবরের কাগজ। দরজা গলিয়ে, রেলিং গলিয়ে তোমার ঘরে ছুড়ে দেওয়া মৃত্যুসংবাদ, অবিচুয়ারি। হকারদের অভ্যেস হয়ে যায়। তোমার ছেলের, তোমার মেয়ের অভ্যেস হয়ে যায়। প্রতিটা দিন, প্রতিটা রাত্রির একটি নিজস্ব হরর থাকে। অভিনীত হয়। কোনওদিন কথা ছুড়েছ তোমার মানুষটাকে? সেই কথা তোমার দিকে ফিরে এসেছে তীব্রতর রোষে? আর তোমার সন্ততি, তার দিকে? এই ত্রিকোণ পাসিং-গেমে তুমি দেখছ তোমার বেঁচে থাকাটাও একটা শিল্প হয়ে যাচ্ছে। নিখুঁত, ত্রিস্তরীয় শিল্প। অথচ দেখো, তুমি এইসব দৃশ্যের বাইরে সচরাচর কিন্তু ভালো হতে শেখো, তোমার সন্ততিকে বলো, ভালো হ। তবু, ‘গুডনেস, দ্যাট হার্স, ইজ নট ইট?’
তো, এইসব কথাবার্তার মাঝেই তোমার মানুষ, তোমার মানুষী একটা সময়ে তোমার থেকে চলে যাবে অনেক দূর। ‘ইউ লুকড অ্যাট ইওর ওয়াইফ অ্যান্ড স আ স্ট্রেঞ্জার …’। একটা মিনিয়েচার পেন্টিং-এ তাঁর ব্যক্তিগত অংশগুলো দেখে চোখে কাচের পর কাচ পরে নেবে একদলা কৃমির মতো লোক, এবং তুমিও। এ’খেলায় তুমি অতিরিক্ত। এসবের থেকে বেরোতে অবশ্য তোমার আছে ক্রিয়েটিভিটি, সৃষ্টির আখর। একটা সেরেন্ডিপিটি শূন্য, নির্জীব অ্যাপার্টমেন্টের দরজায় চলে আসবে একদিন। বলবে, এই তো সুযোগ, এখনই তৈরি কর শহরের মধ্যে শহর, চরিত্রের মধ্যে চরিত্র, তার মধ্যে আবার চরিত্র। লেয়ার, লেয়ার, লেয়ার। একটা লং-ড্রাইভে যেতে হবে তোমায়, স্টার্ট নিয়েছো? সত্যিই যাবে তো? সব হারাবে, যারা আসবে, তারা আসার মতো করে এসেও চলে যাবে জেনেও, যাবে তো? বেশ …

ইন দ্য মিনটাইম, একটু একটু করে হারিয়ে গেছে তোমার কাঠিন্য। সঙ্গমের সময় তুমি আসলে মৃত্যুভয় পাও, কাকে বোঝাবে? এসব ব্যক্তিগত ক্ষতির ভেতর জড়ো হয়ে যায় অনেকে। যারা আসলে তোমার লেখা চেনে, ছবি চেনে, কাজ চেনে, অথচ, ভেতরটা, তোমার ক্রুড রিয়েল ভেতরটা, তোমার টু-বি-এইচ-কে, তোমার দৈনন্দিনতা চেনে না সেভাবে। তাঁদের গ্রুমিং করাতে এসে তুমি ভয় পাইয়ে দাও। মৃত্যুভয়। এই দেখো, আমরা রোজ এগোচ্ছি ওইদিকেই, অথচ এই আজকের দিনটা কী ভীষণ জ্যান্ত। সবাই জানি একদিন চলে যাবো হঠাৎ, অথচ বিশ্বাস করি না চলে যেতে পারি বলে। পাথর হয়ে যাওয়া সেইসব কুশীলবের বয়স বাড়তে বাড়তে পোডিয়ামের আকাশ ছোঁবে। তুমি সহ-অভিনেত্রীকে পাশে নিয়ে ওদের