হিন্দোল ভট্টাচার্য
ম্যানহাটন প্রজেক্টের অন্যতম একজন ব্যক্তি ছিলেন বিখ্যাত পদার্থবিজ্ঞানী রিচার্ড ফিনম্যান (কেউ কেউ বলেন ফাইনম্যান)। যখন কোনও বিজ্ঞানী বা প্রযুক্তিবিদ চিঠি পাঠাতেন, সেটি সেখানকার গোয়েন্দারা আদ্যোপান্ত পড়তেন। তার কারণ তা নাকি
ম্যানহাটন প্রজেক্টের অন্যতম একজন ব্যক্তি ছিলেন বিখ্যাত পদার্থবিজ্ঞানী রিচার্ড ফিনম্যান (কেউ কেউ বলেন ফাইনম্যান)। যখন কোনও বিজ্ঞানী বা প্রযুক্তিবিদ চিঠি পাঠাতেন, সেটি সেখানকার গোয়েন্দারা আদ্যোপান্ত পড়তেন। তার কারণ তা নাকি ছিল জাতীয় নিরাপত্তার বিষয়। এই বিষয়টি মোটেই পছন্দ হয়নি রিচার্ড ফিনম্যানের। তিনি একটি চিঠি লিখে তা কুটি কুটি করে ছিঁড়ে খামে ভরে এলোমেলো করে বউকে পাঠাতেন। গোয়েন্দারা সেই ছেঁড়া কাগজের টুকরোগুলি থেকে কিছুই বুঝতে পারতেন না। কিন্তু ফিনম্যানের স্ত্রীও ছিলেন তেমন। তিনি ছেঁড়া কাগজের টুকরোগুলি থেকেই চিঠির মর্মার্থ উদ্ধার করে আবার একটি চিঠি লিখে ছিঁড়ে ছেঁড়া কাগজের টুকরোগুলি পাঠাতেন রিচার্ডকে। এমন চলতে থাকলে আমেরিকার গোয়েন্দা বিভাগ সটান উপস্থিত হলেন ফিনম্যানের কাছে। উত্তরে ফিনম্যান জানালেন- আমি আমার স্ত্রীকে কী লিখছি, তা জানাব কেন? বুদ্ধি থাকলে জেনে নিন। গল্পটার অবতারণা করলাম এ কারণেই, যে ভারতের কোটি কোটি মানুষ ফিনম্যান নন। কিন্তু ফিনম্যান যেটি বলতে চেয়েছিলেন তা একজন সাধারণ মানুষের ক্ষেত্রেও সত্য। আমার গোপনীয়তা আমার রাষ্ট্রকে জানাতে আমি বাধ্য নই। কখন কার সঙ্গে প্রেমালাপ করছি, কত টাকা কোন ব্যাঙ্কে রাখছি, কোন দলকে আমি সমর্থন করছি, কোন রাজনীতিবিদ সম্পর্কে আমি কী ধারণা পোষণ করছি, - এ সমস্ত বিষয় আমি জানাবই বা কেন আমার রাষ্ট্রকে? প্রথম কথা হল, দেশের নিরাপত্তা বলতে এই মোদী ত্যাগী যোগী শাহরা যে কথা বলতে চাইছে্ তা হল নিজেদের নিরাপত্তা। এ তো বোঝাই যাচ্ছে, যে, দেশ সবথেকে বেশি বিপন্ন এদের-ই হাতে। কিন্তু আপনাদের কে অধিকার দিল দেশের জনগণের ফোন ট্যাপ করতে, ইমেল দেখতে, চ্যাটবক্স দেখতে? এই ধারণা যদি আপনাদের থাকে, যে ক্ষমতায় আছেন বলে, এ দেশের আপনারাই রক্ষক, তাহলে তো ভুল। আপনারা হলেন ভক্ষক। তবে এসব কথা আর এ যুগে কেনই বা বলছি? রাষ্ট্র মানেই তো জনগনের উপরে নজরদারি রাখার ব্যবস্থা। ফুকোর কথা বললেই সবাই তেড়ে আসে তাত্বিক বলে, কিন্তু কেন তেড়ে আসে জানি না। আমার তো মনে হয় প্যান অপ্টিক্যানের ভাবনার মতো রাষ্ট্রতত্ত্বের প্র্যাকটিকাল যদি কেউ দেখতে চান, তবে আপনার এই মুহূর্তে এ দেশে আসা উচিত।
