Date : 14th Jul, 2025 | Call 1800 452 567 | info@thewall.in
চন্দননগরের নামী স্কুলে ছাত্রকে যৌন হেনস্থার অভিযোগ, প্রধান শিক্ষক আটকমুখ্যসচিবের সঙ্গে বৈঠকে সন্তুষ্ট নন চাকরিহারারা, আজকের মধ্যেই 'যোগ্য' তালিকা প্রকাশের দাবিSSC: নতুন নিয়োগ বিধি ঘিরে হাইকোর্টে টানাপড়েন, রায়দান স্থগিত রাখল ডিভিশন বেঞ্চবাইকে বেপরোয়া ধাক্কা মেরে ১০০ মিটার হিঁচড়ে নিয়ে গেল গাড়ি, ভয়াবহ দুর্ঘটনায় মৃত্যু দুই যুবকেরনীতি আয়োগের রিপোর্টে উজ্জ্বল বাংলা, কমেছে বেকারত্ব, উন্নত হয়েছে জীবনমান: মুখ্যমন্ত্রীসন্ধে হলেই জিলিপি-সিঙাড়া? প্রিয় স্ন্যাক্স নিঃশব্দে ডেকে আনছে বিপদ, বলছেন হৃদরোগ বিশেষজ্ঞসোশ্যাল মিডিয়া জুড়ে তন্ময়ের আপত্তিকর ছবি, বরানগর থানায় অভিযোগ দায়ের সিপিএম নেতার'অন্যায় বরদাস্ত নয়', ভিনরাজ্যে বাঙালিদের হেনস্থা ইস্যুতে সকলকে পথে নামার বার্তা মমতারশক্তির উৎসব! কলকাতায় 'শক্তি' সম্মাননার হাত ধরে নারীশক্তিকে কুর্নিশ ‘কল্পবৃক্ষ’-এরপাকিস্তান ক্রিকেট বোর্ডে টাকার খেলা! মহসিন নাকভির নামে কোটি টাকার দুর্নীতির অভিযোগ
Qurbani Eid Fake Video

কুরবানি ইদের পর পার্ক সার্কাসে রক্তনদী? ফেসবুকের বাইরে 'দুষ্টু লোক'দের কীর্তি 'ভ্যানিশ'!

এত বছর ধরে পার্ক সার্কাস এলাকায় আছি, কুরবানির সময় রক্তের নদী বয়ে যেতে দেখিনি কখনও। এখন ফেসবুক থেকে জানতে পারছি রক্তনদীর কথা। মুসলিমদের পশুহত্যার নৃশংসতা বোঝাতেই এই কাল্পনিক নদীর অবতারণা।

কুরবানি ইদের পর পার্ক সার্কাসে রক্তনদী? ফেসবুকের বাইরে 'দুষ্টু লোক'দের কীর্তি 'ভ্যানিশ'!

পার্ক সার্কাসের বাসিন্দা সাবিনা ইয়াসমিন।

শেষ আপডেট: 10 June 2025 06:23

সাবিনা ইয়াসমিন

‘দিদি, এই ছবি কি তোমার এলাকায়?’

এই মর্মে একাধিক ছবি বা ভিডিও প্রতিবছরই আসে ইনবক্সে। কেউ পাঠান বিস্ময়ে, কেউ পাঠান কৌতূহলে। কেউ হয়তো পাঠান, ঘৃণাতেও। কী ছবি? না রাস্তা ভরা লালচে জল বয়ে যাচ্ছে। নোংরা, পূতিগন্ধময় সে জলে হাঁটছেন মানুষজন। পার্ক সার্কাসের মানুষজন। প্রতি বছরই এই সময়ে কুরবানি ইদের পরে নাকি এমনই রক্তের নদী বয়ে যায় পার্ক সার্কাসে। আর সেই ছবি ভাইরাল হয় সোশ্যাল মিডিয়ায়।

এত বছর ধরে পার্ক সার্কাস এলাকায় আছি, কুরবানির সময় রক্তের নদী বয়ে যেতে দেখিনি কখনও। এখন ফেসবুক থেকে জানতে পারছি রক্তনদীর কথা। মুসলিমদের পশুহত্যার নৃশংসতা বোঝাতেই এই কাল্পনিক নদীর অবতারণা। জল হয়তো বর্ষায় জমে থাকা, লাল রং হয়তো দোলের সময়ে বয়ে যাওয়া। বা হয়তো সে ছবি আদৌ কলকাতারই নয়। তবু সে সব জড়ো করে কুরবানি ইদের পরে সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে ফেলার দায়িত্ব একদল ‘সচেতন’ মানুষ ঠিকই নেন।

সেই ভিডিওটি দেখে নেওয়া যাক আগে।

না, ইসলামিক মৌলবাদকে সমর্থন করি না, জীবনে কোনও অবস্থাতেই করব না। কোনও শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষই করবেন না। সেটার প্রতিবাদই করবেন সর্বোচ্চ স্বরে। কিন্তু সেই প্রতিবাদ করতে গিয়ে যদি পার্ক সার্কাস বা অন্যান্য মুসলিম প্রধান অঞ্চলের নাম নিয়ে ভুয়ো খবর বা ছবি ছড়াতে হয়, নৃশংসতার মিথ্যে দৃশ্য দেখাতে হয়, তবে তো বুঝতে হবে মৌলবাদের ধ্বংস আমরা চাই না। আমাদের চাওয়া হল, বিকল্প আর একটি মৌলবাদ!

