অংশুমান কর
একটি কবিতার বই সাধারণত শুরু হয় উৎসর্গের পাতা দিয়ে। কখনও বা তারপরে থাকে বিভাব কবিতা। কিন্তু ২০১৩ সালে একটি কবিতার বই পড়েছিলাম, যে-বইয়ে এই দুইয়ের কোনওটিই ছিল না। তার পরিবর্তে প্রথম ফ্লাইলিফে ছিল একটি মুখবন্ধ। যে-মুখবন্ধে কবি লিখেছ
একটি কবিতার বই সাধারণত শুরু হয় উৎসর্গের পাতা দিয়ে। কখনও বা তারপরে থাকে বিভাব কবিতা। কিন্তু ২০১৩ সালে একটি কবিতার বই পড়েছিলাম, যে-বইয়ে এই দুইয়ের কোনওটিই ছিল না। তার পরিবর্তে প্রথম ফ্লাইলিফে ছিল একটি মুখবন্ধ। যে-মুখবন্ধে কবি লিখেছিলেন, “আঘাত পেলে মন ভেঙেচুরে যায়। সঙ্গে সঙ্গে লেখার ছন্দও ভাঙাচোরা, এবড়ো খেবড়ো, অসমান হয়ে পড়ে। এ বইতে তার কিছু প্রমাণ রইল। কেউ একে ত্রুটি বললে নীরবই থাকব। মনের অবস্থার সঙ্গে ছন্দের অবস্থার মিল সর্বদাই দেখতে পেয়েছি। অন্তত আমার জীবনে”। এরপরের ফ্লাইলিফে ছিল একটি উদ্ধৃতি; প্লেটোর “ফিডো” থেকে: “...পাত্রটি হাতে নিলেন [তিনি]...লোকটির দিকে স্থির দৃষ্টিতে চেয়ে বললেন, ‘এই বিষ থেকে একটুখানি কি কাউকে উৎসর্গ করার নিয়ম আছে? কী বলো, সেটা আইনসঙ্গত কি না?’ লোকটি বলল, ‘যতটা বিষ পান করা দরকার বলে মনে করি, ঠিক ততটাই আমরা তৈরি করে থাকি, সক্রেটিস’”। এই অসামান্য অনুবাদটি করেছেন হাসান আজিজুল হক। একে কি বলা হবে? উৎসর্গই? নাকি বিভাব কবিতা? সারাজীবন নিজের কবিতাকে এক বাঁক থেকে অন্য এক বাঁকে নিয়ে গিয়ে যিনি দাঁড় করিয়েছেন (সে বাঁকগুলি ভালো-মন্দ যাই হোক না কেন), চেষ্টা করেছেন কবিজীবনের জড়ত্বকে প্রত্যক্ষ এবং সচেতন আক্রমণ করার, তিনি যে উৎসর্গের প্রথা এবং বিভাব কবিতার চেনা ছাঁদটিকেও বদলে দেবেন উদ্ভাবনে–এ আর তেমন আশ্চর্য কী! এই অদ্ভুত উৎসর্গ পত্র বা বিভাব কবিতার পৃষ্ঠাটি যে-বইটিতে পাওয়া যায়, সেই বইটির নাম “বিষ”। কবি জয় গোস্বামী।
বইটির প্রথম কবিতাটি পড়ার আগেই বোঝা যায় যে, আঘাত পেয়ে ভেঙেচুরে যাওয়া এক মন নির্মাণ করছে এই কবিতাগুলি। অবশ্য ‘নির্মাণ করছে’ লেখা ঠিক হল না, এই বইটিতে নির্মাণের কিছু তথাকথিত ‘ত্রুটি’র কথা তো কবি নিজেই স্বীকার করেছেন। এ বইয়ের কবিতাগুলি স্বতোৎসারিত; পড়তে পড়তে কখনও মনে হয় যেন বা শুনছি আহত জন্তুর গোঙানি, কখনও মনে হয় পাথরের অন্তরে জমে থাকা ক্রন্দন মুক্তি পাচ্ছে ধীরগতি ঝরনার শ্বেতশুভ্রতায়।
কী আছে এই বইটিতে? কবিতাগুলির কোনও নাম নেই। তারা সংখ্যায়িত। তিন নম্বর টুকরোটিতে জয় লিখেছেন:
“অন্ধ গাছপাখি বা ভোর কিছু দেখবে নামিথ্যে রাত জেগে থাকে”
