Latest News

করোনা পরবর্তী সময়ে গ্রামীণ কর্মসংস্থান কী হবে

দেবত্র দে

করোনা মহামারীর আগমনে এত দিনের অভিবাসী শ্রমিককুলের নতুন নামকরণ হল পরিযায়ী। আভিধানিক কুটকচালির বাইরে এর মোদ্দা কথা, পরিযায়ী পাখিদের ক্ষেত্রে তারা যেমন ভ্রমণ করে ফিরে যায় নিজের দায়িত্বে, এই শ্রমিকদের ক্ষেত্রেও তারা এতদিন যেখানে কর্মরত ছিলেন সেই ব্যাক্তি বা সংস্থারও কোন দায়িত্ব নেই এই শ্রমিকদের জীবন ও জীবিকা রক্ষা করার। ভুলে যাওয়া হল এদের অধিকাংশই বছরের বেশি সময় নিজের গ্রাম ছেড়ে কর্মস্থানেই থাকেন, তা শহরে ঠিকা শ্রমিকই হোক বা পূর্ব ভারত থেকে যাওয়া উত্তর ও পশ্চিম ভারতে কৃষিকাজে নিযুক্ত শ্রমিকই হোক।

আজ থেকে এক দশকেরও বেশি সময় আগে বিশেষ এক সতর্কতার বার্তা দিয়েছিল অর্জুন সেনগুপ্ত কমিটির প্রতিবেদন, যা হিসেব কষে দেখিয়েছিল ৯২ ভাগ কর্মরত মানুষ এদেশে কাজ করে অসংগঠিত ক্ষেত্রে, অত্যন্ত কম মজুরি ও কর্মক্ষেত্রে নূন্যতম সুবিধা ছাড়াই। পরিস্থিতির উন্নতি দূর অস্ত, বরং অবনতিই লক্ষ্য করি, যখন দেখা যায় বিশ্ব ক্ষুধা সূচকে ২০০৬ সালে ৯২ থাকা আমার দেশ ২০১৯ সালে নেমে এসেছে ১০৩-এ। বলতে দ্বিধা নেই, স্মার্ট সিটির ইন্ডিয়া কোন দিনই এই ভারতকে নিয়ে ভাবেনি। লক্ষ লক্ষ অভিবাসী শ্রমিকের দুর্দশা, মাইলের পর মাইল হেঁটে ঘরে ফেরার উদগ্র বাসনা ও তৎজনিত মৃত্যু এক নির্মম ব্যবস্থাকে সেই শিশুটির মুখোমুখি দাঁড় করায়, যে প্রশ্ন করতে পারে ‘রাজা তোর কাপড় কোথায়?’

কিন্তু অতঃপর ? যে দুর্বিষহ অভিজ্ঞতা নিয়ে ফিরলেন এরপর এদের কত শতাংশ আর গ্রামছাড়া হতে চাইবেন আর যখন বিশ্বসাস্থ্য সংস্থাই বলছে এর প্রাদুর্ভাব থেকে খুব দ্রুত মুক্তি নেই? এর পরের স্বাভাবিক প্রশ্ন এদের মুখে ভাত আর হাতে কাজ জুটবে কীভাবে? এই বিপুল সংখ্যক অভিবাসী শ্রমিক গ্রামাঞ্চলে প্রবেশ করলে তার অভিঘাত গ্রামের জীবন ও জীবিকায় কী প্রভাব ফেলতে পারে?

একদা প্রবাদপ্রতিম শিল্পী আব্বাসুদ্দিন নাকি শহুরে মানুষ কেন তাঁর গান শোনেন, এই প্রশ্নের উত্তরে বলেছিলেন রেডিওর অপর প্রান্তে যে মানুষ বসে থাকেন তাঁদের প্রত্যেকেরই একটা শিকড় আছে গ্রামে। অনুরূপে গ্রাম থেকে অনিকেত অভিবাসী শ্রমিকেরও রয়েছে কৃষিকাজ-সহ নানা গ্রামীণ শিল্পে বহু প্রজন্মের পরম্পরা। সংকটের এই ঘোর আবর্তে তাঁরা কি জীবন বাঁচানোর তাগিদে ফিরে যাবে শিকড়ের সন্ধানে? খড়কুটোর মতো আঁকড়ে ধরতে চাইবে তাঁর পরিবার, গ্রাম ও কৃষ্টিকে? আমাদের অপেক্ষা করতে হবে আরও কিছু কাল এই প্রশ্নমালার মীমাংসার জন্য।

সাধারণ জ্ঞানেই এটুকু বোঝা সম্ভব যে গ্রামাঞ্চলে অতিরিক্ত শ্রমের জোগানের ফলে কৃষিক্ষেত্রে মজুরির ওপর কোপ পড়ার সম্ভাবনা প্রবল। এমনিতেই এদেশের কৃষিযোগ্য শতকরা ৮৫ ভাগ জমি রয়েছে প্রান্তিক ও ক্ষুদ্রচাষিদের দখলে, ফলে নতুন করে কৃষিতে কর্মসংস্থানের সম্ভাবনাও খুব ক্ষীণ। যে দেশে গত দু’দশকে লক্ষাধিক কৃষক আত্মহত্যা করতে বাধ্য হয়েছেন, সে তো এমনিতেই পঙ্গু। নতুন ভার সে সইবে কেমনে?
কৃষি ছাড়া যে সব বিকল্প ক্ষেত্র গ্রামাঞ্চলে কর্মসংস্থানের জোগান দিতে পারে অর্থাৎ কারিগরি ও হস্ত শিল্প যা মূলত পরিবারভিত্তিক। কিন্তু প্রশ্ন হল, গ্রামে যদি অর্থের জোগান না আসে, মন্দার এই বাজারে উৎপাদিত পণ্যের বিক্রির জন্য পর্যাপ্ত ক্রেতা কোথায় পাবে?

