Latest News

ভাষা শিকড়ের নির্মাতা হাসান আজিজুল হক

ইমানুল হক

একজন লেখকের থাকে দুটি দেশ। একটায় তিনি বাস করেন বা করতে বাধ্য হন। আরেকটিতে মানসিকভাবে বাস করেন।
এভাবেই একসময় ভেবেছিলেন হাসান আজিজুল হক। ভাবিয়েছিলেন আমাদেরও।
হাসান আজিজুল হক বর্ধমানের কাটোয়ার যবগ্রামের মানুষ। দেশভাগের ফলে মানুষ শুধু ওপার থেকে এপারে আসেননি, বা আসতে বাধ্য হননি, নিরাপত্তার জন্য এপার থেকে ওপারে গেছেন বা যেতে বাধ্য হয়েছেন লাখ লাখ মানুষ।
সংখ্যাটা যথাক্রমে ৭০ লাখ ও ৭২ লাখ।
দেশভাগ নিয়ে বহু লেখা হয়েছে। বেশিরভাগই ওপার থেকে এপারে আসা মানুষের জবানবন্দি বা নির্মাণ। ওপারে যাওয়া মানুষেরা ইচ্ছাকৃতভাবে বা অন্য বাধ্যতায় এড়িয়ে গেছেন। হাসান আজিজুল হক ব্যতিক্রম।
দেশভাগ নিয়ে লেখায় হা-হুতাশের আড়ালে একটা চাপা ক্ষোভ, কখনও কখনও সূক্ষ্ম বিদ্বেষ প্রকাশিত হয়ে যায়। ব্যতিক্রম হাতে গোনা।
সেদিক থেকে তিনটি উজ্জ্বল ব্যতিক্রম আছে।
এক, হাসান আজিজুল হকের ‘আগুনপাখি’
দুই, সুনন্দা শিকদারের ‘দয়াময়ীর কথা’
তিন, প্রফুল্ল রায়ের ‘কেয়াপাতার নৌকা’।
জয়া চ্যাটার্জি বা সেমন্তী ঘোষ বা অমল সরকারের বই প্রবন্ধের। সেগুলোও এই ধারার।
হাসান আজিজুল হকের মৃত্যুর পর সব লেখাতেই দেশভাগ প্রসঙ্গ আসছে। আসাই স্বাভাবিক। অনেক আগেই এগুলো আলোচনার দরকার ছিল। হয় নি। সেটাই আশ্চর্য।
আলোচনা একেবারে হয় নি বলব না, কিন্তু নমো নমো।

লাহোর জিসনে দেখা নেহি ও জম্মাই নেই, একটি তুলসী গাছের কাহিনী, মাম্মো– এইসব নাটক, গল্প, চলচ্চিত্রে আমরা দেশভাগের একটা ভিন্ন বয়ান পেয়েছি, যা চেনা ছকের বাইরে। সাদাত হাসান মান্টো, খুশবন্ত সিং, হিন্দি লেখক কমলেশ্বর রাও আরেক বাচনের নির্মাতা।
কিন্তু হাসান আজিজুল হক অন্যভাবে উজ্জ্বল।
দেশভাগ মানে দারিদ্র্য, লাঞ্ছনা, অপমান, অত্যাচার, নির্যাতন, তবে তার পাশাপাশি কিছুটা সহায়তা সহানুভূতি সমবেদনা আশ্রয়ের কথাও আছে দেশভাগ নিয়ে নানা লেখায়।
তার চেয়ে বেশি যা আমাকে টানে মানসিকভাবে কাঙাল হয়ে যাওয়ার অকল্পনীয় যন্ত্রণার বর্ণনা।
হাসান আজিজুল হকের ‘আত্মজা ও একটি করবী গাছ’ আমাদের শুধু চমকে দেয় না, ভয় পাইয়ে দেয়।
শুধু দুটো টাকার জন্য, ভাতের জন্য মেয়ের ঘরে বখাটে লম্পট ছেলেদের ঢুকিয়ে দিচ্ছে একদা মধ্যবিত্ত বাবা। আর রুগ্না অসুস্থ স্ত্রী প্রতিবাদ করলে হিংস্র হয়ে উঠছে স্বর, ‘চুপ কর, চুপ কর তুই মাগি’।
অথচ এই লোকটাই লম্পটদের কাছে বিনীত নম্র সুবচন।

