
আমার সেজকাকু (পঞ্চদশ পর্ব)
সুদেব দে
কিশোরকুমার আর কাকার সম্পর্ক নিয়ে কথা হচ্ছিল। ‘পড়োশন’ ছবির ‘এক চতুর নার’ গানে ডুয়েট করেছিলেন আমার সেজকাকু আর কিশোরকুমার। সেসময় গানবাজনার জগতে একটা সুস্থ কমপিটিশন ছিল। যেরকম এ গানটা গেয়ে আমি কো-সিঙ্গারকে একটু টাইট দিয়ে দেব। কিন্তু কাকা এত খোলামনের মানুষ ছিলেন, এত গুণী মানুষ ছিলেন যে কারও গুণের প্রশংসা করতে কখনও ভুলতেন না। তিনি আমায় কথাপ্রসঙ্গে একান্তভাবে বলেছেন, বিভিন্ন সাক্ষাৎকারেও বলেছেন-“রেকর্ডিংটা যখন শেষ হল, তখন মনে হল, আরেহ আমি তো গানের নোটেশনটুকু পড়ে গানটাকে নিয়ে চিন্তাভাবনা করছি। কিন্তু কিশোর কত বড় গায়ক ছিল, কত বড় অভিনেতা ছিল, ও কিন্তু গানের মুডটা ধরে নিয়েছে।”
এই ব্যাপারটা কিন্তু খুব গুরুত্বপূর্ণ। যাঁরা সত্যিকারের গানবাজনার প্রফেশনে আছেন বা গান নিয়ে চর্চা করেন তাঁরা এটা বুঝবেন। একটা গান গাওয়ার সময় শুধু গানের গ্রামার বা গানের প্রেজেন্টেশন নিয়ে চিন্তা করার চেয়ে গানের মুড বা এঙ্গেলটা ধরে নেওয়ার মধ্যে একটা বিশেষ ব্যাপার থাকে। আর সেই গুণটা কিশোরকুমারের ছিল।
কাকার মুখে শুনেছি, ‘পড়োশন’এর এই গানটার রেকর্ডিং সকাল ৯টা-সাড়ে ৯টায় শুরু হয়ে প্রায় ৮-৯ ঘণ্টা ধরে চলেছিল। সেই কবেকার গান, কিন্তু তার জনপ্রিয়তায় আজও ভাঁটা পড়েনি। এখন তো চারদিকে গানের কমপিটিশনের ছড়াছড়ি। সেইসব কমপিটিশনে এখনও কমবয়সি ছেলেমেয়েরা ‘এক চতুর নার’ গানটা প্রায়ই গায়৷ অবশ্য শুনে শুনে গান গাওয়া আর একটা গান প্রথমবার তুলে গান গাওয়া এক ব্যাপার নয়। প্রথমবারেই অমন অসাধারণ গান তুলে গেয়ে অসাধ্যসাধন করেছিলেন কিশোরকুমার আর আমার সেজকাকু মান্না দে। ‘পড়োশন’ ছাড়াও সেসময় এস ডি বর্মণের সুরে ‘চলতি কা নাম গাড়ি’ ছবিতে ‘বাবু সমঝো ইশারে’ গানটাতেও সেজকাকুর সঙ্গে কিশোরকুমারের ডুয়েট ছিল।
সেজকাকুর গান নিয়ে আর কী বলব! ওইরকম জ্ঞান, ওইরকম গায়কি প্র্যাকটিক্যাল অভিজ্ঞতা, একটা গান শুনলে সঙ্গে সঙ্গে সে গানের গতিবিধি বলে দিতে পারতেন। যে আধারের উপর গানটা দাঁড়িয়ে আছে, সেই মুডটা বুঝে যেতে পারতেন। সেই সেজকাকুই আমাকে বলেছিলেন- “আমরা তো ক্ল্যাসিকাল গানবাজনা শিখেছি। কী করে সুর লাগাতে হয় শিখেছি। সাত-আট ঘণ্টা রেওয়াজ করেছি। কোনওসময় হয়তো কোনও সুর ঠিকমতো লাগল না, একটু কম লাগল বা চড়ে লাগল, সঙ্গে সঙ্গে আমরা সংশোধন করে নিই। কিন্তু প্র্যাকটিকাল প্রফেশনাল গানের ক্ষেত্রে দেখেছি, কিশোরকুমার এমন একজন শিল্পী, যে বরাবর পারফেক্ট সুরে গান গেয়ে এসেছে। কক্ষনও দেখিনি ওর গলায় সুরটা একটু কম লাগছে বা একটু বেশি লাগছে। একেই বলে ডিভাইন কোয়ালিটি বা ভগবানের আশীর্বাদ। এ সম্বন্ধে কিশোর যে সবসময় অবহিত ছিল তাও নয়। ওর সুরটা যে একচুলও এদিকওদিক না করে একেবারে ঠিকঠাক বসছে, সেটা হয়তো ও-ও জানতো না, বা খেয়াল করত না।”