গোটা দেশটাই যে এখন একটা পাগলাগারদে পরিণত হয়েছে সে বিষয়ে কারো সন্দেহ থাকার কথা নয়। আর পাগলের মতোই সব কিছুই মেনে নিচ্ছি আমরা এই দেশের আমজনতা। এই ধরুন, কিছু মানুষ ৭০০ কোটি টাকা খরচ করবে বিয়ের সন্ধেবেলায়, তাদের মধ্যে একজনের মেয়ের বিয়েতে একটি কার্ডের দাম হবে তিন লক্ষ টাকার উপরে, এ জিনিস এ দেশের জনগণ মেনে নিয়েছে। মেনে নিয়েছে গোরুর জীবনের মূল্য সাধারণ মানুষের জীবনের মূল্যের চেয়ে বেশি। মেনে নিয়েছে রাম এক ঐতিহাসিক চরিত্র, হনুমান মুসলমান সম্প্রদায়ের লোক। মেনে নিয়েছে রিজার্ভ ব্যাঙ্কের গভর্নরের পদে বসার জন্য এ দেশে মোদী নামক রাজার ইচ্ছেটাই বড় কথা। মোদীর ইচ্ছেতেই তাই কখনও নোটবন্দী হবে তো কখনও নেটবন্দী হবে। মোদীর ইচ্ছেতেই সব হবে। আগেকার দিনে কী হত? রাজারাজড়ারা বা জমিদারেরা লাঠিয়ালদের পাঠাত। তারা ঘরে ঘরে ঢুকে মুখে কুলুপ এঁটে ফসল নিয়ে চলে আসত। যারা কুলুপ আঁটতে চাইত না, তাদের হত্যা করত। দেওয়ালে আড়ি পেতে জেনে নিত কার মনের খবর কী! সবাই তটস্থ হয়ে থাকত, ওই বর্গী এলো দেশে। কিন্তু এখন আর সে যুগ নেই। সকলের সামনে প্রকাশ্যে নগ্ন ভাবে শাসন করা সৌজন্য নয় ঠিক। তাহলে কী করা উচিত? ঘরের মধ্যে ঢোক, জানিয়েই ঢোক। আড়ি পাত। ট্যাপ কর। হ্যাক কর। একশো কোটি মানুষের জীবনকেই হাতের তালুর মধ্যে নিয়ে আস। বিন্দুমাত্র সন্দেহের কিছু দেখলেই, তাকে কেস দাও। গ্রেফতার কর। ঠিক যেমন মণিপুরের সাংবাদিককে করলে। আদৌ সে দেশদ্রোহী কিনা জানা নেই, কিন্তু মনে যখন হচ্ছে, বিপদ হতে পারে, আগে ভাগেই গ্রেফতার কর তাকে। দেশবাসীর কাছে সংবাদ যাক, আমরা কিন্তু নজরে রেখেছি, বেগরবাই দেখলেই ক্যাঁক করে ধরব।
