১৯৭৪ সালে ইন্দিরা গান্ধী সরকারের স্লোগান 'রোটি কাপড়া মকান'-এর কথা ছবিতে তুলে ধরেছিলেন মনোজ কুমার।
শেষ আপডেট: 17th July 2024 16:26
দ্য ওয়াল ব্যুরো: রুটি, কাপড়, মাথার ওপর ছাদ! ১৯৬৭ সালের সাধারণ নির্বাচনের আগে এই ছিল ইন্দিরা গান্ধীর স্লোগান। ১৯৬৬ সাল। ভারত-চিন যুদ্ধের স্মৃতি তখনও ফিকে হয়নি। উত্তর-পূর্ব সীমান্তে দুরমুশ হয়ে গিয়েছিল ভারত। সেই রেশ কাটতে না কাটতেই '৬৫-এর ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ। বলা হয়ে থাকে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে হওয়া প্রথম বড়মাপের ট্যাঙ্ক যুদ্ধ! কার্যত বেহাল অবস্থা দেশের অর্থনীতির। পশ্চিমবঙ্গে তীব্র হয়েছে খাদ্য আন্দোলন। এই অবস্থায় তাসখন্দে গিয়ে অকস্মাৎ রহস্যজনকভাবে মারা গেলেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী লালবাহাদুর শাস্ত্রী! কংগ্রেসের রাজনীতিতেও টালমাটাল। প্রধানমন্ত্রীর দৌড়ে নেমে পড়েছেন মোরারজি দেশাই। অথচ কংগ্রেস সভাপতি কামরাজের সাফ কথা, মোরারজিকে প্রধানমন্ত্রী করা যাবে না।
এই অবস্থায় প্রথম দেশের শীর্ষ পদে বসা ইন্দিরা গান্ধীর। রাজনীতিতে অনভিজ্ঞ। জওহরলাল নেহরুর সঙ্গে এদিক সেদিক গিয়েছেন, কিন্তু ওই অবধিই। বিরোধীরা খোঁচা মারত, 'গুঙ্গি গুড়িয়া' বলে। অথচ ভারতীয় রাজনীতির স্নায়ুকেন্দ্রটা প্রথম নির্বাচনেই একেবারে ঠিকমত ধরতে পেরেছিলেন ইন্দিরা। স্লোগান তুলেছিলেন তিন শব্দের। 'রোটি', 'কাপড়া', 'মকান'।
সেবারের নির্বাচনে ক্ষমতা ধরে রেখেছিল কংগ্রেস। যদিও আসন সামান্য কমেছিল। কিন্তু ইতিহাস পাল্টে যায় তারপরের ১৯৭১ সালের ভোটে। ইন্দিরা গান্ধী স্লোগান তুলেছিলেন, 'গরিবি হঠাও'। লাগামছাড়া দারিদ্র্যের দেশে স্রেফ এই স্লোগানে ভর করেই কার্যত আলোড়ন তুলে জিতেছিল কংগ্রেস। আসন এক ধাক্কায় গিয়ে পৌঁছেছিল ৩৫২-তে।
জনপ্রিয়তায় 'রোটি, কাপড়া, মকান' স্লোগান এমনই বল্গাহীন ছিল যে, ১৯৭৪ সালে এই 'রোটি, কাপড়া, মকান' নাম দিয়েই একটি ছবি করেছিলেন মনোজ কুমার। ৫০ বছর আগে সেই ছবি ছিল বক্স অফিসে সুপারহিট। ওই বছর সবচেয়ে বেশি টাকা কামিয়েছিল ‘রোটি কাপড়া মকান’। অভিনয় করেছিলেন মনোজ কুমার, অমিতাভ বচ্চন, জিনাত আমন, শশী কাপুর। গল্পের নায়ক ভরতের বাবা অবসর নিয়েছেন। এবার ভরতকে পরিবারের দেখাশোনা করতে হবে। দিল্লিতে থাকে, দুই ভাই আছে। এক বোন আছে, তার বিয়ে দিতে হবে। এদিকে ভরতের ভাল রোজগার নেই। গান গায়। এইরকম একটা পরিস্থিতি থেকে গল্প শুরু হয়। পরিস্থিতিটা আমাদের প্রায় সক্কলের চেনা। অবসরের পর ছেলে বা মেয়ে পরিবারের দায়িত্ব নেবে, সব বাবা-মা-ই চান। কিন্তু দায়িত্ব যে নেবে, কাজ কোথায়?
এখন ২০২৪ সাল। পেরিয়ে গিয়েছে পঞ্চাশ বছরেরও বেশি। নরেন্দ্র মোদীরা দাবি করেন, ২০১৪ সালে ভারত পা রেখে ফেলেছে অমৃতকালে। তার আগে অবধি সবই পুরনো। ২০১৪ সাল থেকে নতুন ভারত হয়ে গিয়েছে। সেই ভারত সারা দুনিয়ার বিশ্বগুরু। সেই ভারতে চলে বন্দে ভারত। সেই ভারতে শিল্পপতির ছেলের বিয়েতে কুবেরের ধন খোলামকুচির মত খরচা হয়। দারিদ্র্য ইত্যাদির কথা বলাও পাপ। অথচ ২০২৪ সালে, এই ভারতে, একটি বিমানবন্দরে লোডারের চাকরির জন্য প্রায় পদপিষ্টের মত পরিস্থিতি তৈরি হল। তাও কলকাতা নয়। খাস মুম্বইয়ের ঘটনা!
