শেষ আপডেট: 26th November 2023 19:11
এবার বিশ্বকাপ ক্রিকেটের একটি ম্যাচও দেখিনি। ক্রিকেটের যে কোনও বড় টুর্নামেন্টেই দেখা বন্ধ করে দিয়েছি বেশ কয়েক বছর হল। পিছনে দু-তিনটি কারণ আছে। বলাইবাহুল্য সেগুলির সঙ্গে অনেকেই হয়তো সহমত হবেন না।
এই বিষয়ে বিশদে বলার আগে চার দশক আগের এক রাতের কথা স্মরণ করা যাক। গত রবিবার ভারত-অস্ট্রেলিয়ার ফাইনালের লড়াই দেখিনি বটে, তবে দিনভর ক্রিকেটেই মজে ছিলাম। সারাদিন স্মরণ করেছি ১৯৮৩-র সেই দিনটি, কপিল দেবের নেতৃত্বে ইংল্যান্ডের মাঠে ভারতের ক্রিকেটে বিশ্বসেরা হওয়ার মুহূর্তটি।
আমাদের মহল্লায় টেলিভিশন তখনও অতিবিরল বস্তু এবং সাদাকালো যুগে পড়ে। তাই পাড়ার একটি মাত্র বাড়ির একমাত্র সেটটির সামনে গোটা পাড়ার কপিল বাহিনীর লড়াই দেখতে জড়ো হওয়া ছাড়া বিকল্প ছিল না। কলোনির বহু ঘরে তখন দু’বেলা পাত পড়ে না। তাতে কী! ক্ষুধার্থ, নিরন্ন মানুষের কি দেশপ্রেম থাকে না? আলবাৎ থাকে।
পাড়ার যে যা পারলেন দিলেন। সেই টাকায় সিন কাগজ কিনে জাতীয় পতাকা বানানো হল। সেই প্রথম অনুভব করলাম, বড়দের চোখে জাতীয় পতাকা আর দেবতার মধ্যে ফারাক নেই। সেটা শুধুমাত্র এক টুকরো কাপড় নয়, অন্য কিছু। কলোণির স্কুলে সুভাষচন্দ্র বসুর জন্মদিনে গাঁদা ফুলের মালায় তাঁর ছবি সাজিয়ে দেওয়া হত। ঠিক বারোটায় সাইরেন বেজে উঠলে তেরঙ্গা পতাকা তোলা হত। গাওয়া হত জনগণমন……।
বড়দের দেখাদেখি নেতাজির ছবির সামনে দাঁড়িয়ে নমস্কার করেছি, স্যালুট দিয়েছি বটে, জাতীয় পতাকা, জাতীয় সঙ্গীতের গুরুত্ব উপলব্ধি করেছি অনেক পরে, ’৮৩-র ২৫ জুন। এর আট বছর আগে জরুরি অবস্থা জারির সূত্রে যে দিনটি কলঙ্কের রাত হয়ে গিয়েছিল, কপিল দেব, গাভাসকার, অমরনাথ, কিরমানিদের হাত ধরে সেই রাতেই প্রথম নিজের মধ্যে দেশপ্রেম উপলব্ধি করেছিলাম। বুঝেছিলাম জাতীয় পতাকা, জাতীয় সঙ্গীতের গুরুত্ব, তাৎপর্য।
মধ্য রাতে ম্যাচ শেষে দেশপ্রেম এতটাই চাগার দিল যে রাগে বহু বাড়িতে ইট মেরেছিলাম বন্ধুরা মিলে। এমন রাতে কেউ দেশের জয়ে আনন্দ, উল্লাশ না করে ঘুমবে, আমাদের তরুণ ব্রিগেডের তা পছন্দ ছিল না। চার দশক আগের সেই বিশ্বকাপের ফাইনালের সুবাদে প্রথম জেনেছিলাম, আমি ভারতবাসী, ভারতীয়।
তারপর ক্রিকেট নিয়ে আগ্রহ, টুর্নামেন্ট ঘিরে উন্মাদনা, দেশপ্রেম এভারেস্টের চূড়ায় গিয়ে পৌঁছালো। আগ্রহের সেই গ্রাফ নামতে শুরু করল তাও প্রায় তিন দশক হয়ে গেল। একটা সময়, সচেতনভাবেই ক্রিকেট থেকে সরে এসেছি।
প্রথমত, টেস্ট ক্রিকেটের বিদায়ের পাশাপাশি ৫০ ও ২০ ওভারের ম্যাচের জনপ্রিয়তা যত বাড়ছে ততই এই খেলাটি যেন আমাদের মনোজগতে জিঘাংসার বীজ বপন করে চলেছে। চারপাশের ক্রিকেট আলোচনায় ব্যাট চালানো শব্দটির জায়গা নিয়েছে প্যাদানো। প্রতিপক্ষকে অনতিক্রম্য একটি সংখ্যার মুখোমুখি ফেলা অথবা বিপক্ষের স্কোর পিটিয়ে তুলে নেওয়া, এটাই আজকের ক্রিকেটের শেষ কথা। শিল্পের জায়গা নিয়েছে শক্তি প্রদর্শন। বল পেটানোর মধ্যে যে নির্মমতা তা কোনওভাবে আমাদের শিশু-কিশোরদের শুধু মারতে উৎসাহী করে তুলছে না তো?
