
অমল সরকার
২৭ বছর ক্ষমতায় থাকার পরও গুজরাতে (Gujarat Election) বিজেপি যে পুনরায় সরকার গড়বে তা নিয়ে কারও মনে কোনও সংশয় ছিল না। কিন্তু তারা যে রেকর্ড সংখ্যক আসন ও ভোট পেয়ে ক্ষমতা ধরে রাখবে, তা ছিল ভাবনারও অতীত। আবার হিমাচল (Himachal Pradesh Election) নিয়ে প্রাক্ নির্বাচনী পূর্বাভাস মেলেনি। রাজ্যটি হাতছাড়া হয়েছে বিজেপির (BJP)।

সাম্প্রতিককালে কংগ্রেসের পাঞ্জাব, বিজেপির হিমাচল এবং গত বছর প্রয়াত জয়ললিতার পার্টি এআইএডিএমকে’র তামিলনাড়ু হাতছাড়া হওয়াই ব্যতিক্রম। কেন্দ্রে নরেন্দ্র মোদীর সরকারের মতো রাজ্য রাজ্যে ক্ষমতাসীন দলের প্রতিই মানুষ আস্থা রাখছে। তামিলনাড়ু, কেরল, উত্তরপ্রদেশ এবং হিমাচলে বহু বছর যাবৎ পাঁচ বছর অন্তর সরকার বদলের ধারা বহাল ছিল। গত বছর কেরলবাসী সেই ধারা থেকে বেরিয়ে এসে সিপিএমকে দ্বিতীয়বারের জন্য ক্ষমতায় রেখে দিয়েছে। উত্তরপ্রদেশও তাই। ৩৫ বছর পর সেখানে টানা দ্বিতীয়বার ক্ষমতায় থাকার সুযোগ পেল কোনও সরকার। পাঞ্জাব ও হিমাচলে সরকার বদলের কারণ শাসক দলের অপদার্থতা এবং মাত্রাছাড়া ঘরোয়া কোন্দল।
গুজরাতে বিজেপি সব জাতি, বর্ণের ভোট পেয়েছে। এমনকী মুসলিমদের একাংশও পদ্মফুলে ছাপ দিয়েছেন। বিজেপি সংখ্যালঘুর ভোট পেয়েছে উত্তরপ্রদেশেও, যে রাজ্যে মুখ্যমন্ত্রী ভোটের আগে বলেছিলেন, ‘আশি শতাংশ (হিন্দু) মানুষ পাশে আছে, কুড়ি শতাংশের (মুসলিম) ভোট চাই না।’
পশ্চিমবঙ্গে ৩৪ বছর ক্ষমতাসীন বামফ্রন্ট সরকার তৃতীয়বার জেতার পর থেকে ‘স্থায়িত্ব’শব্দটিকে রাজনৈতিক হাতিয়ার করেছিল। জ্যোতি বসু বলতেন, ‘বাংলায় বামপন্থীরা সরকার চালাচ্ছে, এ রাজ্যে মানুষ তাই বিরোধিতা নয়, প্রতিষ্ঠানের পক্ষে ভোট দেন।’গুজরাতে এবারের বিধানসভা ভোটের প্রচারে বারে বারে এই একই কথা বিজেপি সম্পর্কে বলেছেন নরেন্দ্র মোদী।
কিন্তু দুই রাজ্যে স্থায়ী সরকারের মধ্যে চরিত্রগত ফারাক বিস্তর। সেই প্রসঙ্গে পরে আসছি। মিলের জায়গাটি হল, দেশে এখন টানা তিনবার টিকে থাকা সরকার অনেকগুলি রাজ্যে আছে। বাংলায় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার তার মধ্যে একটি। সরকারের রাজনৈতিক চরিত্র নির্বিশেষে স্থায়িত্বই ক্রমে মূল ধারা হয়ে উঠছে। ফলে নরেন্দ্র মোদী ২০২৪-এ ফের দিল্লিতে সরকার গড়বেন বলে ভোট পণ্ডিতদের সিংহভাগ আগাম ঘোষণা করলেও বাংলা, ওড়িশা, তেলেঙ্গানা, অন্ধ্রপ্রদেশ, ঝাড়খণ্ড, বিহার, কেরলে বিজেপির সুদিন ফেরা নিয়ে সেই বিশেষজ্ঞরা রা কাড়ছেন না।
