দেশের শিকড় ছুঁয়ে থাকার প্রয়োজনীয়তা বোঝাতে গিয়ে অমিত শাহ ইংরেজিকে ‘লজ্জাজনক’ বলে কটাক্ষ করলেও, রাজনীতিক, শিক্ষাবিদ থেকে শুরু করে দেশের বহু মানুষ তা মনে করেন না।
এআই দিয়ে তৈরি ছবি
শেষ আপডেট: 22 June 2025 03:54
ইংরেজি কি শিখব না আমরা? নাকি ইংরেজি শিখলে বা তাতে কথা বললে আমাদের একদিন লজ্জা পেতে হবে!
রবিবাসরীয় সকালে এ কোনও হেঁয়ালি নয়। বরং গুরুতর এক বিতর্কের বিষয়। যে বিতর্ক ফের নতুন করে উস্কে দিয়েছেন অমিত শাহ। তিনি বলেছেন, “এই দেশে যাঁরা ইংরেজিতে কথা বলেন, তাঁরা খুব তাড়াতাড়ি ইংরেজি বলার জন্য লজ্জা পাবেন।” কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর এই বক্তব্য গেরুয়া পরিসরে একেবারে নতুন নয়। কিছু দিন আগে আরএসএস প্রধান মোহন ভাগবতও তাঁর ভাষণে সাফ জানিয়েছিলেন, “আমরা ইংরেজি বলব না।”
অমিত শাহ-মোহন ভাগবত যদি এক মেরুতে থাকেন, তবে ভিন্ন মেরুতে দেখা যাচ্ছে রাহুল গান্ধী, ব্রাত্য বসু, সুজন চক্রবর্তীর মতো নেতাদের। ইন্দিরা-রাজীবের মতই রাহুল গান্ধী কিছুদিন বিদেশে পড়াশুনা করেছেন। তিনি স্পষ্টবাদীও বটে। তাঁর সোজা বক্তব্য হল, অমিত শাহরা কোনও কাজের কথা বলছেন না। যা বলছেন, তা বাজে কথা।
রাহুলের মতে, ইংরেজি না শিখলেই নয়। এই ভাষা শিখলে জ্ঞানের পরিধি আরও বাড়বে। দেশ বিদেশে গিয়ে চাকরি করা যাবে। ইংরেজি আসলে তাই একটা বড় হাতিয়ার। যে হাতিয়ার বৃহত্তর এক্সপোজারের দরজা খুলে দিতে পারে। রাহুলের কথায়, সেটা বুঝেই আরএসএস বা বিজেপি-র উপরতলার নেতারা তাঁদের ছেলেমেয়েদের বিলেতে পড়াতে পাঠান। তাঁদের ছেলেমেয়ে যদি ইংরেজি শিখতে পারে, তাহলে বাকিরা শিখবে না কেন!
ব্যাপারটা শুধু এখন অমিত শাহ-রাহুল তুতু ম্যায় ম্যায়তে থেমে নেই। এ নিয়ে যুক্তি-তর্ক ভালই উস্কে গিয়েছে ঘরোয়া রাজনীতিতে। কারণ, দেশের শিকড় ছুঁয়ে থাকার প্রয়োজনীয়তা বোঝাতে গিয়ে অমিত শাহ ইংরেজিকে ‘লজ্জাজনক’ বলে কটাক্ষ করলেও, রাজনীতিক, শিক্ষাবিদ থেকে শুরু করে দেশের বহু মানুষ তা মনে করেন না। এ ব্যাপারে তাঁদেরও নিজ নিজ যুক্তি রয়েছে।
যেমন শিক্ষাবিদ পবিত্র সরকারের মতে, রাজনৈতিক নেতারা যে এই সব কথাবার্তা খুব ভেবে বলছেন বা ভাষা নিয়ে চিন্তা করে বলছেন, তা নয়। তাঁরা এ সবই সুবিধাবাদী রাজনৈতিক অবস্থান থেকে বলে থাকেন।
তাঁর কথায়, “ভারতেও একটা গোষ্ঠীর মাতৃভাষা ইংরেজি। অমিত শাহর কথা অনুযায়ী, সেই অ্যাংলো ইন্ডিয়ান গোষ্ঠী তাঁদের মাতৃভাষা বলার জন্য লজ্জা পাবেন, এটা বলার অর্থ, তাঁদের অপমান করা। ফলে অমিত শাহ বা মোহন ভাগবত বুঝে শুনে কথাটা বলেননি। দ্বিতীয়ত, উচ্চশিক্ষার ভাষা হিসেবে ইংরেজি এখনও অ্যাকাডেমিক মহলে প্রয়োজনীয়। তো এই ভাষার জন্য যদি লজ্জিত হতে হয়, তবে তা উচ্চশিক্ষায় বাধা দেওয়ারই ইঙ্গিত।”
পবিত্রবাবুর কথায়, “ওঁদের বলা উচিত ছিল, ইংরেজি বলাটা অহঙ্কারের বিষয় নয়। দরকারের বিষয়। এটার সঙ্গে লজ্জিত হওয়ার তো সম্পর্ক নেই। ভাষা লোকে দরকারে বলে। শখ করে বলে না। ইংরেজি হোক বা সাঁওতালি, যে কোনও ভাষাই বলতে হতে পারে, তাতে লজ্জিত হওয়ার কিছু নেই। অহঙ্কারের ভাষা না হলেই হল।”
এখানেই আবার অনেকে প্রশ্ন তুলেছেন, এ রাজ্যে সিপিএমের জমানায় ক্লাস ফোর পর্যন্ত ইংরেজি পড়ানো হতো না। মনে করা হতো, প্রাথমিক স্তরে বিদেশি ভাষা শেখার প্রয়োজন নেই। আজ বিজেপি-র বক্তব্য কি অনেকটা সেদিকেই ইঙ্গিত করছে?