আসি দ্বিতীয় কারণটিতে। গাভাসকার ক্রিকেট খেলে যত না রোজগার করেছেন তার কয়েকগুণ বেশি আয় করেছেন ধারাবিবরণী এবং লেখালেখি থেকে। ক্রিকেট রোজগারের মুখ দেখল নয়ের দশকে উদার অর্থনীতি পরবর্তী ভারতে। সেই থেকে ক্রিকেটে আর ক্রিকেট নেই, হয়ে গিয়েছে কর্পোরেট ইভেন্ট। অবশ্য কম-বেশি সব খেলা সম্পর্কেই একথা বলা চলে। উদার অর্থনীতি পরবর্তী সময়ে বাণিজ্যের লক্ষ্যপূরণে অন্যতম হাতিয়ার করা হয়েছে ক্রিকেটকে। এই ক্রিকেট তাই নিছকই একটি খেলা নয়, বলা ভাল কর্পোরেট জুয়া।
তৃতীয়ত, বিশ্বকাপ-সহ প্রথমসারির ক্রিকেট টুর্নামেন্টগুলি হয়ে উঠেছে সাম্প্রদায়িকতার বিষ, বিদ্বেষ ছড়ানোর অন্যতম ইভেন্ট। আম ভারতীয় ক্রিকেটারদের যোগ্যতা, দক্ষতা বিচার করছে তাঁদের ধর্ম পরিচয়কে বিবেচনায় রেখে। ক্রিকেটকে সামনে রেখে সোশ্যাল মিডিয়ায় চলছে দেশপ্রেমের নামে চরম নোংরামি।
মহম্মদ শামি এখন হিরো। বছর খানেক আগে কোনও এক টুর্নামেন্টে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ভারতের নির্মম পরাজয়ের পর সংবাদ আর সামাজিক মাধ্যমে দুটি বিপরীত ধর্মী প্রতিক্রিয়া লক্ষ্য করেছি। একটিতে ভারতের অধিনায়ক বিরাট কোহলি জয়ের শুভেচ্ছা জানাতে পাক ক্রিকেটার মহম্মদ রিজওয়ান জড়িয়ে ধরেছেন। ওদিকে, ম্যাচ শেষেই সামাজিক মাধ্যমে শুরু হয়ে গিয়েছিল শামিকে তীব্র আক্রমণ। ‘পাকিস্তানের থেকে কত টাকা খেয়েছো? একটু তো লজ্জা হওয়া উচিত ছিল। আমাদের তো চোখের জলে ভাসতে হল’ জাতীয় মন্তব্য।
কেউ কেউ তাঁকে পাক নাগরিক, চর ইত্যাদি বানিয়ে দেন মুহূর্তে। খেলল এগারো জন। কিন্তু যত দোষ হল গিয়ে কিনা মহম্মদ শামির। কারণ তিনি মুসলমান। ধর্ম পরিচয়টিকে হাতিয়ার করে তাঁকে পাকিস্তানি সাব্যস্ত করার চেষ্টা হয়। এই নির্মম বাস্তবতার কথা মাথায় রেখেই বুঝি এশিয়া কাপের সময় হায়দরাবাদের মহম্মদ সিরাজকে বলতে হয়েছিল, ‘যতক্ষণ না পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ভাল খেলছি, ততক্ষণ স্বস্তি পাচ্ছি না।’ সিরাজ জানেন, তিনি ভারতীয় কিন্তু মুসলমান। বাকি ম্যাচ যেমন তেমন, পাকিস্তানের বিরুদ্ধে খারাপ খেললে মূহূর্তে তাঁকে পাকিস্তানি বানিয়ে দেওয়া হবে। আসলে অপপ্রচার, উন্মাদনা, অন্ধ দেশপ্রেম, জাতীয়তাবোধ ইত্যাদি এই নব্য ক্রিকেট বাণিজ্যের অন্যতম অনুঘটক। একটা সময় আবার এই ভারতে ‘নো মুস্তাক নো টেস্ট’—স্লোগানও উঠেছে গ্যালারিতে। বরোদার মাঠে সেলিম দুরানিকে নিয়ে খেলা শেষে শোভা যাত্রাও বেরিয়েছে। যা কাঙ্ক্ষিত ও প্রত্যাশিত।