বোঝাবে এতদিন কিভাবে প্রতিটা সকালে ওদের ঘরে ঘরে গিয়ে একটা চিরকুট ধরিয়ে দিয়ে এসেছ তুমি। তুমি ওদের পরিত্রাতা, ওদের ক্লেয়ারভোয়্যান্ট। বলেছ, রোজ কী কী হচ্ছে জীবনে। তোমার, আমার, সবার। বুকের ভেতর, গলার ভেতর দলা দলা ভয়েড জড়ো হবে। সবার। ‘দ্য স্পেশিফিকস হার্ডলি ম্যাটার, এভরিওয়ান ইজ এভরিওয়ান’। এবং হঠাৎ-ই তোমায় থামাবে কেউ। বাধা দেবে। বলবে, স্যার, আমরা অভিনয় করতে করতে ক্লান্ত। দর্শক আসবে না? ক্ল্যাপ্স, এনকোর? আসবে না কেউ? সতেরো বছর হয়ে গেল স্যার, দর্শকবিহীন …

ঠিক এই সময় একটা টার্নওভার। মনে পড়বে ঘরে একজন বৃদ্ধ আছেন, তাঁর কর্কট। আসন্ন মৃত্যুভয়। অথচ তাঁকে অসুখের কথা বলেনি কেউ। তিনি জানেন না। মাঝে মাঝে আঙুলে বড় ব্যথা হয় বলে নিজেই উঠে একদিন হাসপাতালে গিয়ে আর ফিরলেন না। ফিউনারেল। এমিলি ডিকিনসনের মতো শতসহস্র ফিউনারেল তোমার মাথায় গিজগিজ করে, সেকেন্ডে, মিনিটে, সময়ের অসংখ্য পরিধিতে। এই শেষ দৃশ্য অভিনীত হতে হবে। তোমার চরিত্রে আরেকজন। তাকে তোমার মতো হতে হবে। তোমার শিথিলতা, স্বমেহন, চিৎকার, মুদ্রাদোষ– সব তার সামনে। রিহার্সাল। মেথড অ্যাক্টিং। জানো, এই যে এত এত মানুষ, এরা কেউই এক্সট্রা না। সবাই সবার সিনেমায় এক একজন প্রোটাগনিস্ট। ‘দে আর অল লিডস ইন দেয়ার ওন স্টোরিজ। দে হ্যাভ টু বি গিভেন দেয়ার ডিউ …’। এই ডিউয়ের ভেতর তোমার সন্ততি বড় হবে অন্য কারও কাছে। তার শরীরে অন্য কোনও অভিভাবকের অন্যরকম হাত। সে পণ্য। তোমার ফুলের মতো সন্ততি পণ্য। কাচের ওপারে, পিপ-শোয়ের ওপারে তার খোলা শরীর। এপারে অন্ধকার তুমি। চিৎকার করে বলছ ‘আমি তোর বাবা রে, আমি তোর বাবা’।

এদিকে, তোমার শো তো শেষের দিকে, ম্যান। দর্শক আসছে না। চরিত্র থেকে চরিত্রে বদলাতে বদলাতে, তোমার হাতে তোমার মানুষীর হাত দেখে ব্যর্থ অভিমানে সেটের বহুতল থেকে লাফিয়ে পড়ছে তোমারই চরিত্রাভিনেতা। তার চশমায় রক্তের প্রতিবিম্ব। উঠে পড়ো বাস্টার্ড, উঠে পড়ো। আই ডিড নট জাম্প। ঝাঁপ দিতে গেছিলাম, আটকে দিয়েছিল অন্য কেউ। গেট আপ প্লিজ। স্ক্রিপ্টে নেই, স্ক্রিপ্টে ছিল না এটা। এবং আবারও ফিউনারেল। তোমার সলিলোকি। অর্বুদ কোটি বছর ধরে চলা একটা নীল গ্রহের আহ্নিক গতি। এসবের মাঝে তুমি কতক্ষণ, ফ্র্যাকশন অফ আ ফ্র্যাকশন অফ আ সেকেন্ড। এবং সেই অন্তর্বর্তী সময়? কীভাবে কাটাও? যেন মরে গেছ অনেকদিন, যেন জন্ম হয়নি এখনও। ‘ওয়েটিং ইন ভেইন। ওয়েস্টিং ইয়ার্স ফর আ ফোন কোল অর আ লেটার অর আ লুক …’