পবিত্রবাবুর কথায়, “এটা অনেক অতীতের বিষয়। সে সময়ে যে পরিস্থিতিতে বা যে ভাবনা থেকে এই বিষয়টি শুরু হয়েছিল, সেখান থেকে সিপিএম অনেক আগেই সরে এসেছে। রাজ্যের শিক্ষাব্যবস্থাও এখন সেটা থেকে অনেক দূরে। ফলে এখন এই নিয়ে আলোচনা প্রাসঙ্গিক নয়।”
সিপিএম নেতা সুজন চক্রবর্তী অবশ্য বলছেন, “অমিত শাহের বক্তব্য সংবিধান-বিরোধী। ভারতে কিন্তু ইংরেজি ভাষা ব্যান করা হয়নি। দেশের ভিতরে ও বাইরে কার্যক্ষেত্রে এখনও বহু মানুষ ইংরেজি ভাষাটাই ব্যবহার করেন। এমনকি অমিত শাহর ছেলেও তো তাই করেন। ক্রিকেটের বড় পদে আছেন, সেখানে তো ইংরেজিই চলে।”
তাহলে অমিত শাহ এটা বলছেন কেন? সুজনবাবুর কথায়, “এই কথার পিছনে রয়েছে, ‘হিন্দি, হিন্দু, হিন্দুস্থান’ মানসিকতা। দেশে একটাই জাতি, একটাই ধর্ম, এক ভাষা—এটাই তাঁদের ভাবনা। তাঁরা হিন্দিকে চাপিয়ে দিতে চান সারা দেশে। এই মনোভাবেই চলছে আরএসএস বা বিজেপি। এটার নিন্দা করছি।”
বাম আমলে ইংরেজি শিক্ষা দেরি করে শুরু করার প্রসঙ্গে সুজনবাবু জানান, সিপিএমের কোনওদিনই ইংরেজির সঙ্গে কোনও শত্রুতা ছিল না। কিন্তু দুনিয়ার যে কোনও প্রান্তেই নিজের মাতৃভাষাকে শক্তিশালী করে তবেই অন্য ভাষা শেখা জরুরি বলে মনে করা হয়। তাই স্বাধীনতার পর থেকে ভারতের সব রাজ্যেই মাতৃভাষায় পঠনপাঠনই ছিল বেশি জরুরি। তার মানে এই নয়, ইংরেজি কম শেখানো হবে বা ইংরেজি থেকে দূরে রাখা হবে পড়ুয়াদের।
কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের প্রাক্তন অধ্যাপক প্রফেসর অশোক সেনগুপ্তর মতে, এটা ভাষা নিয়ে যে একটা আইডেন্টিটি পলিটিক্স করার চেষ্টা, যা আগেও হয়েছে। তাঁর কথায়, “ভারতবর্ষের মতো এত বড় দেশে ইংরেজি একটা যোগাযোগের ভাষা, এটাকে অস্বীকার করা যায় না। সেখানে ইংরেজি বন্ধ করে দেওয়ার প্রস্তাব একেবারেই গ্রহণযোগ্য নয়।"
কসমোপলিটন শহরগুলোর কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, "এটা আধুনিক সভ্যতারই অংশ। সেই কালচারে ইংরেজি ভাষা বেশ জরুরি। তা বন্ধ করলে সাধারণ মানুষই বিপদে পড়বেন। কারণ এসবের আঁচ কর্পোরেট ওয়ার্ল্ডে গিয়ে পৌঁছয় না। তাঁরা তাঁদের মতোই চলেন।”
ইংরেজি নিয়ে যখন জাতীয় রাজনীতিতে এই তর্জা চলছে, এ রাজ্যের অবস্থান সেখানে কোথায়? শিক্ষামন্ত্রী ব্রাত্য বসু ইংরেজি নিয়ে লজ্জা পাওয়ার সঙ্গে একেবারেই একমত নন। ইংরেজি শেখা বা পড়াটা একটা চয়েস বলেই মনে করেন তিনি। তাঁর কথায়, “অমিত শাহ তো ঠিক করতে পারেন না, কে কী পড়বেন। এর পর তো বলবেন, সবাইকে গুজরাতি পড়তে হবে। ইংরেজি নয়। ওঁর এ কথা অর্থহীন।”
অর্থাৎ দেখা যাচ্ছে, ইংরেজি শেখার ব্যাপারে কংগ্রেস, বাম ও তৃণমূলের মতো রাজনৈতিক দলগুলির নেতাদের মধ্যে কোনও মতান্তর নেই। বরং অমিত শাহ ও মোহন ভাগবতদের মত ও পথের সঙ্গে তাঁদের অবস্থানের ফারাক সাদা-কালোয় স্পষ্ট।