বস্তুত, শুধু কুরবানি ইদ কেন, গরু খাওয়া নিয়েও সারাজীবন এত প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয় মুসলিমদের, যে তারা মাংস খাক বা না খাক... মরমে মরে থাকতে হয়। আসলে, ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি কম-বেশি সব ধর্মের একাংশ মানুষের মধ্যেই দেখা যায়। তবে তার প্রকাশের রূপটা ভিন্ন। যে কোনও ধর্মের ক্ষেত্রেই একটাই কথা বলার, উগ্রতা, অসহিষ্ণুতা, সবসময় বর্জনীয়। নিজের ধর্মপালন নিজের মধ্যে রাখাই ভাল, অপরের অসুবিধা না করে।

সেই জন্যই বুদ্ধিমান এবং ঝামেলা এড়ানো মুসলিমরা কুরবানির জন্য আড়াল খোঁজেন। অন্য ধর্মের মানুষদের যাতে অসুবিধা না হয়, সে চেষ্টা তাঁদের মধ্যে থাকে। কিছু ব্যতিক্রমী বিরক্তিকর অভিজ্ঞতাও যে হয় না, তা কিন্তু নয়! তবে সেটা সাধারণ বাঙালি মধ্যবিত্ত মুসলিম সমাজের আসল চিত্র নয়।

এসবের মাঝে একটি জরুরি প্রশ্ন ওঠে, কুরবানি প্রথা ভাল না খারাপ? জ্যান্ত পশুকে জবাই করে ধর্মপালন আদৌ ঠিক, নাকি মনের পশুবৃত্তির কুরবানি দেওয়াই সবচেয়ে জরুরি? বইপত্র পড়ে, একাধিক মানুষের মতামত জেনে সে আলোচনা অন্য কোনওদিন হবে। কিন্তু আপাতত জেনে নেওয়া যাক, কী এই কুরবানি ইদ?

ইসলাম ধর্মে প্রধান দুটি ধর্মীয় উৎসব হল রোজার ইদ এবং বকরি ইদ। বা কুরবানি ইদ।  ধর্মীয় আচারগুলো যাঁরা একদম নিক্তি মেপে মানেন, সেইসব ধর্মপ্রাণ মুসলিমরা দুই ইদেই সব নিয়ম ঠিকঠাকভাবে পালন করেন।

রোজার ইদে দরিদ্রদের মধ্যে নির্দিষ্ট অর্থ বন্টনের নিয়ম আছে। সে নিয়মের অন্যথা করা যাবে না। যাঁদের নতুন পোশাক কেনার সামর্থ থাকে না, ইদ উপলক্ষ্যে সচ্ছল মুসিলমরা তাঁদের কাছে নতুন পোশাক পৌঁছে দেন। দয়া নয়, ধর্মীয় আচার হিসেবেই পালিত হয় সবটা। বাধ্যবাধকতা।  হাদিস কোরআন অনুসরণকারী কোনও ধনী মুসলিম মনে মনে হয়তো ভাবলেন, গত বছর তো অনেক টাকা (জাকাত), নতুন পোশাক দান করেছি, এই বছরে আর দান করব না। ভাল্লাগছে না।  সামনেরবার ইচ্ছে হলে করব।  না, এগুলো তিনি কিছুতেই ভাবতে বা না-করতে পারবেন না। ধর্মীয় অনুশাসন মানতে বাধ্য তিনি। কারণ এটা তাঁর চয়েস। ফলে বছরের পর বছর ইদ উপলক্ষ্যে দরিদ্র মুসলিমরা সাহায্য পাবেনই।

সেই ইদের পরে আসে বকরি-ইদ। নিজের প্রিয় পোষা প্রাণীটিকে প্রাণে ধরে ঈশ্বরের নামে উৎসর্গ করা এবং সেই প্রাণীর মাংস দরিদ্র মুসলিমদের মধ্যে সুষমভাবে বণ্টন করার কাজটি এই বকরি-ইদেই ঘটে। 

