সুদেব দে
কলম ধরতে বসে কখন কোন স্মৃতি মাথায় আঁকড়ে ধরে, আগে থেকে বোঝা মুশকিল। তাই ভেবেছি আজ আপনাদের বলব আমার ছেলেবেলায় দেখা আমার সেজকাকুর কথা। তাঁর দুটো জীবন আমি দেখেছি। একটি তাঁর কলকাতার জীবন, আর অন্যটি তাঁর বম্বের জীবন। আমাদের ছোটোবেলায় কা
কলম ধরতে বসে কখন কোন স্মৃতি মাথায় আঁকড়ে ধরে, আগে থেকে বোঝা মুশকিল। তাই ভেবেছি আজ আপনাদের বলব আমার ছেলেবেলায় দেখা আমার সেজকাকুর কথা। তাঁর দুটো জীবন আমি দেখেছি। একটি তাঁর কলকাতার জীবন, আর অন্যটি তাঁর বম্বের জীবন। আমাদের ছোটোবেলায় কাকা যখন কোলকাতায় আসতেন, সেসব দিনের নানার স্মৃতি এখনও আমার মনে উজ্জ্বল হয়ে আছে - সেগুলোর কথাই বলি প্রথমে। আগেও বলেছি, সেজকাকু ভীষণ ডিসিপ্লিনড মানুষ ছিলেন। একটা রুটিন জীবন ছিল তাঁর। রোজ ঘুম থেকে উঠে তিনি এক কাপ লিকার চা খেতেন। শুদ্ধু এক কাপ লিকার চা। আর কিছু না। এই প্রসঙ্গে বলি, আমার মা নীহারিকা দেবী মাত্র বারো বছরে আমাদের বাড়ির বড় বউ হয়ে এসেছিলেন। সেজকাকুর সঙ্গে মায়ের বয়সের ব্যবধান ছিল খুব কম। মায়ের চেয়ে সম্ভবত পাঁচ-ছ'বছরের বড় ছিলেন সেজকাকু। ফলে সেই ছোটোবেলা থেকেই মা আর সেজকাকু, সমবয়সী এই দুজনের মধ্যে দারুণ বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে ওঠে। প্রায় পিঠোপিঠি ভাইবোনের মতো বড় হয়েছেন ওঁরা দুজনে। সেজকাকুকে দেখেছি কখনও মা'কে বড়বৌদি বলে ডাকতেন, কখনও আবার শুধুই বৌদি৷ আবার এই জন্মদাত্রী মা'ই ছিলেন আমার সর্বশক্তির উৎসস্থল। সকালের প্রথম চা-টা সেজকাকুকে বরাবর মা-ই করে দিতেন। আমাদের ছেলেবেলায় বাড়িতে রান্নার জন্য গ্যাস-ট্যাসের তেমন সুবন্দোবস্ত ছিল না মোটেই। একান্নবর্তী বিশাল পরিবারে সেসময় রান্নার জন্য বিরাট বড় বড় দুটো কয়লার উনুন ছিল। বাড়িতে সেসময় প্রায় ত্রিশ জন বাসিন্দা। তাদের চারবেলা রান্নাবান্নার জন্য রান্নার ঠাকুর ছিল আমাদের বাড়িতে। তারপরও দেখেছি মা, ঠাকুমা কাকিমা রোজই বাড়ির মানুষদের জন্য কিছু না কিছু রান্না করতেন। যাক গে, প্রসঙ্গে ফিরি। মায়ের হাতে চা খেয়ে তারপর সেজকাকু বাথরুমে যেতেন। প্রাত্যাহিক কাজকর্ম সেরে ফ্রেশ হয়ে তারপর তিনি রেওয়াজে বসতেন। এই রেওয়াজ মানে কিন্তু কোনও আধুনিক গান বা অন্য গানের চর্চা নয়,তানপুরা নিয়ে পিওরলি ক্ল্যাসিকাল রেওয়াজ, বা রাগসঙ্গীতের রেওয়াজ। সকালে কাকার সেই রেওয়াজ শুনে ঘুম ভাঙত আমাদের। তখন বেশ ছোটো আমি। গান শেখা শুরু হয়নি। অত কিছু বুঝতামও না। কিন্তু সেই ছোটো বয়সেই কাকার ওই অনবদ্য কণ্ঠস্বর, ওই অসামান্য গায়কি আমার প্রাণের মধ্যে একটা অন্যরকম আলোড়ন তুলতো। আমি পড়াশোনা ছেড়ে দিয়ে হাঁ করে শুনতাম সেই রেওয়াজ।
