
যশোধরা রায়চৌধুরী
সম্প্রতি যে রাজনৈতিক ব্যক্তিদের কিছু অরাজনৈতিক কাজে দেখা গেল সোশ্যাল মিডিয়াজুড়ে, তা হয়তো খুব নান্দনিক বা সম্ভ্রম উদ্রেককারী নয়। কিন্তু অসম্ভ্রমের কিছুও কি? তবে তার ফলে সমাজমাধ্যমে যে হুল্লোড় ও কদর্য মন্তব্যের ঢেউ দেখা গেল তার অসম্ভ্রম নিয়ে কিছু বলার থাকে না!
না, থাকে হয়তো। কারণ সেটা সম্পূর্ণভাবে এক নারীর বডিশেমিং-এর (bodyshaming) জাজ্জ্বল্যমান উদাহরণ! এখনও আমাদের চোখে নারীমাত্রেই শুধু শরীর। শুধু তাই নয়, সে শরীর তন্বী না পৃথুলা, শ্যামা না গৌরী তা নিয়ে আজও খুল্লম খুল্লা কথা বলার অবকাশ তৈরি হয় অনায়াসে। গতকাল সমাজমাধ্যমের ভিডিওতে দৃশ্যমান এক নৃত্যরতা মহিলার সঙ্গে পশুসমাজের নানা সদস্যের তুলনা করার যে হুড়োহুড়ি দেখলাম, সেই মন্তব্যকারীদের অধিকাংশই কিন্তু মহিলা।
হ্যাঁ, মেয়েরা মেয়েদের বডি শেমিং করছেন অকাতরে, এই আশ্চর্য বিষয় আমাদের সমাজমাধ্যমই প্রত্যক্ষ করালো, যেখানে কিনা তথাকথিত প্রগতিশীলদের বিচরণ বলেই মনে করা হয়।
হবে নাই বা কেন! আজও, এমনকি আমরা মেয়েরাও, অন্য এক নারীকে বিচার করার সময় তার রূপবর্ণনা দিয়েই শুরু করি। কোনও নারী বৃদ্ধা হলেও, যৌবনে তিনি সুন্দরী ছিলেন কি ছিলেন না তা নিয়ে টিপ্পনী কাটি। কোনও মেয়েকে সঠিক ভাবে চিহ্নিত করতে সে ফর্সা না কালো, তা নিয়ে বেশি ভাবি, অন্য যে কোন ক্ষেত্রে, তা বৌদ্ধিক, প্রতিভাগত, গুণগত– যে কোন ধরনের সক্ষমতা তাঁর থাকুক বা না থাকুক। আমরা, এমনকি মেয়েরাও, একটা ধর্ষণের ঘটনা শুনে বলি, “সামনের খাবার থাকলেই কি তা টেনে খেয়ে নেওয়া যায়?” অর্থাৎ পুরুষের লালসা তো বৈধ, শুধু ধর্ষণটাই যা একটু অসংযম হয়েছে।
এই দেখা আমাদের শিখিয়ে দেয় আমাদের সমাজই। সেই সমাজই ভিক্টিম ব্লেমিং করে, সেই সমাজই মুখে অ্যাসিডের তহেলকা মচানো মেয়ের মুখ ঘোমটা ওড়না বা চুলে ঢাকা থাকলে কদর্যতা কতটা দেখতে চেয়ে বলে ওঠে, ‘মুখটা একবার দেখি তো!’ তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করে আঘাতের বীভৎসতা। পরিত্যাগ করে অ্যাসিড আক্রান্তার সংসর্গ, তার ছোঁয়া বাঁচিয়ে চলে কুষ্ঠরোগীর মত। তাকে নিয়ে গসিপ করে। ক্রমশ সে প্রথম আঘাতের পর দ্বিতীয় ও তৃতীয় আঘাত পেতে পেতে বোবা হয়ে যায়।
শোভন-বৈশাখীর প্রথম ফ্যাশন শ্যুট, দ্য ওয়ালের পর্দায় সাড়া ফেলল রঙিন জুটির পুজোর সাজ
আসলে আমরাও এ সমাজের পোটেনশিয়াল আক্রমণকারী। এ কথা বোঝার দরকার আছে। আমরাও সুন্দরী মেয়েদের দিকে ঈর্ষায় তাকাই আর বৃদ্ধা অভিনেত্রীদের দেখে চুকচুক করে করুণা ও সমবেদনা দিই। মুখমণ্ডলের শোভাই সব, একথা সজোরে বলি (কী যেন বলে, সুন্দর মুখের জয় সর্বত্র!)… আপিস থেকে সাহিত্যপাঠের আসর– সর্বত্র আমরা মানি, যে কেউই আসলে নিজের গুণের জোরে সফল নয়, মুখমণ্ডলের সৌন্দর্যের কারণেই সুযোগ পেয়েছে। তবে সেটা অবশ্যই যদি সে মেয়ে হয়। আমরাই তাকভর্তি বিউটি প্রডাক্ট কিনি মুখের শোভা বাড়াতে, আমরাই আমাদের সেলফি অপছন্দ হলে চটপট ডিলিট করি।
তাই সাম্প্রতিক ভিডিওতেও যে মহিলার নৃত্য ঘিরে ট্রোলিংয়ের উল্লাসমঞ্চ গড়ে উঠেছে, তা অসহনীয় হলেও একেবারে অপ্রত্যাশিত নয় এই সমাজে এবং সমাজমাধ্যমে।