হাসান আজিজুল হক এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, নিজের চোখে দেশভাগের শিকার বাবাদের দেখেছেন পূর্ব পাকিস্তানে। কীভাবে দেশ ত্যাগ করে চলে আসতে বাধ্য হওয়া মানুষ বেচে দিচ্ছে বিবেক।
এ গল্প আমাদের ভয় পাইয়ে দেয়।হাসান আজিজুল হক ভয় পাওয়ান।
অবস্থা বোঝান।
অবস্থান নিতে বলেন।
এবং আমাকে যা বিস্মিত করে, তা হচ্ছে, মার্কেজিয় বিস্ময়।
গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজ তাঁর ‘সরলা এরেন্দিরা ও তার নিদয়া ঠাকুমার কাহিনি’তে দেখিয়েছিলেন, ঠাকুমা তার পুড়ে যাওয়া ক্ষতি পুষিয়ে নিতে নাতনির ঘরে লোক ঢোকায়।
লাইন দিয়ে ঢোকে লোক।
আর হাসান আজিজুল হকের গল্পে বাবা গল্প করেন মেয়ের দেহ ভোগ করতে আসা লোকের সঙ্গে। তার দুটাকা দেওয়ার ক্ষমতা নেই।
তাকে শোনান আসার সময় নিয়ে এসেছেন একটি করবী গাছ। করবী গাছের বীজে বিষ আছে। সেই বীজ খেতে পারেন না। উল্টে সমাজের বিষ দেশভাগের বিষ ভক্ষণ করেন দেশভাগের বলি পিতা।দেশভাগের বিষ অনেক। অনেক কিছু ত্যাগ করতে হয়েছে দেশ, মাটি, বাড়ি, চেনা সমাজ, তার সচল অর্থনীতি, নিরাপত্তা। এই ফেলে আসা একটি হচ্ছে, ভাষা।
নিজের ভাষা বলা যাচ্ছে না স্বচ্ছন্দে। যেখানে বাস করতে বাধ্য হচ্ছেন মানুষ, সেই এলাকার মানুষ অবজ্ঞার সঙ্গে শুনছেন, বাঁকা চোখে তাকাচ্ছেন– এ তো যেকোনও দেশত্যাগী উদ্বাস্তুর চেনা জীবন।
এখন তো আবার অন্য সমস্যা। সবাই আন্তর্জাতিক হতে চান। প্রমিত হতে চান। নিজের মুখের ভাষার বদলে কাগজের ভাষা, টিভির ভাষা বলতে চান অনেকেই।
কিন্তু যাঁরা চান না। যাঁরা মাটি ছাড়তে বাধ্য হয়েছেন, কিন্তু মাতৃভাষা ছাড়তে চাননি, তাঁদের কাছে আশ্রয়– ‘আগুনপাখি’।
‘আগুনপাখি’ আমারও আশ্রয়।
বর্ধমানের গ্রামাঞ্চলের ভাষা অবিকল ধরে রেখেছেন হাসান আজিজুল হক।
এখন তো বদলে যাচ্ছে জীবনধারা, জীবনচর্যা, জীবনবোধ, ভাষাও।
এখন আর গবাং করে পুকুর জলে ঝাঁপ দেয় না ন্যাংটো বালক, ঝুঝকি বেলায় ঘুম ভাঙে না নরনারীর। এখান সবার সকাল হয়‌। এগনে এখন আঙ্গিনা, উসারা হয়ে গেছে দাওয়া। পালকি চড়ে বউ আসে না। টোপ্পর পরা গোরুর গাড়ি অমিল।
ভালোবাসা আছে, মন্দবাসা নেই।বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় লিখেছিলেন যে বাংলা একদিন ডেড ল্যাঙ্গুয়েজ হয়ে যাবে, বাঙালি একদিন ডেড রেস (জাতি) হয়ে যাবে, অপু এদের কথা লিখে যাবে।
হাসান আজিজুল হক বর্ধমানের বাঙালিদের মুখের ভাষাকে অমর করে রেখে গেলেন। কেমন ছিল বর্ধমানের গ্রামীণ জীবন, তারও একটা ছবি মিলবে। আপাতদৃষ্টিতে মুসলিম জীবনের ছবি মনে হলেও ঘরে ঘরে ছিল এই ছবি।
ভাষা ছাড়াও আমি মনে রাখব উপন্যাসের কেন্দ্রীয় প্রধান চরিত্র একজন নারী। এটা আমাদের মধ্যযুগের সাহিত্যের অন্যতম বৈশিষ্ট্য।
আমাদের মধ্যযুগের ভালো গুণ ফুটে উঠেছে ‘আগুনপাখি’তে।
একজন সাদাসিধে সরল নারী, স্বামীর মুখের কথাই যাঁর কাছে সব, যিনি বলেছিলেন, সোংসারে আমার দেখার কিছু নাই। বাড়ির গিন্নি আছে, সেই দেখবে। যা করবার সেই-ই করবে। বড় বউ। আর আমি শুদু ঘুন্নিপাক খেলেই হয়ে যাবে। হ্যাঁ, সেই আমি ঘানি টানতে লাগলাম, সারা জেবন একবারও থামতে পারলাম না। ডাইনে বললে ডাইনে, বাঁয়ে বললে বাঁয়ে। শুদুই হুকুম তামিল করি। অ্যাকন মনে হয়, জেবনের কুনো কাজ নিজে নিজে করি নাই, নিজের ইচ্ছা কেমন করে খাটাতে হয় কুনোদিন জানি নাই।’
তারপরই তাঁর প্রশ্ন: আমি কি মানুষ, না মানুষের ছেঁয়া?
এবং মোক্ষম জিজ্ঞাসা: তাও কি আমার নিজের ছেঁয়া?নিজের ছায়াও যাঁর নিজের ছিল না, সেই নারীই পরিবারের সবার ইচ্ছের বিপক্ষে একা থেকে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন, নিজের দেশে।
‘একই দ্যাশ, একইরকম মানুষ, একইরকম কথা, শুদু ধম্মো আলেদা, সেই লেগে একটি দ্যাশ একটানা জায়গা থেকে একটো জায়গা থেকে আলেদা আর একটো দ্যাশ হয়ে হয়ে গেল, ই কুনোদিন হয়? এক লাগোয়া মাটি, ইদিকে একটি আমগাছ, একটি তালগাছ! তারা দুটো আলাদা দ্যাশের হয়ে গেল?’
তাই তিনি যাবেন না।
যাবেন না কেন?
‘আমাকে কেউ বোঝাইতে পারলেনা ক্যানে আলেদা একটো দ্যাশ হয়েছে গোঁজামিল দিয়ে যিখানে শুধু মোসলমানরা থাকবে কিন্তুক হিঁদু কেরেস্তানও আবার থাকতে পারবে। তাইলে আলেদা কিসের? আমাকে কেউ বোঝাইতে পারলেনা যি সেই দ্যাশটা আমি মোসলমান বলেই আমার দ্যাশ আর এই দ্যাশটা আমার লয়।’