সঙ্গীত আমাকে ছোটোবেলা থেকেই অসম্ভব টানতো। গানের বাড়িতে বড় হলেও আমার নিজের প্রথাগত তালিম শুরু হয়েছিল বেশ একটু দেরিতেই। আমার গান শেখার পর্বটি শুরুর দিকে খুব একটা সুবিধের ছিল না। কেন! সে প্রসঙ্গে আসছি পরে। আগেও বলেছি সম্ভবত, বাবার রেওয়াজ, কাকার রেওয়াজ শুনে বেড়ে ওঠা আমার। খুব ছোটো থেকে গানবাজনার পরিবেশে বড় হয়ে ওঠার জন্যই সম্ভবত আমার সুর আর তালবোধ তৈরি হয়ে গেছিল অনেকটাই। যাকে সঙ্গীতের ভাষায় কান তৈরি হওয়া বলে। গলায় খানিক সুরও ছিল সম্ভবত ঈশ্বরের আশীর্বাদে। 'সম্ভবত'ই বলছি, কারণ গানবাজনা নিয়ে বাড়িতে মোটেও পাত্তা পেতাম না সেসময়। আমি তখন মেট্রোপলিটন ইন্সটিটিউশনে (মেইন) ক্লাস ফোর কি ফাইভে পড়ি। ক্লাসে এমনিতে গানবাজনা করলে মাস্টারমশাইয়েরা রীতিমতো রাগারাগি করতেন। কিন্তু আমার ক্ষেত্রে ছিল একেবারে উলটপুরাণ। যেহেতু ইস্কুলে সবাই আমাদের পারিবারিক পরিচয় জানত, জানত আমি কৃষ্ণচন্দ্র দে'র নাতি, মান্না দে'র ভাইপো - তাই গান গাওয়ার অনুরোধ আসতোই।স্কুলের গ্যালারি রুমে বেঞ্চ বাজিয়ে গান গাইতাম যখন রীতিমতো ভিড় জমে যেত সে ঘরে। এমনকি ইস্কুলের রাগি মাস্টারমশাইরাও গান শুনে আমাকে নানাভাবে এনকারেজ করতেন সেসময়। আমার যে সে সময় গানের কোনও প্রথাগত তালিম ছিল না, এমনকি সরগম অব্দি শিখিনি, সে কথা বিশ্বাসই করত না কেউ। গান শেখার প্রবল ইচ্ছে থাকলেও সে কথা বাড়িতে মুখ ফুটে বলার সাহস ছিল না আমার। আমার বাবা ভীষণই ব্যক্তিত্বসম্পন্ন, গুরুগম্ভীর আর রাশভারি প্রকৃতির মানুষ ছিলেন। এরপর যখন আমি মাধ্যমিক দেব সে সময় একবার সাহস করে মা'কে বলে ফেললাম, মা আমি গান শিখতে চাই। কিন্তু বাবা তো সে কথা প্রায় ফুৎকারেই উড়িয়ে দিলেন। বললেন, "ও কী গানবাজনা করবে? গানবাজনা এত সহজে হয় না। আর আজকালকার দিনে গানবাজনা করে কিছু হয় না।"
আসলে আমাদের বাড়িতে যে ধরনের সিরিয়াস সঙ্গীতচর্চার চল ছিল সেখানে আমরা পাত্তাই পেতাম না। অথচ বাইরে বন্ধুদের আসরে ততদিনে সুগায়ক হিসাবে আমার রীতিমতো পরিচিতি তৈরি হয়েছে। বন্ধুদের বাড়িতে গান-টান গাওয়ার ডাকও আসছে। কিন্তু তখনও প্রথাগতভাবে সঙ্গীত শিক্ষা শুরুই হয়নি আমার। আমার গান শেখার পিছনে যে মানুষটির সবচেয়ে বেশি অবদান, তিনি আমার সেজকাকু মান্না দে।