আমার গুরু, আমার সেজকাকার মুখে কিশোরকুমারের গানের এমনই মহৎ বিশ্লেষণ বারবার শুনেছি। আর এটা কিন্তু খুব অকপটেই বলতেন উনি। উনি বলতেন- “আমরা এত রেওয়াজ করেছি, এত তালিম নিয়েছি। আর সঙ্গীত তো মহাশাস্ত্র, এটা মন দিয়ে শিখতে হয়। সে তুলনায় কিশোরকুমার কিন্তু তেমনভাবে গানবাজনা ঘাঁটেনি। কিন্তু ওর গলা যখনই কোনও সুরে ফেলত আঁকড়ে ধরত সেই সুরটা।” সেজকাকু নিজেই বলতেন, এরকম সিঙ্গার সারাজীবনে খুব কমই দেখেছেন উনি।
কিশোরকুমারের গানের কথা বলে তো শেষ করা যায় না। আর সেজকাকুর সঙ্গে কিশোরকুমারের পারস্পরিক সম্পর্কও ছিল একেবারে অন্যরকম। সেজকাকু বলতেন, কিশোরের তো অনেক সোলো গান। সবসময় তো রেকর্ডিংয়ের সময় আমি ফ্লোরে দেখিনি ওকে। কিন্তু যখনই আমরা কয়েকজন একসঙ্গে গান গেয়েছি বা ডুয়েট গান গেয়েছি তখন দেখেছি কিশোর যদি বুঝতে পারত কোনও গান ঠিকমতো প্রেজেন্ট করতে পারছে না, ও আপনমনে বিড়বিড় করত। নিজেকেই বলত ‘এহ কিশোরকুমার কিছু পারছেনা। কিচ্ছু পারছে না।’ তবে এমনিতে খুব রসিক মানুষ ছিল কিশোর। এক একবার গান গাইবার সময় এমন হাসাত যে গান গাওয়াই যেত না। সেজকাকু তখন কিশোরকুমার’কে ধমকে বলতেন, ‘কিশোর তুমি হয় হাসানো বন্ধ কর, নাহলে আমি রেকর্ডিং ফ্লোর ছেড়ে চলে যাব।’ ব্যক্তিগতভাবে অসম্ভব ভালো সম্পর্ক ছিল দুজনের। কিশোরকুমারের মা ভীষণ ভালোবাসতেন সেজকাকুকে। রেকর্ডিং সেরে ফেরার পথে প্রায়ই বলে রাখতেন “মানা তুমি আমার কাছে খেয়ে যাবে”। তাঁর হাতের লুচি আর সাদা আলুর তরকারি খেতে খুব ভালোবাসতেন সেজকাকু। আমাদের কলকাতার বাড়িতে আমার দিদিভাই, মানে ঠাকুমার হাতে তৈরি লুচি, আলুর তরকারি, বেগুনের তরকারি- এইসব ট্র্যাডিশনাল বাঙালি খাবার কাকা বোম্বেতে থাকতেন বলে মিস করতেন খুব। আর তাই মাতৃসমা আদর দিয়ে মাসিমা সেজকাকুকে প্রায়ই ডেকে পাঠাতেন এবং প্রায়ই রেঁধে খাওয়াতেন। এমনটাই ছিল সেজকাকুর সঙ্গে অশোককুমার, কিশোরকুমারদের পারিবারিক সম্পর্ক।
