সোমা লাহিড়ী
গুণী মানুষরা বুঝি এমনই হন। তিনি গীতশ্রী, তিনি কোকিলকণ্ঠী, তিনি কিংবদন্তী সঙ্গীতশিল্পী সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়। অথচ সেদিন যখন তাঁর লেক গার্ডেন্সের বাড়িতে পৌঁছলাম, মনে হল যেন তিনি আমার কত দিনের আপনজন। দোতলার সিঁড়ির মুখে দাঁড়িয়ে একেবার
গুণী মানুষরা বুঝি এমনই হন। তিনি গীতশ্রী, তিনি কোকিলকণ্ঠী, তিনি কিংবদন্তী সঙ্গীতশিল্পী সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়। অথচ সেদিন যখন তাঁর লেক গার্ডেন্সের বাড়িতে পৌঁছলাম, মনে হল যেন তিনি আমার কত দিনের আপনজন। দোতলার সিঁড়ির মুখে দাঁড়িয়ে একেবারে মায়ের মতো আদর করে ডাকলেন আমাদের। বসার ঘরে বসালেন যত্ন করে। অবাক হয়ে তাকিয়েছিলাম সেই কিংবদন্তীর দিকে। মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে শুনছিলাম তাঁর গল্প।
ঘটনাটা বছর পাঁচেক আগের। তখন আমি বর্তমান 'সুখী গৃহকোণ' পত্রিকার সম্পাদক। একদিন শুভাদি (বর্তমান পত্রিকার সম্পাদক প্রয়াত শুভা দত্ত) আমাকে বললেন, 'চলো, কাল একবার সন্ধ্যাদির সঙ্গে দেখা করে আসি। সুমন ওঁকে জানিয়ে রাখবেন।'
সুমন মানে সাংবাদিক সুমন গুপ্ত, সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের খুবই কাছের মানুষ। সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের আত্মজীবনী 'গানে মোর কোন ইন্দ্রধনু' অনুলিখন করেছেন সুমনদা। একেবারে নিজের ভাইয়ের মতো। ওঁর ওপর খুব নির্ভরও করতেন সন্ধ্যাদি। আমি নিজে শুনেছি, কোনও একটা বিতর্কিত বিষয়ে একটা নামী টিভি চ্যানেল ওঁর বক্তব্য জানতে চেয়েছে, উনি সুমনদাকে ফোন করে জানতে চাইছেন, "কী বললে ভালো হয় বলে দাও সুমন"। এতটাই বিশ্বাস তাঁর।
যাই হোক, সুমনদার সঙ্গে আমি আর শুভাদি পৌঁছলাম কিন্নরকণ্ঠীর বাড়ি। তখন সকাল দশটা। দোতলার সিঁড়ির মুখে দাঁড়িয়ে শুভাদিকে সতর্ক করলেন, 'সাবধানে ওঠো।'
বসার ঘরে ঢুকে মনে হল যেন শান্তির আলয়। কোনও বাহুল্য নেই, একেবারে সাধারণ ঘরের সাজ। আসবাব থেকে পর্দা- সবই দৃষ্টিনন্দন, অথচ অত্যন্ত সাধাসিধে। এখনও মনে আছে গেরুয়া রঙের হ্যান্ডলুমের পর্দা লাগানো ছিল দরজা জানলায়। আর কাঠের পালিশ করা কৌচের সামনে দামি কার্পেট নয়, মেঝেতে পাতা ছিল খুব রুচিসম্মত একটা মাদুর। অতি আটপৌরে সাজে রয়েছেন সন্ধ্যাদিও। খড়কে ডুরে মাঝারি চওড়া রেশমি পাড়ের টাঙ্গাইল শাড়ির আঁচল গায়ে জড়িয়ে নিয়েছেন, কানে ছোট্ট হিরের ফুল, দু'হাতে সরু সোনার চুড়ি। মনে হল, চশমার ভেতর থেকে হাসিমাখা উজ্জ্বল দুটি চোখ যেন গাইছে, ওরে আয় আয়... চল নেব লুটি ওই আনন্দ ঝরনা। পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করতেই মাথায় হাত ছুঁইয়ে আশীর্বাদ করলেন। শিহরণ সারা শরীরে। মনটা ভরে গেল আনন্দে। এমন একজন কিংবদন্তী শিল্পীর স্পর্শ পেয়ে নিজেকে ধন্য মনে হচ্ছিল।সেদিন অনেক গল্প করছিলেন সন্ধ্যাদি। ছোটবেলার কথা, ঢাকুরিয়ার বাপের বাড়ির কথা, ওঁর মায়ের গাওয়া টপ্পা গানের কথা- বলতে বলতে যেন ছোট্ট বালিকার মতো নির্মল হাসিতে ভরিয়ে তুলছিলেন ঘর। চোখের পলক পড়ছিল না। শুভাদি হঠাৎ বললেন, ' আমরা কি দু'এক কলি গান শুনব সন্ধ্যাদি?'
অদ্ভুত মায়াবি একটা আলো খেলে গেল মুখে। কিছুক্ষণ সবাই চুপ। ভেসে এল সেই কোকিল কণ্ঠ, ' চন্দন পালঙ্কে শুয়ে একা একা কী হবে, জীবনে তোমায় যদি পেলাম না...'