চমকে উঠতে হয় এই তিন লাইনের অভিঘাতে। গাছ রাত জেগে থাকে। রাত জেগে থাকে কেবল পাখি বা ভোর দেখবে বলেই তো। কিন্তু গাছ যদি অন্ধ হয়? তবে তো সে মিথ্যেই রাত জেগে থাকবে। দেখতেই পাবে না পাখির প্রথম উড়াল; দিনমণির ললিত প্রকাশ। কিন্তু গাছ ‘অন্ধ’ কেন? সে কি জন্মান্ধ? নাকি মধ্যবয়সে চলে গেছে তার দৃষ্টিশক্তি? নাকি তার অক্ষি-মণি উত্তপ্ত শলাকা বিদ্ধ করে নষ্ট করে দিয়েছে কেউ? কে সে? তার শত্রু? বইটি যত নিজেকে উন্মুক্ত করতে থাকে, ততই যেন এই ব্যাখ্যাটিকেই প্রতিষ্ঠা করতে থাকে। ভুলে গেলে চলবে না যে, এ-বই তো ভেঙেচুরে যাওয়া কোনও মনের আভরণহীন উন্মোচন।
‘শত্রু’ লিখলাম বটে, তবে কবি বলছেন আসলে ‘শত্রুদের’ কথা। লিখছেন:
“একলা লোক বলে কিচ্ছু নেইসবই তো দঙ্গলজটলা সবসবই তো ঘরে ঘরে আগুন দেওয়া”
দঙ্গলের এটাই কাজ; অসুখী, ঈর্ষাকাতর মানুষদের এটাই চরিত্র। আর তারা ঠিক একে অপরকে খুঁজে নেয়। দল বাঁধে। তৈরি করে ‘মব’। আর তারপর কথা দিয়ে, কলম দিয়ে, গণপিটুনি দেয় নিঃসঙ্গ গাছকে। তপ্ত অগ্নিশলাকা বিদ্ধ করে নষ্ট করে দেয় তার লোচন। এমনকি গাছটির মৃত্যু হলেও তাকে নিস্তার দেয় না বিকৃতির উপাসক এই ‘মব’। জয় লিখেছেন যে, এই “শবমাংসভক্ষণকারীরা/গোল হয়ে সব একসূত্রে গাঁথা”।
কারা এই শত্রু? তাদের চেনা সহজ নয় সবসময়। প্রায়ই তাদের বরং বন্ধু মনে হয়। আমরা এদের কারও অসুখ হলে স্কুটারের পেছনে ডাক্তারবাবুকে বসিয়ে তার বাড়ি নিয়ে যাই, তারপর প্রেসক্রিপশন নিয়ে গিয়ে দোকানে লাইন দিয়ে ওষুধ কিনে পৌঁছে দিই বাড়ি; কাউকে আবার হাইওয়েতে অ্যাক্সিডেন্টের পরে নিয়ে যাই স্থানীয় স্বাস্থ্যকেন্দ্রে, প্রাণ বাঁচাই; কারো অনুরোধে যে-কাজ হয়তো আমাদের করার নয়, কর্মক্ষেত্রে সেই কাজ করি যখন সে নিজের বাড়িতে দিবানিদ্রা যায়, কাউকে আবার স্বীকৃতির শেষ ধাপটিতে উঠতে সাহায্য করতে আমরা নিজেরাই হয়ে যাই মই। তবে এরা এইসব মনে রাখে না। কারণ এদের অন্তরে গরল, ‘বিষ’। চুয়ান্ন নম্বর টুকরোটিতে জয় লেখেন:
“আমার বন্ধুটি নিজেই বিষখাবারে মিশে যেতে পারেআসল কাজটুকু সমাধা করেবেরিয়ে আসবে সে বমির সঙ্গেইআবার চান করে পরিষ্কারপরের কাজটায় একেই নাও”
‘বন্ধু’ সেজে থাকা অন্তরে ‘গরল’ ধারণ করা এই শত্রুরা কিন্তু একটি হত্যাকাণ্ড সমাধা করেই ক্ষান্ত হয় না। এরা রক্তপায়ী। হত্যার মদিরাসক্ত। কিন্তু, এদের দেখে সেকথা বোঝার উপায় নেই। এদের মুখ সরল, নিষ্পাপ, পৃথিবীর কাছে এরা নিজেদের ‘প্রেজেন্ট’ করে গৌতম বুদ্ধের ভূমিকায়। জয় লেখেন:
“গৌতম বুদ্ধের পোশাকপরাবিষের চেয়েও কালোঅবিশ্বাসকেস্বচক্ষে দেখলাম...অবিশ্বাসের চোখ দুটো কী ভাল!”
