Latest News

প্রণববাবুর সঙ্গে স্নেহের বন্ধন ছিল আমার, ওঁকে অভিভাবক হিসেবে পেয়েছিলাম: চন্দ্রশেখর

চন্দ্রশেখর ঘোষ
(বন্ধন ব্যাঙ্কের প্রতিষ্ঠাতা ও সিইও)

সেই বছর দুর্গাপুজোয় প্রণব মুখোপাধ্যায়ের গ্রামের বাড়ির পুজোয় নিমন্ত্রিত ছিলাম আমি। বিকেলবেলা আমি গিয়ে পৌঁছতেই আমায় আপ্যায়ন করলেন আন্তরিক ভাবে। “এসো এসো চন্দ্রশেখর” বলে বুকে জড়িয়ে ধরলেন আমায়। ওঁর আত্মীয় পরিজনেরাও সকলে ছিলেন তখন সামনেই। আমি কোনও দিনও ভুলব না, সেদিন উনি আমার সম্পর্কে সকলকে বলেছিলেন, “সবাই বলে গ্রামের গরিব মানুষরা নাকি ঋণ নিলে তা ফেরত দেয় না। কিন্তু চন্দ্রশেখর সেই গ্রামের মানুষকে অভ্যাস করিয়েছে, টাকা নিয়ে তা পরিশোধ করার। ওরা খুব ভাল কাজ করছে এই নিয়ে।”

তবে প্রণববাবুর স্নেহের স্পর্শ যে সেই প্রথম ছিল, তা নয়। কাজের জন্য প্রশংসা এবং স্নেহ আমি বারবারই পেয়েছি একসময়ের অর্থমন্ত্রী ও প্রাক্তন রাষ্ট্রমন্ত্রী প্রণব মুখোপাধ্যায়ের কাছে। আমার সঙ্গে ওঁর প্রথম পরিচয় হয়েছিল মুর্শিদাবাদের জঙ্গিপুরে। সালটা ২০০৮। উনি তখন দেশের অর্থমন্ত্রী। ক্ষুদ্র শিল্প উন্নয়ন ব্যাঙ্কের ম্যানেজিং ডিরেক্টর আরএম মোল্লার সঙ্গে কাজের সূত্রে প্রণববাবুর কাছে গিয়েছিলাম আমি। সেইবারই বন্ধন নিয়ে আমার সমস্ত আইডিয়া, পরিকল্পনা, কাজকর্মের কথা খুলে বলি। অত্যন্ত মনোযোগ সহকারে উনিও শোনেন সমস্ত কর্মকাণ্ডের কথা। সব শুনে খুশি হয়েছিলেন প্রণববাবু, আমায় উৎসাহ দিয়েছিলেন।

এর পরে দ্বিতীয় বার ফের আমার সুযোগ হয় ওঁর সান্নিধ্য পাওয়ার। সেটা ২০১০ সালের অক্টোবর মাস। তখন বন্ধনের ঋণগ্রহীতাদের নতুন একটি পরিষেবা দেওয়া শুরু হয়, একটি নতুন পেনশন স্কিমের মাধ্যমে। স্বাবলম্বন স্কিম চালু হওয়ার সেই অনুষ্ঠানে উনি নিজেই আমাদের সমস্ত ঋণগ্রহীতার হাতে সংস্থার তরফে ইস্যু করা ‘প্রাণ কার্ড’ তুলে দেন এবং অনুষ্ঠানের উদ্বোধনও করেন।

শুধু তাই নয়, উনি নিজে এই বিষয়টা নিয়ে এতই উৎসাহী ছিলেন যে নিজেই গ্রামের মানুষদের সঙ্গে কথাবার্তা বলে জানতে পেরেছিলেন, বন্ধনের থেকে ক্ষুদ্র ঋণ নিয়ে কীভাবে তাঁরা ও তাঁদের পরিবার উপকৃত হয়েছে। সবটা জানার পরে বেশ সন্তুষ্ট হন তিনি। তার উপর, সেই সময়ে মাইক্রো ফিনান্স ইন্ডাস্ট্রি সবচেয়ে বড় এক সমস্যার মুখোমুখি হয়। চতুর্দিকে যখন মাইক্রো ফিনান্স প্রতিষ্ঠানকে সকলে তুলনা করছেন চড়া সুদের মহাজনদের সঙ্গে, তখন প্রণববাবুই সাধারণ মানুষকে বুঝিয়ে বলেন, বন্ধন একটা পৃথক সংস্থা। তারা প্রতি বছর সুদের হার কমায় এবং একই সঙ্গে অর্থনৈতিক ভাবে পিছিয়ে পড়া মানুষদের আরও বেশি করে তাদের ক্ষুদ্র ঋণ প্রকল্পের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করে। উনি বলেছিলেন, “বন্ধন ইজ় আ ডিফারেন্ট ইনস্টিটিউশন ইন মাইক্রো ফিনান্স স্পেস।”

