শেষ আপডেট: 28th September 2023 12:50
একদা ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ডের সভাপতি ছিলেন শরদ গোবিন্দরাও পওয়ার। তাঁর জন্ম মহারাষ্ট্রের বারামতীতে। ভারতে যে ওয়াইন তৈরি হয়, তার জন্য অর্ধেকের বেশি আঙুর উৎপাদিত ও সরবরাহ হয় এই বারামতী আর উত্তর নাসিক থেকে। অনেকে হয়তো জানেন না, পওয়ারের নামে বারামতীতে আঙুরের একটি প্রজাতিও রয়েছে। তার নাম ‘শরদ সিডলেস’।
বারামতীর মাই-বাপ হলেন পওয়ার। সেখানে জল, কল, রাস্তা, কারখানা, কলেজ—সবই তাঁর দৌলতে। শুধু আঙুর কেন, পুণের কাছে এই জনপদের জন্য পওয়ারের অবদান এতটাই যে বারমতীর নাম বদলে ‘শরদ শহর’ও করা যায়।
এই প্রতিবেদনের সঙ্গে অবশ্য পওয়ারের তেমন সম্পর্ক নেই। কিন্তু সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়কে নিয়ে ইদানীং বাংলার রাজনীতি যেরকম আন্দোলিত তাতে মনে হচ্ছে, শরদ পওয়ারের মতই সৌরভের নামেও একটি আঙুরের প্রজাতির নামকরণ করা যায়। তবে তা টক আঙুর।
মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে সম্প্রতি স্পেন সফরে গিয়েছিলেন সৌরভ। মাদ্রিদে বেঙ্গল গ্লোবাল বিজনেস সামিটের মঞ্চে তিনি ঘোষণা করেছেন, শালবনীতে নতুন ইস্পাত কারখানা গড়ে তুলবেন তিনি। আড়াই হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ হবে। তাতে প্রায় ৬ হাজার লোকের কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি হবে। সৌরভ এও জানিয়েছেন, রাজ্য সরকার মাত্র চার মাসের মধ্যেই জমির বন্দোবস্ত করে দিয়েছে। অর্থাৎ বাংলায় ‘ইজ অফ ডুয়িং বিজনেস’ রয়েছে।
সৌরভের এই ঘোষণার পর দেখা যায়, বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী পষ্টাপষ্টিই সৌরভকে ধান্দাবাজ বলেছেন। সেই সঙ্গে শুভেন্দু ভবিষ্যৎ দর্শন করে জানিয়ে দিয়েছেন, শালবনীতে কিচ্ছু হবে না। কংগ্রেস বা বাম নেতারা ততটা পরিস্কার করে কিছু বলেননি। তবে হ্যাঁ, সোশাল মিডিয়ায় বহু বামপন্থীকে এই প্রশ্ন তুলতে দেখা গিয়েছে যে, বাংলায় শিল্প হবে, সেটা স্পেনে গিয়ে কেন ঘোষণা করলেন সৌরভ। সেই প্রশ্ন নিখাদ কৌতূহল নয়, আসলে তাঁর মধ্যেও খোঁচা রয়েছে। এবং বোঝানোর চেষ্টা রয়েছে যে সৌরভ সুবিধাবাদী।
সৌরভ কেন স্পেনে বিনিয়োগের কথা ঘোষণা করেছেন তা কোনও রহস্য গল্প নয়। বিনিয়োগকারীরা সব সময়েই সরকারের থেকে সুবিধা চান। আবার সরকারও বিনিয়োগ টানার মাধ্যমে কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরির উদ্দেশে তা যথাসম্ভব দেওয়ার চেষ্টা করে। এই সহজ সমীকরণ ভারতের সর্বত্রই রয়েছে। তা সীমার বাইরে গেলে তবেই বিতর্ক হয়।
সন্দেহ নেই বিনিয়োগকারী সৌরভকে শালবনীতে কারখানা গড়তে কিছু সুবিধা বা সুযোগ দিচ্ছে সরকার বা দেওয়ার অঙ্গীকার করেছে। সৌরভও প্রতিদানে স্পেনের মঞ্চে দাঁড়িয়ে আন্তর্জাতিক লগ্নিকারীদের বাংলায় বিনিয়োগ নিয়ে কনফিডেন্স জোগাতে চেয়েছেন। সেই সঙ্গে বোঝাতে চেয়েছেন যে, বাংলায় কেউ বিনিয়োগ করতে চাইলে সরকার সবরকম সাহায্য করতে প্রস্তুত। এতে স্পেনে মঞ্চে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়েরও কিছুটা সুবিধা রয়েছে। সৌরভ এখনও একটি আন্তর্জাতিক ব্র্যান্ড। এমন একটি ব্র্যান্ড বাংলার সম্ভাবনা নিয়ে সরকারের পাশে দাঁড়িয়ে যদি সমান গর্বের সঙ্গে কথা বলেন, তা ইতিবাচক বইকি।