মৌলিক অধিকারের কথা বললেন কেউ? গণতন্ত্রের কথা বললেন? বৃটিশরা সেই কবে প্রেস আর বাক স্বাধীনতার উপরে হস্তক্ষেপ করার একটা আইন করেছিল। এ নাকি সেই আইনের একটা উন্নতমানের রূপ। কেন? প্রশ্ন উঠতেই পারে। বৃটিশ শাসকরা কি দেশপ্রেমী ছিল? ছিল না। ছিল এ দেশে তাদের ক্ষমতাপ্রেমী। সেই ক্ষমতার বিরুদ্ধে, শাসনের বিরুদ্ধে জনমত গড়ে উঠছিল, কনসেন্ট গড়ে উঠছিল এমনভাবেই, যে তাকে নিয়ন্ত্রণ করতে তারা সক্ষম ছিল না। এখন সময় বদলেছে। কাগজ, চ্যানেল এসব ছাড়িয়েও শক্তিশালী হয়ে উঠেছে ইন্টারনেট মাধ্যম, সোশ্যাল্ মিডিয়া। খুব সহজেই মানুষ একে অপরের মধ্যে সংবাদ আদানপ্রদান ক্করতে পারছে। আমরা অনেকেই যেমন মনে করি, এখন সবথেকে বড় দেশ হল ফেসবুক, টুইটার বা ইউটিউব। এটা একদিক থেকে তো ভালোই। কিন্তু মুশকিল হচ্ছে, মানুষের মতামতের উপর শাসক ছড়ি না ঘোরাতে পারলে তো মুশকিল। অতএব পেয়াদা লাগাও। কারণ গণতন্ত্র ততক্ষণ-ই গণতন্ত্র, যতক্ষণ তা রাষ্ট্রের শাসকদের গণতন্ত্র। জনগণের নয়। অর্থাৎ শাসক স্বামী স্ত্রীর ব্যক্তিগত কথোপকথনে ঢুকবে, এটা রাষ্ট্রের গণতন্ত্র, জনগণের বাথরুমে ক্যামেরা লাগাবে, ব্যক্তিগত কম্পিউটারের হার্ড ডিস্কে আড়ি পাতবে, এগুলি রাষ্ট্রের গণতন্ত্র। কিন্তু তার বিরুদ্ধে মানুষ কথা বললেই, সে দেশদ্রোহী হয়ে যাবে। সারা বিশ্ব জুড়েই তো এই নজরদারি চলছেই। স্নোডেনের দিব্যি, আজ এই নজরদারি চালানোর ক্ষেত্রেও আমেরিকা রাশিয়া ভারত চিন কোরিয়া বলে আলাদা কোনও দেশ নেই। যার মাধ্যমে আমরা আমাদের কথাবার্তা বলে যাওয়ার সুবিধা পাচ্ছি, তার মাধ্যমেই তারা আমাদের অন্দরমহলে উঁকি দেওয়ার সুবিধা পাচ্ছে। এবার কথা হল, এ বিষয়টি তো রাষ্ট্র করছে এবং করতেই পারত গোপনীয় ভাবে। কী এমন হল, যার জন্য রাষ্ট্রের ঘোষণা করে করতে হচ্ছে, যে এই দ্যাখো, আমি নজর রাখছি তোমাদের উপর? সি আইএ বা কেজিবি যে নজর রাখে তাদের দেশের জনগণের উপর, তা গোপনে। সব কিছু লক্ষ্য রাখছে তারা। কিন্তু প্রকাশ্যে বলছে না। এ নিয়েই তো স্নোডেনের সঙ্গে বিরোধ। রাষ্ট্রের মানুষদের গোপনীয়তা ভাঙার খবর স্নোডেন ফাঁস করে ্দিয়েছিলেন বলেই তাঁর উপর রাষ্ট্রীয় গিলোটিন নেমে এসেছে। কিন্তু কোরিয়া বা চিন এই এত কিছু ভাবে না। বা ভারত সরকারও এত সব কিছু ভাবে না এখন। প্রকাশ্যে সেই বৃটিশ আইনের এক্সটেনশন হিসেবে তারা ডিক্রি জারি করেছে বাক স্বাধীনতার উপর বা মতামতের উপর বা ব্যক্তি স্বাধীনতার উপরে হস্তক্ষেপের। আর তার জন্য শিখণ্ডী হল দেশ।