এখন উল্টো স্রোতের সময়ে নাগরিকেরাও সেই কারণে সকলেই নিছকই দর্শক বা ক্রিকেটপ্রেমী নয়, একাংশকে সুকৌশলে যোদ্ধা হিসাবে গড়ে তোলা হয়েছে, যারা মাঠের হার-জিৎকে গোলা-বারুদের যুদ্ধের সঙ্গে এক করে দেখতে অভ্যস্ত। তাই ভারত-পাকিস্তান ক্রিকেট ম্যাচের দিন সংখ্যালঘু মহল্লার দিকে বাড়তি নজরদারি, সুরক্ষার আয়োজন করাও এই উপমহাদেশে পুলিশ-প্রশাসনের অতিরিক্ত দায়িত্ব হয়ে উঠছে।
লক্ষণীয় হল, উদার অর্থনীতির আমদানি, ধর্মীয় মৌলবাদের প্রসার এবং ক্রিকেট ঘিরে বাণিজ্য বিগত তিন দশকে পাশাপাশি এগিয়েছে। মুসলমানের নাগরিকত্ব, দেশপ্রেম নিয়ে প্রশ্ন তোলাটা এদেশে দেশপ্রেমী সাজার সবচেয়ে সস্তা উপায়। পান থেকে চুন খসলে মুসলমানদের কথায় কথায় পাকিস্তানের চর সাব্যস্ত করা, পাকিস্তানে চলে যাওয়ার ফতোয়া জারি করে দেওয়াও তথাকথিত হিন্দুত্ববাদীদের তরফে ইসলামকে আক্রমণের সস্তা রাস্তা করে তোলা হয়েছে।
বিরাট কোহলির সৌভাগ্য, ম্যাচ হারার পর পাক ক্রিকেটারকে আলিঙ্গন করে শুভেচ্ছা জানানোর জন্য তাঁর অভিজ্ঞতা অন্তত নভজ্যোত সিং সিধুর মতো হয়নি। সিধু পাক প্রধানমন্ত্রী, ক্রিকেট দুনিয়ার একদা মহাতারকা ইমরান খানের আমন্ত্রণে পাকিস্তানে একটি অনুষ্ঠানে গিয়ে সে দেশের সেনা কর্তার সঙ্গে করমর্দন করেছিলেন। সেই সৌজন্য প্রদর্শন পছন্দ হয়নি ছদ্ম দেশপ্রেমীদের। সিধুকেও রাতারাতি পাকিস্তানি বলে দেগে দেওয়া হয়েছিল। ক্রিকেট প্রেমকে দেশপ্রেম হিসেবে তুলে ধরা একেবারে পরিকল্পিত রাজনৈতিক চিত্রনাট্য।
ভাবুন তো বিরাট কোহলির পরিবর্তে যদি মহম্মদ শামি সেই পাক ক্রিকেটারটিকে আলিঙ্গন করতেন, কেমন প্রতিক্রিয়ার মুখোমুখি হতে হত বিশ্বকাপে শ্রেষ্ঠ বোলালের সম্মান ছিনিয়ে আনা এই ক্রিকেটারের? হয়তো তৎক্ষণাৎ সীমান্তে পাঠিয়ে দেওয়া হত শামিকে।