এর পরে বন্ধনের জন্য আরও বড় একটা সুযোগ এসে যায়। ২০১০ সালের বাজেটের বক্তৃতায় তৎকালীন অর্থমন্ত্রী প্রণববাবু ঘোষণা করেন নতুন ব্যাঙ্ক তৈরি করার অনুমোদন পাওয়ার কথা। এর পরে কাঙ্ক্ষিত আয়-ব্যয়ের বিস্তারিত খতিয়ান-সহ একটি গাইডলাইনও ইস্যু করেন তিনি। তৎকালীন ঋণদাতা সংস্থা হিসেবে নথিভুক্ত বন্ধন সেই ব্যাঙ্কের অনুমোদন পাওয়ার জন্য যাবতীয় গাইডলাইনের আওতায় অন্তর্ভুক্ত ছিল। সেই মতোই অনুমোদনের জন্য আবেদন করা হয় সে বছরই।

বন্ধনের তরফে ব্যাঙ্ক লাইসেন্স চাওয়ার পরের দিনই প্রণববাবুর অফিস থেকে ফোন এসেছিল আমার কাছে। তখন উনি রাষ্ট্রপতি। ফোনে বলেন, তিনি খুবই খুশি হয়েছেন বন্ধন ব্যাঙ্ক লাইসেন্স চাওয়াতে। ওঁর অ্যাপয়েন্টমেন্ট নিয়ে সে সময়ে রাষ্ট্রপতি ভবনে গিয়ে দেখাও করি আমি। প্রণববাবুর সঙ্গে বিস্তারিত আলোচনা হয় নতুন ব্যাঙ্ক বন্ধনের সম্পর্কে। উনি তখন বলেছিলেন, “তোমরা যে কাজটা করছো তা মানুষের উপকারের জন্য করছো। আমি গর্বিত তোমায় নিয়ে। আমি গর্বিত বাংলার জন্য।” প্রণববাবুর সঙ্গে এতটাই স্নেহের বন্ধন ছিল আমার। অভিভাবকের মতোই গাইড করেছেন সবসময়।

এর পরেও উনি প্রায়ই খবর নিতেন বন্ধনের ব্যাপারে। এক সময়ে বন্ধন ব্যাঙ্ক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করার জন্য প্রস্তুত হলে আমরা ওঁকে অনুরোধ জানাই ব্যাঙ্ক উদ্বোধনের জন্য। উনি রাজিও হন আমাদের অনুরোধে। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত, সেবার পারিবারিক এক বিপর্যয় ঘটে যাওয়ায় তিনি ব্যাঙ্ক উদ্বোধন করতে আসতে পারেননি। তবে পরের বছর বন্ধন ব্যাঙ্কের প্রথম বর্ষপূর্তিতে উনি এসেছিলেন এবং ওঁর বক্তৃতায় বলেছিলেন, “বন্ধন সংস্থা ব্যাঙ্ক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করায় আমি খুব খুশি হয়েছি। আমার আশা, গ্রামীণ অর্থনীতিতে এখনও যে বড় ফাঁকা জায়গাটি রয়েছে, সেটা বন্ধন ব্যাঙ্ক হওয়াতে পূর্ণ হবে।”

অনেক কিছুই মনে পড়ছে আজ। যত মনে পড়ছে তত বুঝতে পারছি, অর্থমন্ত্রী হিসেবে বা রাষ্ট্রপতি হিসেবে ওঁকে আমরা যতটা না পেয়েছি, তার চেয়ে বেশি পেয়েছি একজন বুদ্ধিমান, বিচক্ষণ, হৃদয়বান মানুষ হিসেবে। একসময়ে এমন হয়েছিল, ওঁকে কোনও কিছু বলার আগেই উনি ধরে ফেলতে পারতেন কী বলব। বন্ধনের কাজকর্ম নিয়ে সবসময় উৎসাহ দিতেন উনি। তবে এই দুঃসহ শেষের সময়টায় ওঁর কাছে যেতে পারলাম না। উনি চলে গেলেন।

You might also like