দেশ মানেটা কী! দেশের জনগণ। কিন্তু জনগণ যখন দেশের শত্রু, তখন দেশ মানে কী, দেশের শাসক। দেশের এক বিশেষ প্রকৃতির শাসক, বিশেষ রঙের শাসক, যারা নিজেদের বিপন্ন ভাবছে বলেই এত নজরদারি চালানোর ঘোষণা করছে, নজরদারি চালাচ্ছেও। এই শাসক যদি বিপন্ন না হত, তাহলে এমন ব্যক্তি স্বাধীনতা হরণের খবর ঢাক ঢোল পিটিয়ে বলত না। কিন্তু এই শাসককে তো জাহির করতে হবে, আমরা কত শক্তিশালী ! জাহির করে বলতে হবে, নজর রাখছি, একটু এদিক ওদিক হলেই গিলোটিন নেমে আসবে। হে জনগণ তোমাদের আর গণতন্ত্র নেই। আমরা আছি। আমরাই তোমাদের হর্তাকর্তা বিধাতা। আমরাই ঈশ্বর। আমরাই ভূত। আমরাই ফিল্টার।
কথা হচ্ছে আমাদের দেশের জনগণ তো সবকিছুই মেনে নেয়। ব্যক্তি-স্বাধীনতা হরণ যে দ্রৌপদীর বস্ত্রহরণের মতোই একটি ব্যাপার, তা এ দেশের জনগণকে কে বোঝাবে, সেটাই হল কথা। আমি এ দেশের নাগরিক, আমি দেশপ্রেমিক- এ কথা বলে এখন উপর নীচে এদিক ওদিকে দেখে অদৃশ্য উপস্থিতির উদ্দেশ্যে বলতে হয়, আমি কিন্তু কিছু বলিনি। বা, আমরা যখন মেসেঞ্জারে চ্যাট করব, তখন জয় ভারত জয় হনুমান জয় মোদী জয় আম্বানী বলে শুরু করব বরং। বা ধরা যাক, আমাদের জিমেল, সেখানে লিখতে হবে মোদি ধর্ম, মোদি কর্ম, মোদিই পরমতপঃ। এই সব করতে হবে। তবেই না দেশপ্রেমিক আপনি! কথার প্রতি , শব্দের প্রতি আপনার আর ব্যক্তি মালিকানা নেই। সবসময় মনে রাখবেন, ঘোস্ট ক্যামেরার মতো আপনাকে লক্ষ্য রাখছে শাসকদেবতা।
বাঁচতে পারেন বটে, যদি সবকিছু থেকে বিচ্ছিন্ন করে নেন নিজেকে। তবে তাহলে তো আপনাকে আগে ধরবে। কেন আপনি বিচ্ছিন্ন করলেন? আপনি কি বিচ্ছিন্নতাবাদী? এ হেন অবস্থায়, আপনি যদি হারবার্টের মতো অন্তর্ঘাতী হন, তাহলে কি আপনাকে নৈরাজ্যবাদী বলবে কেউ? বা কেউ যদি ঘোষণা করে বলে তিনি একজন নৈরাজ্যবাদী, তাহলে কি খুব ভুল করবেন? অজগরের ফাঁসের মতো আপনাকে ঘিরে ধরছে রাষ্ট্র। কিন্তু প্রশ্ন করলেই নাসিরুদ্দিন শাহ-এর মতো আপনাকে একঘরে হয়ে যেতে হবে।
গণতন্ত্র নেই, এ কথা বলার মতো গণতন্ত্রও কি এখন আছে?
মতামত লেখকের ব্যক্তিগতহিন্দোল ভট্টাচার্য। নব্বই দশকের কবি। তুমি, অরক্ষিত, তারামণির হার, জগৎগৌরী কাব্য, মেডুসার চোখ, তালপাতার পুথি, যে গান রাতের, তৃতীয় নয়নে জাগো প্রভৃতি কাব্যগ্রন্থের প্রণেতা। পেশায় বিজ্ঞাপনের কপিরাইটার এই কবি পেয়েছেন জগৎগৌরী কাব্যের জন্য বীরেন্দ্র পুরস্কার।