গানের রেশ তখনও ফুরোয়নি, ঘরের দরজার কাছে খুটখাট আওয়াজ হল। 'ও! চা হয়ে গেছে' বলতে বলতে দ্রুত পায়ে উঠে গেলেন সন্ধ্যাদি। কে বলবে বয়েস ছিয়াশি! তারপর কাজের মেয়েটির হাত থেকে চায়ের কাপ সাজানো ট্রেটা নিয়ে সেন্টার টেবিলের দিকে আসছেন দেখে আমি উঠে গেলাম। ওঁর হাত থেকে ট্রেটা নিতে চাইলাম। মিষ্টি হেসে বললেন, 'এটুকু এখনও পারি। নিজে হাতে খাইয়ে তৃপ্তি পাই। তাও তো এখন সব কেনা খাবার খাওয়াতে হয়।' নোনতা মিষ্টি খাবার দেওয়া প্লেট আমাদের তিন জনের হাতে তুলে দিয়ে বসলেন নিজের চেয়ারে। স্নেহময়ী দিদি আবার গল্প করতে লাগলেন।স্বনামধন্য অভিনেত্রী সুচিত্রা সেনের লিপের প্রায় সব গানই ছিল সন্ধ্যাদির গাওয়া। মহানায়িকার সঙ্গে তাঁর কেমন সম্পর্ক ছিল জানতে চাইতেই সন্ধ্যাদির চোখটা ছলছল করে উঠল। কিছুদিন আগেই সুচিত্রা প্রয়াত হয়েছিলেন। সেকথা বলতে বলতেই বলছিলেন সুচিত্রার আধ্যাত্ম-চেতনার কথা, শ্রীরামকৃষ্ণদেবের প্রতি তাঁর অপার বিশ্বাসের কথা। 'সেই সময় শ্রীরামকৃষ্ণ মঠ ও মিশনের অধ্যক্ষ ছিলেন ভরত মহারাজ। সুচিত্রা ভরত মহারাজের খুব স্নেহধন্য ছিলেন। ভরত মহারাজ আমার গান শুনতে ভালবাসতেন। উনি সুচিত্রাকে বলেছিলেন আমাকে দেখতে চান। তাই সুচিত্রা আমাদের দুজনকে (সন্ধ্যাদির স্বামী প্রখ্যাত সুরকার শ্যামল গুপ্ত) নিজের গাড়ি করে বেলুড় মঠে নিয়ে গেছিল। মহারাজ শ্রী সারদা মায়ের একটা ছবি দিয়েছিলেন। এখনও সেই ছবি আমার ঠাকুরঘরে রয়েছে। চলো, তোমাদের আমার ঠাকুরঘর দেখিয়ে আনি।'
দুই কিংবদন্তীর গল্পের রেশ ধরে যেন স্বপ্নের দেশে পাড়ি দিয়েছিলাম। দিদির সঙ্গে সঙ্গে কখন যে ওঁর ঠাকুরঘরে পৌছে গেছি বুঝতেই পারিনি। চন্দনের সুবাসে ঘোর কাটল। যতদূর মনে পড়ছে ঠাকুরের আসনে দেখেছি মা সরস্বতী আর শ্রীকৃষ্ণকে।
সুমনদা বলছিলেন, এই ঠাকুরঘরেই দিদি রোজ রেওয়াজ করেন।
এখনও রোজ রেওয়াজ করেন ?!
অদ্ভুত একটা স্বর্গীয় আলো দিদির চোখেমুখে। শান্ত গলায় বললেন, 'গান আমার কাছে পুজো, ঈশ্বরের কাছে সমর্পণ। যতদিন পারব...' শুনলাম, গুনগুন করছেন, "তোমার পূজার ছলেই তোমায় ভুলে থাকি..."
ঘড়ির কাঁটা বারোটা ছুঁয়েছে। শুভাদি বললেন, এবার আমাদের উঠতে হবে। সুমনদাকে বললাম, মোবাইলে সন্ধ্যাদির সঙ্গে আমাদের ছবি তুলে দিতে। একেবারে ছোট্ট মেয়ের মতো হইহই করে উঠলেন, "সুমন ও যখন বলছে, তখন ছবি তুলে দাও।"পাশে বসিয়ে হাত ধরে বেশ পোজ দিয়ে ছবি তুললেন দিদি। ভাবতেই পারছিলাম না, এত বড় মাপের একজন শিল্পী এত মাটির মানুষ!
আরও বিস্ময় বাকি ছিল।
উঠতে যাচ্ছি সন্ধ্যাদি বললেন, তুমি প্রথম আমার বাড়িতে এলে তোমাকে কী দিই বলো তো? নতুন বই তো এখনও পাইনি, পুরনো একটা বই আছে, নেবে?
আমি তো হতভম্ব। কোনওক্রমে বললাম, "কী বলছেন দিদি, এ তো আমার পরম সৌভাগ্য।"
সন্ধ্যাদি আবার তরতর করে উঠে গেলেন। একটা বই আর কলম নিয়ে এসে বসলেন। আত্মজীবনীর পাতা খুলে জিগ্গেস করলেন, "তোমার বরের নাম কী?"' নামটা বলতেই যত্ন করে শুভেচ্ছাবার্তা লিখে বইটা হতে দিলেন। মিষ্টি হেসে বললেন, "আবার এসো।"লোভ সামলাতে পারলাম না। আবার পা ছুঁয়ে প্রণাম করলাম। আবার মাথায় সেই স্নেহস্পর্শ পেলাম। আবার সেই বিদ্যুৎ তরঙ্গ খেলে গেল শরীরে।
আর কখনও যাওয়া হয়নি। তবে ওই দিনটা মনের গভীরে রয়েছে পরম আদরে অতি যত্নে।