[caption id="attachment_2390277" align="aligncenter" width="406"]মা নিহারিকা দেবী[/caption]
কাকু তখন প্রতিমাসেই কলকাতায় আসেন রেকর্ডিং ও অন্যান্য কাজে। কাকুর খাওয়াদাওয়ার ভার ছিল মায়ের উপরে। তেমনই একদিন কাকুকে খাবার পরিবেশন করতে করতে মা জানালো আমার গান শেখার প্রবল ইচ্ছের কথা। মায়ের মুখে সব শুনে আমাকে ডেকে পাঠালেন সেজকাকু। সরাসরিই বললেন, "দেখ বাবা, গান শিখতে চাও ভালো কথা। কিন্তু গানবাজনা শেখা চাট্টিখানি কথা নয়। তুমি যদি পড়াশোনায় ভালো রেজাল্ট কর, বোর্ডের পরীক্ষায় যদি হায়ার ফার্স্টডিভিশন পাও, তাহলেই গান শেখার ছাড়পত্র পাবে তুমি। "
অনেকেই ভাবেন 'দে পরিবার'এ জন্মেছি। গান শিখব এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু সত্যি এটাই পরিবারে জন্মেই গান শেখার সুযোগ পাওয়া যেত না। তার জন্য যোগ্যতা অর্জন করতে হত। ভাবলে অবিশ্বাস্য ঠেকবে, কিন্তু মাধ্যমিক পরীক্ষার আগে পর্যন্ত সঙ্গীতের কোনও প্রথাগত তালিম আমি পাইনি। ঈশ্বরের আশীর্বাদে আমি ছাত্র হিসাবে বরাবরই ভালো ছিলাম। ক্লাসে স্ট্যান্ড করতাম। গানবাজনার মধ্যে ঢুকে আমার পড়াশোনার কোনও ক্ষতি হোক, সেটা সেজকাকু চাননি। কিন্তু গান নিয়ে আমার আগ্রহ, আমার মনখারাপ - এগুলোও তাঁর চোখ এড়িয়ে যায়নি। এমনই মানুষ ছিলেন সেজকাকু। নিজেই একদিন বাবার সঙ্গে কথা বললেন আমার তালিমের ব্যাপারে। সেজকাকু কিছু বললে বাবা সে কথা ফেলতে পারতেন না। নিজের ভাইকে একেবারে অন্য চোখে দেখতেন তিনি। সেজকাকুই বাবাকে বললেন "ওর যখন গান শেখার এত ইচ্ছে, তুমি একটু বেসিকটা নিয়ে বোসো না ওর সঙ্গে!" সেই শুরু হল আমার প্রথাগত সঙ্গীত শিক্ষা।যখন গান শিখতে শুরু করলাম, তখন বুঝতে পারলাম কাকা সকালে যে রেওয়াজটা করেন, তা নিখাদ সুরের পারফেকশনের রেওয়াজ। কাকা একেকদিন এক একরকম কম্বিনেশন অফ নোটস নিয়ে গলা সাধতেন। একদিন হয়তো দেখলাম কোমল রে ধা নিয়ে ভৈরব রাগের উপর তিনি সুরবিস্তার করছেন। তারপরই হয়তো উনি নোটসের সামান্য অদলবদল করে ঠাটটা ভৈরব থেকে টোড়িতে নিয়ে গেলেন। মানে টোড়ি রাগে সুরসাধনা শুরু করলেন। সকালের এই রেওয়াজের সময় কাকার হাতে থাকত শুধু একটি তাণপুরা। এই রেওয়াজের যে স্মৃতি আর তার অনুরণন, তা আজও আমাকে ভুলতে দেয় না। আজও সে সব স্মৃতি রোমন্থন করতে বসে অবচেতনে চোখে জল আসে আমার। পূর্বজন্মে অনেক সুকৃতি ছিল, তাই এমন কাকা ভাগ্য করে পেয়েছিলাম।