আবার প্রফেশনের জায়গায় দুজনেই চাইতেন তাঁদের বেস্ট পার্টটুকু দেওয়ার। কিশোরকুমারও চাইতেন তাঁর সেরাটুকু তুলে ধরতে, সেজকাকুও চাইতেন। যেমন ‘শোলে’ ছবির গানটার কথাই ধরা যাক। সেসময় অসম্ভব জনপ্রিয় হয়েছিল ‘শোলে’তে সেজকাকু আর কিশোরকুমারের ডুয়েট। সেই রেকর্ডিং প্রসঙ্গে সেজকাকু বলেছিলেন, “কিশোর যখন ওর ভগবানপ্রদত্ত উদাত্ত গলাটা লাগাচ্ছে মনে হচ্ছে যেন ও একাই সব সুর খেয়ে নিচ্ছে। আবার আমি যখন সুর লাগাচ্ছি যারা বোঝার তাঁরা বুঝতে পারছেন।” আগেই বলেছিলাম না, সাধারণ মানুষ, যারা চাষি, শ্রমজীবী লোক, সারাদিন খাটাখাটুনি করে দিনের শেষে একটু আনন্দের জন্য গান শোনে তাদের অত গানের মুড়কি, গানের মীর, গানের গায়কি মডিউলেশন এসব বোঝার ক্ষমতা থাকে না৷ আর এরকম শ্রোতার সংখ্যাই অনেক বেশি। তবে সব জিনিস তো সাধারণ মাপের হয়ও না। যাঁরা গানবাজনা নিয়ে নানারকম চর্চা করেন তাঁরা বোঝেন কার গানের মধ্যে কীরকম গভীরতা, কারুকাজ আছে। এছাড়া সঙ্গীত পরিচালকেরা, বড় বড় মিউজিশিয়ানরা, যাঁরা বাজাতেন তাঁরাও বুঝতে পারতেন।
তবে কিশোরকুমারের ভার্সেটাইলিটিকে অস্বীকার করা অসম্ভব। তাঁর একের পর এক হ্যাপি মুডের গান, ফাজলামির গান কী ভালো যে গাইতেন! আমাকে সেজকাকু বলেছেন, “আমি হয়তো রেডিওতে বা অন্য কোথাও কিশোরের একটা দারুণ গান শুনলাম। সেই গানের রেকর্ডিংয়ে হয়তো আমি ছিলাম না। কিংবা হয়তো ওর সোলো গান – ভালোলাগলেই আমি কিশোরকে ফোন করতাম। বলতাম ‘কিশোর! কী অপূর্ব গান গেয়েছ তুমি!’ কিশোরও বলত, ‘মান্নাদা, কী বলছ! ভালো গেয়েছি তো!’ বলত ‘দেখ তোমার মতো ভালো গাইতে তো পারিনা।’ তখন আমি বলতাম ‘একদম ফালতু কথা বলবে না।’ বকেও দিতাম।” এতটাই ঘরোয়া আটপৌরে সম্পর্ক ছিল এই দুই মহান গায়কের।
আমার ধৃষ্টতা ক্ষমা করে নেবেন। সেজকাকুর মুখ থেকে যেটুকু শুনেছি, তার ভিত্তিতেই এই যে ঘরোয়া আলোচনাগুলো করতে গিয়ে মনে হচ্ছে আমার জীবন যেন ধন্য হয়ে গেছে। আমি নিজের চোখে দেখিনি বটে, কিন্তু আমার গুরু, আমার পিতৃতুল্য কাকার মুখে যতটুকু শুনেছি, আমি তাতেই বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেছি৷ এঁদের পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ এতটাই ছিল, অভিজ্ঞতা এতটাই ছিল, যে তাঁরা এসব শেয়ার করেছেন। এখানে একটা কথা কথাপ্রসঙ্গে বলে নেওয়া দরকার, কিশোরকুমারের বেশ কিছু গান সেজকাকু আমাকে মার্ক করে দিয়েছিলেন। বলেছিলেন এই গানগুলো তুলে ওঁকে শোনাতে৷ রফিসাহেবেরও বেশ কিছু গানের লিস্ট দিয়েছিলেন। সব গান হয়তো শোনানো হয়নি। সেসময় সেজকাকুও ব্যস্ত থাকতেন। তাঁর সান্নিধ্য পেতাম না সবসময়। তবে গায়ক হিসাবে এই মানুষগুলোকে কতটা সম্মানের চোখে দেখতেন সেজকাকু, সেটা বুঝতে পারতাম।
ক্রমশ…
মেল যোগাযোগ – [email protected]