বিমানবন্দরে বিমান এসে থামলে যে কর্মীরা বিমানের পেট থেকে মালপত্র নামান বা ফিরতি বিমানে মালপত্র তুলতে সাহায্য করেন, তাঁদের বলে 'লোডার'। সম্প্রতি এই লোডারের চাকরির জন্যই বিজ্ঞাপন দিয়েছিল এয়ার ইন্ডিয়া। শূন্যপদ ছিল ২২১৬-টি। কিন্তু আবেদন জমা পড়ে ২৫ হাজারের বেশি। যার ফলে কার্যত হিমশিম খান এয়ার ইন্ডিয়ার কর্মীরা। তীব্র বিশৃঙ্খলা ছড়িয়ে পড়ে। কে কার আগে কাউন্টারে যাবেন ঠিক করতে হুটোপাটি শুরু হয়। এতেই সিঁদুরে মেঘ দেখেন কর্মীরা। পুলিশে খবর দেওয়া হয়। কিন্তু তাতেও বিশৃঙ্খলা থামানো যায়নি। প্রায় পদপিষ্ট হওয়ার মত পরিস্থিতি তৈরি হয়।
কীরকম মাইনে এই চাকরিতে? শোনা গেল, খুব বেশি হলে মেরেকেটে মাসে ২০,০০০ থেকে ২৫,০০০। খাটুনির কাজ। শারীরিকভাবে শক্তপোক্ত হতে হবে। এছাড়া বিশেষ যোগ্যতামান নেই। গড়পড়তা শিক্ষাগত যোগ্যতা থাকলেই হবে। অথচ এই চাকরিতে আবেদন করে রাজস্থান, উত্তরপ্রদেশ, এমনকি বিহার-ঝাড়খণ্ড থেকেও প্রার্থীরা এসেছেন। কেউ বিএ পাশ। কেউ এমকম করেছেন। কেউ বিবিএ পড়ছেন। 'চাকরি পেলে কি পড়াশোনা ছেড়ে দেবে?' একটি সর্বভারতীয় সংবাদমাধ্যম প্রশ্ন রেখেছিল একজনকে। বিবিএ পাঠরত তরুণ জানালেন, 'অবশ্যই। না হলে কী করব? চাকরি কোথায়?' অপর একজন বললেন, 'আমি সরকারি চাকরির জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছি, কিন্তু চাকরি তো নেই। শুনলাম এখানে মাইনে ভাল, তাই চলে এসেছি।'
ইতিমধ্যেই এই ঘটনায় বিজেপির তীব্র সমালোচনা করেছেন মুম্বই নর্থ-সেন্ট্রালের কংগ্রেস সাংসদ বর্ষা গায়কোয়াড়। কিন্তু সাধারণ মানুষের একাংশের মতে, এতে আর অবাক হওয়ার কী আছে? বেকারত্ব দিনের আলোর মতোই স্পষ্ট। চাকরি নেই, নিয়োগ নেই। বহু সরকারি জায়গায় শূন্যপদ খালি। বেসরকারি ক্ষেত্রে ২২ হাজার, ২৫ হাজার টাকা মাইনের চাকরি তো এই বাজারে অনেকের কাছে স্বর্গীয়। লাগামছাড়া মূল্যবৃদ্ধি চলছে। নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের দাম বাড়ছে। ওষুধপত্রের দাম বাড়ছে। অথচ বহু ক্ষেত্রে বেতনের অঙ্ক তলানিতে। বেসরকারি ক্ষেত্রে আট ঘন্টা, নয় ঘন্টা কাজের পরে মাসে ১২ হাজার, ১৫ হাজার টাকা বেতন দেওয়ার ঘটনা আকছার দেখা যায়। ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে নূন্যতম বেতন আইন রয়েছে। গত বছর যেমন দিল্লি সরকার ঘোষণা করেছে, অ-প্রশিক্ষিত কর্মীদের জন্য বেতন মাসে ১৭,৬৯৪ টাকা, আংশিক প্রশিক্ষিতদের জন্য ১৯,২৭৯ টাকা এবং প্রশিক্ষিত কর্মীদের জন্য ২১,২১৫ টাকা করতে হবে। সেখানে পঁচিশ হাজার টাকা মাইনের চাকরির জন্য হুড়োহুড়ি তো অতি স্বাভাবিক।
পাঁচ দশক পেরিয়ে গিয়েছে। আত্মনির্ভর ভারত এখন অমৃতকালে এসে দাঁড়িয়েছে। তবুও অর্ধশতক আগের সেই রোটি কাপড়া মকান এখনও পূর্ণিমার চাঁদের মত ঝলসানো রুটি হয়ে আমাদের তাড়া করে। এও এক ভারতবর্ষ!