হাসান আজিজুল হক আমার দ্যাশের নয়, দেশের লোক।
আমার গ্রামের ভাষাকে ভাষা দিয়েছেন তিনি।
তাঁর সঙ্গে বহুবার দেখা হয়েছে। কথা হয়েছে ফোনে। ২০১৫তে তাঁর জন্মদিনে নবনীতা দেবসেন, পবিত্র সরকার, অমর মিত্র, স্বপ্নময় চক্রবর্তী, সুমিতা চক্রবর্তী, চন্দন সেন, জিয়াদ আলি মিলে আমার উদ্যোগে ঢাকায় তাঁর জন্মদিন পালন করি। ছিলেন প্রয়াত মনীষা ব্যক্তিত্ব শামসুজ্জামান খান।
গিয়েছি তাঁর রাজশাহির বাড়িতে।‌ বিহাস-এ। ২০১৬তে চিহ্নমেলায় তাঁর সঞ্চালনায় ‘হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি কে!’-এই বিষয়ে আলোচনায় অংশ নিয়েছি আনিসুজ্জামান স্যার, সেলিনা হোসেন, সনৎকুমার সাহা, ও লেনিন ভাইয়ের সঙ্গে।
২০১৯এ দেবেশ রায় রাজশাহিতে এক আলোচনায় আমার কথার সূত্র ধরে উত্তেজিতভাবে উঠে এসে বললেন, এই আম্রকুঞ্জে তাঁকে প্রেমে পেয়েছে। প্রেম সব গল্পের চাবিকাঠি। শ্রোতার আসনে ছিলেন হাসান আজিজুল হক।
শেষে স্নিগ্ধ কৌতুক: ‘দেবেশবাবু আমের বনে প্রেম!’

সহজ কৌতুক আর তীক্ষ্ণ ধীশক্তি, পর্যবেক্ষণ ক্ষমতায় মুখের ভাষার লেখক হয়ে বেঁচে থাকার মন্ত্র শিখিয়ে গেছেন হাসান আজিজুল হক।
তিনি ভাষা শিকড়ের নির্মাতা।

You might also like