এটা থেকে স্পষ্ট, ভোট দানে দলের নীতি-আদর্শ ভোটারের কাছে এখন তেমন আর বিচার্য নয়। পশ্চিমবঙ্গে, ত্রিপুরায় একটা সময় সিপিএম সম্পর্কে বলা হত, তারা কলাগাছকে প্রার্থী করলেও বিপুল ভোটে জিতবে। আবার সেই সিপিএমকেই এই দুই রাজ্যে পঞ্চাশ শতাংশের বেশি ভোট পেতে অনেক ঘাম ঝরাতে এবং রিগিং, ছাপ্পার আশ্রয় নিতে হয়েছে। ক্ষমতা দখল করতে না পারলেও বাংলায় বাম জমানায় চল্লিশ-পঁয়তাল্লিশ শতাংশ ভোট ধরে রেখেছিল কংগ্রেস। তার মানে দলে দলে মানুষ শাসক দলের দিকে ছোটেনি। সিপিএমের সন্ত্রাসের মুখেও বুক চিতিয়ে কংগ্রেস, পরবর্তীকালে তৃণমূলে গা ভাসানো মানুষ রাজনৈতিক মতাদর্শের প্রশ্নে আপোস করেনি। ফলে শাসক ও বিরোধী দুই শিবিরে ভোটারের সম্পর্কে স্থায়িত্ব ছিল মূল মন্ত্র। এর থেকেই ভোটব্যাঙ্ক শব্দটির উৎপত্তি। দলের কাছে ভোটারের রায় গচ্ছিত থাকত। দলের প্রতি নীতি-আদর্শের প্রতি আস্থাই ছিল আমানত।
আজকের ভারতে সরকারের স্থায়িত্বের ক্ষেত্রে নীতি-আদর্শের জায়গাটির দখল নিয়েছে সরকারি সুবিধা পাওয়ার নিশ্চয়তা। স্বভাবতই ব্যাঙ্কে টাকা গচ্ছিত রাখার আগে মানুষ যেমন সুদের হার নিয়ে ভাবনাচিন্তা করে, ভোট দেওয়াতেও সেই মন-মানসিকতা তৈরি হয়েছে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকারের কন্যাশ্রী, যুবশ্রী, শিক্ষাশ্রী, জয় জোহার, কিংবা নরেন্দ্র মোদীর পিএম কিষাণ যোজনার মতো সরাসরি ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে টাকা ঢালার মতো স্কিম যেমন কম-বেশি সব রাজ্যেই আছে, তেমনই আছে স্বাস্থ্যসাথী, আয়ুষ্মান ভারতের মতো বিমা প্রকল্পের সুবিধা।

এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে বাংলার লক্ষ্মীর ভাণ্ডারের আদলে মহিলাদের আলাদা করে অর্থ সাহায্যের প্রকল্প। আছে নিখরচায় বিদ্যুৎ, রান্নার গ্যাস, ট্যাব, ল্যাপটপ, তীর্থস্থান ভ্রমণের ব্যবস্থা। এর সঙ্গে রেশনে প্রায় বিনামূল্যে চাল, গম, ডাল, আটা পাওয়ার ব্যবস্থা তো আছেই। অন্তত বারো ক্লাস পর্যন্ত পড়াশুনোর খরচও এখন প্রায় পুরোটাই সরকার বহন করে। অনেকগুলি জরুরি, নিত্যপ্রয়োজনীয় সুবিধা এক বিন্দু ঘাম না ছড়িয়ে পেয়ে যাওয়ায় শ্রেণি দ্বন্দ্ব এবং সামাজিক হিংসার চেনা ছবিটির রূপ বদল ঘটেছে।
দারিদ্রসীমার নিচে বসবাসকারী মানুষের তালিকা বা বিপিএল লিস্টের কথা এখন আর শোনা যায় না, যে তালিকায় নাম তুলতে একটা সময় নেতা-মন্ত্রীর দরজায় ঘুরতে হত গরিব মানুষকে। এখন বেশিরভাগ সুবিধাই সর্বজনীন। লক্ষ্মীর ভাণ্ডারের পাঁচশো টাকা সেই বধূও পাচ্ছেন যার পরিবার এই দুমূর্ল্যের বাজারেও প্রতি রবিবার মাংসভাত খায়। তাদের বাদ দেওয়া গেলে প্রকৃত দুঃস্থদের সাহায্যের অঙ্কটা বাড়ানো যেত।