এই নিষ্পাপ চোখের ‘গৌতম বুদ্ধ’রা পারে না এমন কাজ নেই। জয় তাই তেত্রিশ নম্বর টুকরোটিতে লেখেন:
“আমার গেঞ্জির পিঠের দিক ভেজারক্তেকখন ব্লেড মেরে গেছেআমারই ছেলে...”
কী ভয়ংকর এই কবিতা! প্রথম পঙ্ক্তিটির পরে মনে হয় জয় বুঝি বা লিখবেন ‘ঘামে’। কিন্তু যা প্রত্যাশিত তাকে আক্রমণ করাই কবি জয় গোস্বামীর ধর্ম, চিরকাল। তাই ঘামের বদলে এখানে তিনি বসান একটিই শব্দ, ‘রক্তে’। আর আমরা দেখতে পাই একজন মানুষের ছবি যার পিঠ থেকে রক্তের ধারা গড়িয়ে নামছে। কে ব্লেড মেরেছে এই লোকটিকে? তার নিজের ছেলে? ছেলে মানে কি সত্যিই ছেলে? এই ছেলে কি ‘বাবা’ হতে পারে না? পারেই তো। ছেলেরাই যে সবসময় বাবাদের পিঠে ব্লেড চালায় তা নয়; এ ঘটনাই বেশি ঘটে ঠিক, কিন্তু কখনও কখনও তো বাবারাও ব্লেড চালায় ছেলেদের পিঠে। এই দ্বিতীয় ধরনটি হয়তো ব্যতিক্রম, কিন্তু সত্য। আর সত্য তো কঠিন। তেতো। আচ্ছা, ‘ছেলে’ শব্দটিরই বা অর্থ কী এখানে? ‘ছেলে’ মানে কি পুরুষের শুক্রাণু নিষিক্ত ডিম্বানুজাত এক ভ্রূণের পরিপূর্ণ বিকশিত রূপ? ‘ছেলে’ শব্দটি একটি ‘মেটাফোর’ নয়? যদি মনে রাখি যে, ‘ছেলে’ শব্দটিকে ব্যবহার করছেন একজন কবি, তাহলে কি এটা মনে হয় না যে, কবি আসলে কবিতার জগতের কথাই বলতে চাইছেন প্রাথমিকভাবে? বলতে চাইছেন তাঁর কাছে লেখা শিখে ‘কবি’ হয়ে ওঠা (কু)পুত্রদের কথা? এদের কেউ কেউ আবার ব্লেড চালিয়েও শান্ত হয় না। আঘাতে গাছের পাতার মতো পুকুরে খসে পড়েছে যে-মানুষ, তাকে একেবারে দুমড়ে মুচড়ে না-দেওয়া পর্যন্ত এই গৌতমবুদ্ধরূপী শত্রুরা শান্ত হয় না। ছাব্বিশ নম্বর টুকরোটিতে তাই জয় লিখেছেন:
“পুকুরে পাতা ভেসে আছে।ওকে তোলোশুকোও কড়া রোদে ফেলেপায়ে মাড়াও মড়মড়”
খুবই উল্লেখযোগ্য এই ‘মড়মড়’ শব্দটির ব্যবহার। ঘাতক ভাবে সে বুঝি নিঃশব্দে সেরে নেবে হত্যাকর্মটি। কিন্তু, তা হয় না। শব্দ ওঠে। পৃথিবী জেনে যায়।