এবং শেষের আগেও একটা শেষ থাকে। একটা আগুন-ভর্তি ঘরে তোমার প্রিয় মানুষী একা থাকতে চেয়েছিল একদিন। বলেছিল, বাট আই অ্যাম নট সিওর অ্যাবাউট ডায়িং ইন ফায়ার। ভুল কি? মৃত্যু যদি অমোঘ হয়, তাহলে প্রতিটা মানুষ কীভাবে চলে যাবে অন্তত সেই সিদ্ধান্ত নেওয়াও কি তার প্রাপ্য নয়? সেই মেয়েটি নিয়েছিল একদিন। তোমার সঙ্গে শেষ রাত, শেষ আগুনে সময়, শেষ মন্ত্রপাঠ। ‘এই তো আমি আছি, দেখো’। তুমি ভরসা পাওনি। তুমি ভয় পেয়েছিলে। শেষ হয়ে যাওয়ার ভয়, যন্ত্রণা পাচ্ছিলে তুমি। বলেও ফেলেছিলে। সে কিন্তু নির্বিকার। সে জানত, ‘অ্যান্ড দ্য এন্ড ইজ বিল্ট ইন্টু দ্য বিগিনিং …’। সকালে, অনেকটা সকালে ডাক্তার হাত দেখে বলেছিলেন, ‘ডায়েড ইন সাফোকেশন …’

বাকিটা শুধু ড্রাইভিং। শুরুতে যে লং-ড্রাইভের কথা বলেছিলাম, তারই অভিঘাত। তোমার পরিবার, তোমার সেট, তোমার ম্যাগনাম ওপাস– কিছুই আর নেই। এক পার্শ্বচরিত্রের কাঁধে মাথা রেখে তুমি। তোমার ভেতরে তোমার সলিলোকির কণ্ঠ, ঠিক তোমার না। সে তোমায় চালায়। কথা বলে। হাসে। বলে, কী পেলে দেখলে? শুরুর দিকের রহস্যময়, অসম্ভব ড্রিমি একটা সিকুয়েন্স ভেঙে পড়ে আছে পায়ের সামনে। তুমি লাঠি দিয়ে সরিয়ে সরিয়ে দেখছ পাঁজর, অস্থি, শুকনো মাংস। ‘লাইফ, নাউ বিহাইন্ড ইউ, লিভড, আন্ডারস্টুড, ডিসঅ্যাপয়েন্টিং …’। গল্পটা তোমার নয় অবশ্য। সবার। সেই তো একই কথায় ফিরে আসা। ‘স্পেশিফিক্স হার্ডলি ম্যাটার। এভরিওয়ান ইজ এভরিওয়ান …’। এবং তারপর তোমার সেই ড্রাইভ। স্টিয়ারিং। তুমি জেনে গেছ তোমায় কেউ দেখছে না, তুমিও কাউকে দেখছ না। কোথাও যাওয়ার নেই তোমার, সেভাবে কোথা থেকে আসোওনি এতদিন। জীবন একটা অনন্ত স্টিয়ারিং ধরে বসা, ড্রাইভিং, কাউন্টিং অফ টাইম …
এবং তখনই তোমার ছবিটা, তোমার নাটকটা শেষ করতে ইচ্ছে হয়। সেই পার্শ্বচরিত্র, সেই মাইনর ক্যারেক্টরের কাঁধে মাথা রেখে তুমি অস্ফুটে বলে ওঠো কিছু …
‘আই নো হাউ টু ডু দিস প্লে নাও। আই হ্যাভ অ্যান আইডিয়া। আই ত্থিঙ্ক, ইফ এভরিওয়ান ডাই …’