কথায় কথায় ধর্ম টেনে আনা ক্রিকেট মাঠে নতুন ঘটনা নয়। সামাজিক মাধ্যম যখন ছিল না, তখনও মাঠে, পথে-ঘাটে গলাবাজি চলত। ভারতীয় ক্রিকেটের একদা মহানায়ক মহম্মদ আজহারউদ্দিনের কী দশা হয়েছিল সকলেরই জানা। আজহারের মাঠ শাসনের দিনগুলিতে তাঁর ব্যাটিং, ফিল্ডিং দক্ষতা ছিল প্রিয় গান, প্রিয় বই, জনপ্রিয় সিনেমার মতোই, বারেবারে, ফিরে-ফিরে দেখার মতো। বছর চার-পাঁচ আগে দিল্লির পাঁচতারা হোটেলের লবিতে দেখা দৃশ্যটি মনে পড়ল। প্রাক্তন এই ভারতীয় অধিনায়ককে ঘিরে হুড়োহুড়ি পড়ে গিয়েছে। সই শিকারিদের ভিড়ে পোলিও আক্রান্ত একটি বাচ্চা ছেলের কথা মনে রাখার মতো। আজহারকে সে বলল, ‘ক্রিকেট নিয়ে আমার দুটো অপ্রাপ্তি। এক, শারীরিক কারণে এত ভাল খেলাটা আমি খেলতে পারি না। দুই, আমার জন্মের আগেই আপনি অবসর নিয়েছেন। মাঠে আপনার খেলা দেখা হয়নি।’ ছেলেটি শুনলে নিশ্চয়ই দুঃখ পেত যে তাঁর স্বপ্নের নায়ককে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ম্যাচে ক্যাচ মিস করায় কী পরিমাণ আক্রমণের মুখে পড়তে হয়েছিল স্রেফ মুসলমান বলে।
কিন্তু সেদিনও যা ছিল, আজ তাও নেই। ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ডের প্রেসিডেন্ট কলকাতাবাসী জগমোহন ডালমিয়া আজহারের প্রতি ধর্মীয় বিদ্বেষমূলক আক্রমণের বিরুদ্ধে সাফ বলেছিলেন, ‘এসব চলবে না। এমন ঘৃণ্য আচরণ দেশ ও খেলার মাঠের সংস্কৃতির পরিপন্থী।’
শামিকে সাম্প্রদায়িক আক্রমণের দিনগুলিতে ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ডের মাথায় ছিলেন আর এক কলকাতাবাসী। আশ্চর্য নীরবছিলেন সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়। শামিকে আক্রমণের জবাবে তাঁর বোর্ডও সেদিন একটি শব্দ উচ্চারণ করেনি। নীরব ছিলেন ক্রীড়ামন্ত্রী অনুরাগ ঠাকুর, বোর্ড সচিব জয় শাহও।
আমদাবাদে ফাইনালে ভারতের হারের পর নানা কথার মাঝে ক্রমশ যে ধারণাটি পরিপুষ্ট হচ্ছে তাহল ‘মোদী স্টেডিয়ামে জিতল ভারত’ দেশের দণ্ডমুণ্ডের মাথাদের অনেকেই এমন একটি শিরোনাম প্রত্যাশা করেছিলেন। আশাভঙ্গ করে শিরোনাম হয়েছে, ‘মোদী স্টেডিয়ামে হার ভারত/ইন্ডিয়ার।’ স্বপ্ন ভঙ্গের লোকসান পুষিয়ে নিতে মঞ্চস্থ হয়েছে বুকে জড়িয়ে ধরার রাজনীতি। এভাবেই ভারতীয় ক্রিকেটের এবার পুরোদস্তুর রাজনীতির অঙ্গনে প্রবেশ ঘটল কি?