ফলে চাপ বাড়তে বাধ্য গ্রামীণ কর্মনিশ্চয়তা প্রকল্পে, যা একশো দিনের কাজ বলে অধিক পরিচিত, তাতে সুযোগ পাওয়া নিয়ে। রূঢ় সত্য হল, পরিবার প্রতি নূন্যতম একশো দিন কর্মসংস্থানের আইন দেশে বলবৎ হলেও বাস্তবে গত আর্থিক বছরেও পরিবার প্রতি গড়ে পঞ্চাশ দিনও কাজ দেওয়া যায়নি। যেহেতু এই সময় আমাদের দেশের জনসংখ্যায় তরুণ ও যুবকের ভাগ বেশি, স্বভাবতই নীতি নির্ধারকদের কাছে এই বিপুল কর্মপ্রার্থীর কাজের জোগান দেওয়াই সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।

কী কী ভাবা যেতে পারে?

একশো দিনের কাজের পরিধি বাড়িয়ে তাতে কৃষিকাজ, মৎস্যপালন, পোল্ট্রি ইত্যাদি শ্রমনিবিড় ক্ষেত্রকে অন্তর্ভুক্ত করা যেতে পারে যাতে বহু সংখ্যক কাজের সুযোগ তৈরি হতে পারে। এর সঙ্গে জোড়া যেতে পারে এলাকাভিত্তিক বিভিন্ন কারিগরি ও হস্তশিল্পকে। লকডাউন পরবর্তী সময়ে যেহেতু গ্রামাঞ্চলে এই সরকারি প্রকল্পের ওপর বেশিরভাগ পরিবার নির্ভরশীল থাকবে, তাই আপৎকালীন সময়ে প্রয়োজন এর নিয়মাবলির শিথিলতা, যাতে অতিরিক্ত কর্মসংস্থানের সৃষ্টি হয়। অভিবাসী শ্রমিকরা ফিরে আসায় শ্রমের জোগানের প্রতুলতা নিয়ে সমস্যা না থাকায় এই প্রকল্পের অধীনে এই সুযোগে পরিবেশবান্ধব গ্রামীণ পরিকাঠামো গঠনের সুযোগ থাকবে, যেমন পুকুর বা বাঁধের সংস্কার ও রক্ষণাবেক্ষণ, বর্ষার আগে কাঁচা রাস্তার উন্নতি, বনসৃজন ইত্যাদি। এসব অল্প সময়েই গ্রামাঞ্চলের আর্থিক বৃদ্ধিতে সহায়ক হবে।

করোনা পরবর্তী বিশ্বে জৈব ফসলের চাহিদা বৃদ্ধি হবে বিপুল হারে, কারণ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে বিষ ও ভেজালমুক্ত খাদ্য আগামী দিনের অন্যতম হাতিয়ার হবে। ফলে আগামী দিনে জৈব চাষের উৎপাদন বৃদ্ধি ও তাকে বাজারজাত করার মাধ্যমে বহু নতুন ধরণের কর্মসংস্থানের কথা ভাবা যেতে পারে। এতে একদিকে যেমন কমবে সার, বীজ ও কীটনাশকের খরচ, অন্যদিকে এর শ্রমনিবিড়তা তৈরি করতে পারে নতুন ধরনের কর্মসংস্থানও।

গত দু’দশকে সারা দেশে মহিলাদের নিয়ে কয়েক লক্ষ স্বনির্ভর দল তৈরি হয়েছে, যাদের অনেকেই নানা অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে যুক্ত। এই স্বনির্ভর দলগুলিকে আরও বেশি ব্যাঙ্কঋণের জোগান দিয়ে তাদের কর্মকাণ্ডের পরিধি বাড়ালে সেখানেও বাড়তি কর্মসংস্থানের সুযোগ হতে পারে। এই প্রসঙ্গে বলে নেওয়া দরকার যে ব্যাঙ্কঋণ শোধের ক্ষেত্রে স্বনির্ভর দলের সুনাম কিন্তু দেশজোড়া। করোনা মোকাবিলায় আগামীতে যে বিপুল পরিমাণ মাস্ক, স্যানিটাইজার ও হাত ধোয়ার সাবান-সহ বিভিন্ন দ্রব্যের চাহিদা হবে, স্বনির্ভর দলগুলি নিজেরাই সেসব প্রস্তুত করে শুধু আর্থিক ভাবে লাভবানই নয়, তৈরি হতে পারে প্রচুর অপ্রচলিত ও নতুন ধরনের কর্মসংস্থানও।

দেশের এই বিপুল যৌবনকে যদি আগামী কয়েক মাসের মধ্যে কাজের সুযোগ করে দেওয়া না যায় তবে বিকল্প বোধহয় দু’টিই। হয় আকালের স্মৃতিকে ফিরিয়ে আনা, নতুবা দ্রোহকালকে আহ্বান করা। হে মহামান্য সরকার বাহাদুর! পরিশেষে পছন্দ তো আপনার!

লেখক বগুলা’র শ্রীকৃষ্ণ কলেজের অর্থনীতির অধ্যাপক, মতামত তাঁর নিজস্ব।

You might also like