কিন্তু সর্বজনীন সুবিধা প্রদানের দুটি সুবিধা আছে। এক. তাতে গরিব-বড়লোক, দুয়ের ভোট পাওয়ার পথ নিষ্কণ্টক করা যায়। ভোট এক চমৎকার সাম্যবাদী ব্যবস্থা, রতন টাটা ও রহমত আলির ভোটের মূল্য সমান। যত বেশি মানুষকে সুবিধার বন্ধনে বাঁধা যাবে, ভোট তত সুরক্ষিত। দুই. সবাইকে সব সুবিধা দেওয়ার ব্যবস্থা হওয়ায় বিরোধী ভোটারকে বাদ দেওয়ার নোংরা রাজনীতি অনেকটা কমেছে। ফলে জনক্ষোভ হ্রাস পেয়েছে।
বামফ্রন্ট সরকারের বিরুদ্ধে ওঠা জনপ্রিয় অভিযোগগুলির একটি ছিল সরকারি সুবিধা প্রদানে দলবাজি। সেটা করতে গিয়ে শ্রেণি রাজনীতির ঠাকুরদারা গরিব মানুষের মধ্যে বিভাজন তৈরি করেছেন। সেই পাপ এখনও বয়ে বেড়াতে হচ্ছে তাদের। সিপিএম পায়ের তলায় যে টুকু মাটি ফিরে পেয়েছে তা শহুরে শিক্ষিত মধ্যবিত্ত, উচ্চবিত্তের ভোট, গরিব মানুষের ভোট নয়।
অন্যদিকে, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকারের বিরুদ্ধে দল দেখে সুবিধা দেওয়ার অভিযোগ এখনও জনক্ষোভের চেহারা নেয়নি। কারণ, আগের জমানার তুলনায় তা কম। ফলে শিক্ষক নিয়োগ কেলেঙ্কারির প্রতিক্রিয়া ভোটের বাক্সে কতটা সরকার বিরোধী ঝড় তুলবে, সারদা ও নারদ কেলেঙ্কারির পরিণতি দেখার পর, হলফ করে বলা কঠিন।
বাংলার শিক্ষক নিয়োগে দুর্নীতির মতোই মধ্যপ্রদেশে ব্যাপম কেলেঙ্কারির বোঝা মাথায় নিয়েই তিন তিনটি বিধানসভা ভোট উতরে গিয়েছেন বিজেপির শিবরাজ সিং চৌহান। হাত পেতে টাকা নিতে দেখার দৃশ্যও মানুষের মনে দাগ কাটছে না।
উদার অর্থনীতি পরবর্তী ভারতে অনেক বদল ঘটেছে। মৌলিক পরিবর্তন একটি— নীতি, আদর্শের প্রতি অনাস্থা। দুর্নীতির প্রতি ঘৃণার পরিবর্তে বেপথে সুবিধা পাওয়ার রাস্তায় হাঁটা মানুষ সংখ্যায় দিন দিন বাড়ছে।
আবার একথাও ঠিক, তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলিতে সরকারই আসল ভগবান। যে সরকার সুবিধা দেয় তার উপাসনা মানুষ করবেই। তথ্য-প্রযুক্তির হাত ধরে কম্পিউটারের বোতাম টিপে ডিরেক্ট বেনিফিট ট্রান্সফারের ব্যবস্থা চালু হওয়ার পর ঘরে বসে সুবিধা পেতে অভ্যস্ত মানুষকে শুধু দুর্নীতি কেন, জাত, ধর্মের নামে প্রতিবেশীর প্রতি ঘৃণা, হিংসা, বিভাজনের রাজনীতিও তেমন দাগ কাটছে না। ফলে রাজ্যে রাজ্যে শাসকের বিরুদ্ধে বিরোধীদের লড়াইটা অনেক কঠিন হয়ে গিয়েছে। বিশেষ করে বামপন্থীদের, যারা এখনও নীতি-আদর্শকে আশ্রয় করে রাজনীতি করতে চাইছে।
ডিরেক্ট বেনিফিট ট্রান্সফার নামক হাতে গরম সুবিধা প্রদানের যে ব্যবস্থা নীতি-দুর্নীতিকে লঘু করে নাগরিককে ‘বেনিফিসিয়ারি’ বা সুবিধাভোগী সম্প্রদায় বানিয়ে দিয়েছে ইউপিএ জমানায় সনিয়া গান্ধীর নেতৃত্বাধীন জাতীয় উপদেষ্টা পর্ষদ সেই ব্যবস্থার পথপ্রদর্শক।