গরু, ছাগল, দুম্বা, উট, মহিষ ইত্যাদি পশুর কুরবানি দেওয়া হয়। ইদের নামাজ হয়ে গেলে প্রাণীগুলোকে স্নান করানো হয়। তার পরে ছাদে, উঠোনে,  ঘেরা জায়গায় কুরবানি দেওয়া হয়। শহরে অর্থের বিনিময়ে পিলখানায় পশু কুরবানির সুষ্ঠু ব্যবস্থা আছে। কলকাতার বিভিন্ন অঞ্চলে পিলখানা আছে। কুরবানির পর পৌরসভার কর্মীরা জায়গাটি পরিষ্কার করার দায়িত্ব নেন।

সমস্যা হয় শহরে বাড়ির মধ্যে কুরবানি করতে হলে, সে জায়গা বা উঠোন না থাকলে। তখন বাড়ির পাশের গলিতে, সামনের রাস্তায় কুরবানি চলে। কুরবানি হয়ে যাওয়ার পর রক্ত বা যাবতীয় নোংরা পরিষ্কার করার দ্বায়িত্ব, ব্যক্তিগতভাবে কুরবানি যিনি দেন, তাঁকেই বা তাঁর ভাড়া করা লোকদেরই নিতে হয়। এক্ষেত্রে সরকারি সহযোগিতা পেলে আরও তাড়াতাড়ি জায়গাটি সাফ হয়ে যেতে পারে।

জল দিয়ে রক্ত ধুয়ে ড্রেনে ফেলা হয়। মাটি থাকলে মাটিতে গর্ত করে বর্জ্য পদার্থগুলো গর্তে ফেলে মাটি চাপা দেওয়া হয়। শহরে মাটি কই! বেশিরভাগটাই তো চট্টান। কুরবানির রক্ত গড়িয়ে যায় তার ওপর দিয়ে।

মাংস কাটার পরে নির্দিষ্ট পরিমাণ মাংস মসজিদে দিয়ে আসা হয়, সেখান থেকে মাংস দরিদ্রদের মধ্যে বিতরিত হয়। যাঁরা কুরবানি দেন ব্যক্তিগতভাবে তাঁদেরও নির্দিষ্ট পরিমাণ মাংস দরিদ্রদের মধ্যে এবং আত্মীয়স্বজনদের মধ্যে বিলিয়ে দিতে হয়। বিলানোর কাজটি সম্পন্ন হতে হতে প্রায় বিকেল বা সন্ধে হয়ে যায়। এই সময় লক্ষ্য করলে দেখা যাবে প্রচুর মহিলা এবং পুরুষ ভারী ব্যাগ বহন করে নিয়ে যাচ্ছেন, যার মধ্যে মাংস আছে। লোকাল ট্রেনেও এই ছবি দেখা যায়। এবং অবধারিত ভাবে, তা নিয়ে বিতর্ক হয়। তৈরি হয় ভুয়ো খবরও।

সুবিধাবাদী রাজনৈতিক নেতারা রাজনীতিতে ধর্ম টেনে এনে দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে বিভাজনের যে পরিকল্পনা করছেন, তাতে বাতাস দিচ্ছে বিভ্রান্তিকর এইসব ভুয়ো খবরগুলোই। এক দেশের ছবি, অন্য দেশের বলে চালিয়ে দেওয়া হয়েছে। এটা তো নতুন নয়, বহুবার প্রমাণিতও হয়েছে!

এই মুষলকালে, এই ধরনের সংবেদনশীল বিষয়ে, সঠিক তথ্য না জেনে বা যাচাই না করে এমন কোনও খবর শেয়ার করা উচিত নয়, যাতে দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে লাগাতার ঘৃণার চাষ হয় আর নেতারা নিজের ঘরে লাভের ফসল তোলেন।

সরকার বা মিডিয়া বা প্রশাসন তো বটেই, পাশাপাশি আমাদের মতন সাধারণ মানুষদেরও আরও বেশি সচেতন হওয়া উচিত।

লাগাতার মূল্যবৃদ্ধিতে ঠেকনা দেওয়া, জরুরি পরিষেবাগুলো আরও উন্নত করা, নিয়মিত ভোট এবং ট্যাক্স দেওয়া নাগরিকের জীবনযাত্রার মান যাতে উন্নত হয়, এইসব নিয়েই বেশি চর্চা দরকার। এসব নিয়ে নেতাদের চাপে না রেখে, অপ্রয়োজনীয় ও ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র বিষয় নিয়ে নিজেদের মধ্যে লড়াই করতে করে আমরা দেশের আসল সমস্যাগুলো থেকে অনেক দূরে চলে গেছি। দূরে চলে গেছি পরস্পরের থেকেও। সে দূরত্ব ভেঙে সম্প্রীতি ছোঁয়া এখন অলীক কল্পনা।

(লেখিকা রন্ধনশিল্পী, দীর্ঘদিন পার্ক সার্কাসের বাসিন্দা। মতামত ও বক্তব্য তাঁর নিজস্ব)


ভিডিও স্টোরি