কথা হল যে, এই যে লোকটির পিঠে ব্লেড চালিয়ে দেওয়া হচ্ছে, বা যে-লোকটি পাতার মতো খসে পড়েছে জীবন থেকে বুঝতে পেরেও তার মৃত্যু সুনিশ্চিত করার জন্য তাকে শুকিয়ে মাড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে, সে কী করবে? সে কি সত্যিই মরে গেছে? সে হয়তো এখন নিষ্প্রাণ। কিন্তু মৃত নয়। বাইরের পৃথিবীর সঙ্গে তার হয়তো সংযোগ নেই; গরলে ভরা সে-পৃথিবী থেকে সে নিজেকে বিযুক্ত করে নিয়েছে; রুদ্ধ করেছে আপন অন্দরে। কিন্তু সে চেষ্টা করছে বেঁচে থাকবার। তাই সে দিনলিপি চেবায়। দাঁড়িয়ে থাকার শক্তি এই মানুষের আর নেই ঠিক। কিন্তু তবু সে শুয়ে পড়ে না। বসে থাকে:
“বাইরে তো আর তাকাতে পারি না–হোসপাইপের গরলে ধুচ্ছেফুটপাত, রোড, রাস্তাঘরে বসে বসে দিনলিপিচিবিয়ে চিবিয়ে বাঁচিশুয়ে পড়লেইমরা ভেবে নিয়ে মুখের কাছেঘুরে ঘুরে উড়ে হা-হুতাশ করে মাছিরা”
সবচেয়ে আশ্চর্য লাগে এটি ভাবলে যে, এই বইটিতে জয় দেখান যে, আক্রান্ত মানুষটি আক্রান্ত হতে হতে শেষমেশ এমন এক দশায় গিয়ে পৌঁছন যে, তিনিও যেন সুস্থ থাকেন না আর। তাঁকে সারাক্ষণ অজগরের মতো পেঁচিয়ে পেঁচিয়ে ধরে অশুভর বক্রতা:
“মগজে কুণ্ডলী পাকিয়েমস্ত সাপ শুয়ে আছেশরীরে যত শিরা উপশিরাসবাই ছোট বড় সাপযেখানে যাব ঠিক এদের সঙ্গেই থাকতে হবে”
তবে কি বাইরের আক্রমণ ব্যক্তিগত পবিত্রকেও হত্যা করে? এ বই কি তবে তিমিরবিলাসী এক গ্রন্থ? তিমিরবিনাশের কথা নেই এতে? আছে। এ বইটিতে জয় লিখেছেন ঠিক যে, “কোথায় যাব তবে?/দিকে দিকে/এত উনুন!”, কিন্তু, শেষমেশ কবি নিজেকে বাঁচান, জনগণেশের দ্বারা ধর্ষিত হয়েও, জাদুমন্ত্রবলে রক্ষা করেন নিজের কৌমার্য। ভুলে গেলে চলবে না যে, ওই যে অন্ধগাছ, যার নয়নতারা বিদ্ধ হয়েছে অগ্নিশলাকায়, সে কিন্তু বধির নয়। তাই জয় লেখেন:
“তুমি কি একদিন আসতে পারোপাখির ডাক হয়ে? শেষরাতে?আমি তো জানলায় বসেই থাকি”।
পাখির উড়াল যিনি দেখতে পান না আর তিনি কিন্তু শুনতে পারেন পাখির ডাক। এই চেতনাই মন্ত্রের মতো বেজে ওঠে এ বই পাঠসমাপনান্তে।
অবশ্য এই বইটিকে পড়া বুঝি কখনওই শেষ হবার নয়। গত একবছর ধরে এই বইটি আমি পড়ছি। বারবার পড়ছি। গত একবছর ধরে এই বইটিই আমার “গীতা”।
পড়ুন দ্য ওয়ালের সাহিত্য পত্রিকা 'সুখপাঠ'