সৌরভ ও মমতার এই পারস্পরিক বোঝাপড়া সর্বশেষ গাত্রদাহর কারণ হয়ে উঠেছে। বাংলায় একটা নতুন কারাখানা হবে, এটা অনেকের কাছে যেন আগ্রহের বিষয়ই নয়। শিল্পে বিনিয়োগ নিয়ে গত প্রায় দু’দশক ধরে বাংলায় যে নিরবচ্ছিন্ন খরা দেখা যাচ্ছে, তাতে মরীচিকা হলেও কিছুটা একটা ভেসে উঠেছে, সেটাও আনন্দের ব্যাপার না। তাঁদের কাছে অগ্রাধিকার হয়ে দাঁড়িয়েছে, সৌরভ কতটা সুবিধা পেলেন, আর এতে মমতার রাজনৈতিক কী কী সুবিধা হল।
আসলে সৌরভ বরাবরই একটা আঙুর ফলের নাম। একদা এই ব্র্যান্ডের সুবিধা নিতে চেয়েছেন বামেরা। অশোক ভট্টাচার্যের সঙ্গে সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়ের সম্পর্কের কথা সুবিদিত। সিপিএম কখনও সৌরভকে তাঁদের দলে নাম লেখাতে বলেনি। আশা করেনি সৌরভ তাঁদের প্রার্থী হবেন। কিন্তু গোটা বাংলা জুড়ে অতিশয় জনপ্রিয় সৌরভের সঙ্গে তাঁদের যে একটা সহজ সম্পর্ক রয়েছে সেটা তাঁদের জন্য কোনও না কোনওভাবে ইতিবাচক বার্তা তো দিয়েই ছিল। বিভিন্ন অনুষ্ঠানে সৌরভকে আমন্ত্রণ করে নিয়ে যেতেন অশোক ভট্টাচার্য। সেদিন আঙুর ফল টক ছিল তৃণমূলের কাছে।
কেন্দ্রে মোদী জমানায় সৌরভের সঙ্গে সখ্য গড়তে নামে বিজেপি। তারা বুঝেছিল, সৌরভকে নিয়ে বাঙালিদের একটা আবেগ রয়েছে। তাই তাঁকে এক ফ্রেমে টানতে পারলে বাঙালিদের কাছে বিজেপি সম্পর্কে একটা পজিটিভ মেসেজ যাবে। এটা ঠিক যে অমিত শাহী আশীর্ব্বাদ না থাকলে সৌরভ ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ডের সভাপতি হতে পারতেন না। কিন্তু এও ঠিক সেই আগ্রহটা অমিত শাহদের তরফ থেকেও ছিল। সৌরভকে বোর্ড সভাপতি করে বাংলায় বার্তা দিতে চেয়েছিলেন অমিত শাহরা।
একুশের বিধানসভা ভোটের আগে সপার্ষদ অমিত শাহ নৈশভোজে চলে গিয়েছেন সৌরভের বাড়িতে। শুভেন্দুরা তখন উৎকণ্ঠায় পড়ে গিয়েছিলেন যে সৌরভ মুখ্যমন্ত্রী পদপ্রার্থী হয়ে যাবেন কিনা। সৌরভের সঙ্গে এর আগে অশোক ভট্টাচার্যদের যে নিবিড় সম্পর্ক ছিল, তা নিশ্চয়ই তখনও অজানা ছিল না অমিত শাহর।
সৌরভ-অমিত শাহদের এই সম্পর্ক যে তৃণমূলের ভাল লাগেনি, তা সেই সময়ে কুণাল ঘোষের মতো নেতাদের সোশাল পোস্ট দেখলেই বোঝা যাবে। বামেরাও তখন প্রতিক্রিয়া জানিয়েছিলেন। এমনকি কদিন আগে বিজেপি শাসিত ত্রিপুরার পর্যটনের জন্য যখন সৌরভকে ব্র্যান্ড অ্যাম্বাস্যাডর করা হয়, সেদিনও তাঁকে খোঁচা দিয়ে টুইট করেছিলেন কুণাল। আর এখন সৌরভকে ধান্দাবাজ বলছেন শুভেন্দুরা।
অর্থাৎ সৌরভ বরাবরই কারও না কারও কাছে টক আঙুর। সৌরভ তাঁদের সঙ্গে জুড়ে থাকলে ভাল, অন্যদের পাশে গিয়ে বসলে কালো, ধান্দাবাজ, সুবিধাবাদী ইত্যাদি।
সৌরভকে নিয়ে এখনও লক্ষ, কোটি বাঙালির আবেগ অটুট রয়েছে। লর্ডসে তাঁর যে দাদাগিরি, অনেক বাঙালি মনে করেন এ আমাদের জাতেরই দাদাগিরি। যেন গোটা জাতিই সেদিন জার্সি খুলে হাওয়ায় ঘুরিয়েছিল। কিন্তু এও ঠিক, সৌরভ তো দাতব্য চিকিৎসাকেন্দ্র খুলে বসেননি। আর পাঁচটা ক্রিকেটারের মতো তিনি এনডোর্সমেন্ট বাবদ রোজগার করেছেন, টিভিতে রিয়েলিটি শো থেকে রোজগার করেছেন। সেই সঙ্গে নিজের ব্যবসায় মন দিয়েছেন। এতে অন্যায় কোথায়।
তা ছাড়া কোনও ব্যবসায়ীই চান না কোনও রাজনৈতিক দলের সঙ্গে বৈরীতার সম্পর্ক রাখতে। কারণ ভারতের ঘরোয়া বাণিজ্যিক পরিবেশটাই তাই। সৌরভও মঙ্গলগ্রহ থেকে আসেননি। তাঁকে ব্যবসা করতে গেলে সেই পরিবেশেই করতে হবে। এই সত্যটা সৌরভের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। এটা সহজ ভাবে মেনে নিলেই কাউকে আলাদা করে ধান্দাবাজ বা সুবিধাবাদী মনে হবে না।