নরেন্দ্র মোদী ও মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতো রাজনীতিকেরা এমন একটা সময় ক্ষমতার কুর্সিতে বসেছেন যখন ডিবিটি-র প্ল্যাটফর্ম অনেকটাই প্রস্তুত। এখন কেন্দ্রের ৫৬টি মন্ত্রকের ৪২০টি স্কিমে এই ব্যবস্থার মাধ্যমে মানুষের কাছে সরাসরি সরকারি সুবিধা পৌঁছচ্ছে। এছাড়া রাজ্য সরকারগুলির নিজস্ব স্কিম তো আছেই। প্রধানমন্ত্রী কম্পিউটারের একটি বোতাম টিপলেই মুহূর্তে আট কোটি কৃষকের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে দু হাজার টাকা করে জমা হয়ে যায়। এইভাবে তিনদফায় বছরে প্রাপ্তি ছয় হাজার কোটি টাকা। গত বিধানসভা ভোটের আগে ঘূর্ণিঝড়ে ক্ষতিগ্রস্ত দু লাখ পরিবারের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কুড়ি হাজার টাকা করে দিয়েছিলেন। তা নিয়ে দুর্নীতির অভিযোগ আদালত পর্যন্ত গড়ায়। তবু ওই জেলাতেই তৃণমূলের সাফল্য ছিল নজরকাড়া। কারণ, দুর্দিনে ওই কুড়ি হাজার টাকা ছিল দু লাখের সমান।
ভোটের আগে বিনামূল্যে সুবিধা, জিনিসপত্র বিলি করার প্রতিশ্রুতি দেওয়ার রেওয়াজেও দক্ষিণের রাজ্যগুলি বরাবর এগিয়ে। দু টাকা কিলো দরে চাল দেওয়ার কথা বলে অন্ধ্রপ্রদেশে কংগ্রেসকে ক্ষমতাচ্যুত করেছিলেন চিত্রতারকা এনটি রামারাও। তামিলনাড়ুতে রামচন্দ্রন, জয়ললিতা, করুণানিধিরা থালাবাসন, রেডিও ইত্যাদি বিলিয়েছেন। আবার দু টাকা কিলো দরে চাল দেওয়ার প্রতিশ্রুতি বিলিয়ে ১৯৮৭-র ভোটে বাংলায় বামফ্রন্টের দুর্জয় ঘাঁটিকে ফাটল ধরাতে পারেনি কংগ্রেস। অনাহার, অর্ধাহারে থাকা বাংলার মানুষের বামপন্থীদের প্রতি আনুগত্য ছিল এতটাই নিবিষ্ট।
তখন সুবিধা প্রদানে অগ্রাধিকার পেত দারিদ্রমোচন। ইন্দিরা গান্ধীর ‘গরিবি হটাও’ বামফ্রন্ট সরকারের বেকার ভাতার স্কিমের দর্শন ছিল দারিদ্র মোচন। তেলা মাথায় তেল দেওয়া নয়। বামফ্রন্টের বেকার ভাতা নিয়ে বিরোধীরা বিদ্রুপ করে বলত, ‘ভাতা দেয় ভাত, ভাত দেয় ভাতঘুম।’ এখন ডানপন্থী সরকারগুলির জনপ্রিয়তম কর্মসূচি হল মানুষকে ভাত ও ভাতা দেওয়া। কিন্তু বামপন্থীরা ব্রাত্য।
তবে ডিরেক্ট বেনিফিট ট্রান্সফার আর যাই হোক, সোশ্যাল সিকিউরিটি বা সামাজিক সুরক্ষা প্রকল্প নয়। তা ভোট কেনার অনলাইন প্যাকেজ মাত্র। ভোট পাওয়া এখন ভোট কেনায় পর্যবসিত হয়েছে। কে কত দিয়ে কিনতে পারে, সেই প্রতিযোগিতাটিরই নাম এখন নির্বাচন। ভারতবাসী এখন সুবিধার বিনিময়ে ভোট বিক্রি করছে।
‘গুজরাত মডেল’-ই কি ভবিতব্য ভারতের, হিন্দুত্বের সিঙ্গল ইঞ্জিনেই জুড়ছে সব চাকা
Read more at: