এই দেশ যে বিচিত্র তা সকলেই জানেন। বিশেষ করে ভুবনায়ন পরবর্তী ভারতবর্ষ যে নিজের দেশের মধ্যেই ঠিক কতগুলি, তা ভাবলেও আশ্চর্য হতে হয়। যদিও এই গুলিয়ে যাওয়া ধারণার 'দেশ' নিয়েই উগ্র জাতীয়তাবাদের বাতাবরণ এমন ভাবেই তৈরি যে তা রাষ্ট্রের কাছে এখন এক বেশ উপাদেয় অস্ত্র।
আর তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে মিডিয়াসন্ত্রাস। একজন অভিনেতা আত্মহত্যা করলেন, না তাঁকে নিহত হতে হল, তাঁর মৃত্যুর নেপথ্যে বলিউডের ড্রাগ কার্টেল যুক্ত কিনা তা অবশ্যই তদন্ত সাপেক্ষ। কিন্তু গত কয়েক সপ্তাহে এক বিশেষ সাংবাদিক ও চ্যানেল এবং তাদের দেখাদেখি অন্য অনেক চ্যানেল এই সংবাদ ও তদন্তকে এক প্রত্যক্ষদর্শী ফিকশনের জায়গায় নিয়ে গেছে। বাড়িতে বাড়িতে মোবাইলে পাবজি গেমের মতোই চলছে রানিং কমেন্ট্রি। এসেছেন বিপ্লবী অভিনেত্রী। যিনি বেআইনি নির্মাণ করেছেন এটা খবর নয়, তার বেআইনি নির্মাণ বুলডোজার দিয়ে ভাঙাটা খবর। যে পরিপ্রেক্ষিতে এই বুলডোজার সন্ত্রাস, তারও অবশ্যই ইতহাস ও বর্তমান আছে। কিন্তু এই সব বিষয় হয়ে দাঁড়াচ্ছে ভারতের মুখ্য সংবাদ। যেন এগুলি ভারতীয় গণতন্ত্র, মানুষের মৌলিক অধিকার, বেঁচে থাকার পরিসর এই সবের জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ।
মিরোশ্লাভ হোলুবের লেখা একটি কবিতায় পড়েছিলাম কেমন একটি বাচ্চা মেয়ের খিদের যন্ত্রণা থেকে তার মন ফিরিয়ে রাখার জন্য তার মা তাকে গল্প শোনাচ্ছে। সেই মেয়েটি গল্প শুনতে শুনতে ক্রমশ উত্তেজিত হচ্ছে। আর এভাবেই কেটে যাচ্ছে একটি বেলা। সাম্প্রতিক একটি আফ্রিকান ছবিতেও এমন ব্যবহার দেখলাম। সেনেগালের ছবি। বাড়িতে খাবার নেই। চাকরিতে মাইনে নেই। কিন্তু চারিদিকে খবর। এমন সব নির্মিত খবর যে মানুষ হাঁ করে খবর খাচ্ছে।
খবরের মাধ্যমে, মিডিয়ার মাধ্যমে এক মাইনর ঘটনাকে মেজর করে প্রায় চলচ্চিত্রের মতো মুনশিয়ানায় তাকেই দেশের মানুষের কাছে মেজর ও সেনসেশনাল করে তোলার এই ম্যানুফ্যাকচারিং রিয়্যালিটির সঙ্গে আমরা পরিচিত। কিন্তু এই রিয়্যালিটি এমন ভাবেই চারিদিক থেকে আমাদের আবদ্ধ করে রাখবে যে আমাদের পক্ষে অন্য কোনও বাস্তবতার দিকে তাকানোর ফুরসতই পাওয়া যাবে না, ঠিক এমনটা কি আমরা ভেবেছিলাম!
তা না হলে, হিন্দি বলয়ের মিডিয়ার কাছে আমার সামান্য কিছু প্রশ্ন রাখতে চাই। যে দেশে গৌরী লঙ্কেশ, সুজাত বুখারিকে নির্মম ভাবে হত্যা করা হয়, তখন কোনও সাংবাদিক চিৎকার শুরু করেন না ' ইন্ডিয়া ওয়ান্টস টু নো' বলে। যখন ভারভারা রাওকে দীর্ঘদিম অন্তরীন করে রাখা হয়, গ্রেফতার করে রাখা হয়, তখন মিডিয়া এমন উত্তেজক ও প্রতিবাদী কণ্ঠস্বরের চিৎকার শুরু করেন না, তদন্তও না। দেশের হাজার হাজার কৃষক যখন আত্মহত্যা করেন ( এখনও আত্মহত্যার মিছিল অব্যাহত) মিডিয়া তাকে নিয়ে নিয়মিত রাষ্ট্রকে প্রশ্ন করে যাওয়ার ' বাতাবরণ' তৈরি করে না। পরিযায়ী শ্রমিকদের কর্মহীন অবস্থায় রাস্তায় মৃত্যু বা মরতে মরতে হাঁটার কথা কয়েকদিনেই চাপা পড়ে যায়। এ দেশের বর্তমানে প্রধান দুই সমস্যা করোনার ক্রম অগ্রসরমান সংক্রমণ এবং জিডিপির ক্রম অবমূল্যায়ণ। তা নিয়ে কণ্ঠস্বরগুলি খুব জোরালো নয়। গত পাঁচ ছ মাসে সারা দেশে যে কয়েক লক্ষের অধিক মানুষ চাকরি হারিয়েছেন, কর্মহীন হয়ে পড়েছেন, সেও কোনও সমস্যা নয়। কর্মহীন মধ্যবিত্ত, প্রিয়জন হারানো নিম্নবিত্ত, সর্বহারা কৃষক, সর্বস্বান্ত ব্যবসায়ী যদি আত্মহত্যা করেন, তবে সম্ভবত রাষ্ট্রের ও মিডিয়ার কাছে সেগুলি ন্যাচরাল ডেথ। কথা বলার কিছু নেই, তদন্তেরও কিছু নেই। ভুখা পেটে মানুষ যদি খবর আর বিনোদন না খেয়ে আত্মহত্যা করে তবে তা টিআরপি বাড়ায় না। কতিপয় বড়লোক বা উচ্চমধ্যবিত্ত যারা এ সময়ে মানসিক অবসাদে ভুগছিলেন তাঁদের প্রয়োজন স্নায়ু উত্তেজক সংবাদ, দরকার গসিপ ও থ্রিলারের রিয়্যালিটি শো, তবেই না টি আর পি বাড়বে!
আর এই খাবার মানুষের লিবিডোকে উদ্বোধিত করবে যখন, তখন তার ভিতর জেগে উঠবে প্যারাসাইট ছবির ওই সাবওয়ের নীচে থাকা গায়ে গন্ধ লোকেরাও।
কারোর হত্যা হলে তার তদন্ত হোক, কারোর মৌলিক অধিকার হরণ করা হলে তারও তদন্ত হোক, এ দেশের সকলের কণ্ঠস্বরে আসুক প্রতিবাদ, প্রশ্ন করার স্বাধীনতা। এই স্বপ্নই তো দেখেছিলেন কলবুর্গী, গৌরী লঙ্কেশ। এই স্বপ্নই দেখেন এখনও এ দেশের অসংখ্য মানুষ যাদের কণ্ঠরোধ করা হয় প্রকাশ্যে ও গোপনে, নানারকম ভাবেই। এই সব মানুষের লড়াই ভারতীয় রাষ্ট্রের সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে হয়ে যাওয়ায় মিডিয়া আর সে সব নিয়ে কোনও কথা বলতে পারে না। সাংবাদিক হলেও তাঁরাও তো পুতুল। সুতো বাঁধা স্পনসরের হাতে। স্পনসরের সুতো বাঁধা পুঁজির সিন্ডিকেটের হাতে। তার আবার সুতো বাঁধা রাষ্ট্রের হাতে। এবার আসল পরিচালক তো তিনিই, আসল চিত্রনাট্যকারও তিনি। কিন্তু তাঁকে কেউ দেখতে পাচ্ছে না। ড্রাগ কার্টেলও তাঁর পায়ের তলায় আবার ড্রাগ কার্টেলের বিরুদ্ধে প্রতিবাদও। তিনি শুধু কোয়ালিটি নিয়ন্ত্রণ করছেন। কোয়ান্টিটিও। বাড়তে দেওয়া যাবে না। ততক্ষণই চলুক, যতক্ষণ তা তাঁর ও তাঁদের মূল সমস্যাগুলি থেকে মানুষের চোখ কান মন সবকিছুকেই অন্যদিকে ঘুরিয়ে রাখে। শুধু চিন নিয়ে ওয়ার ফিল্ম বা কোল্ড ওয়ার ফিল্ম করে হবে না। এদেশের জন্য থ্রিলার চাই।
সমস্ত কিছুই যে রাজনীতি, তা নিয়ে একবিন্দু সংশয় কারো থাকার কথা নয়, নেইও। কিন্তু কথা হল, সাংবিধানিক ক্ষমতা দখলের রাজনীতি এবং এই রাষ্ট্রীয় মুনাফা, ব্যর্থতা ও সন্ত্রাসকে ঢেকে রাখার জন্য একটা নির্দিষ্ট কম গুরুত্বের বিষয়কে দেশের সর্ববৃহৎ যাত্রাপালায় পরিণত করে এই যে নিশ্চিন্তে বোকা বানানো হচ্ছে দেশের অধিকাংশ মানুষকে, এই যে ক্ষুধার্ত মানুষকে আঁতোয়ানাতের মতো রুটির বদলে মুচমুচে কেক খাওয়ার পরামর্শ দেওয়া, এই কৌশলটিও নতুন নয়। কিন্তু কৌশলের রূপ তো বারবার বদলে যাবেই। তার ইভেন্ট দরকার।
ভারতবর্ষের ৮০% মানুষ ক্রমাগত লড়াই করছেন, মরছেন, ভাগ্যকে দোষ দিয়ে, অসহায় হয়ে আত্মহত্যা করছেন। কখনও রাষ্ট্রের সংগঠিত সন্ত্রাস নেমে আসছে তাদের উপর, কখনও ভাইরাস ও ক্ষুধার প্রকোপে, স্বাস্থ্যব্যবস্থার দুর্দশায় প্রাণ মান সব হারাচ্ছেন। কিন্তু তাঁদের নিয়ে মিডিয়া উত্তেজিত হয় না। জনতার আদালত বসে না। তাদের নীরবে মৃত্যুর কোনও প্রত্যক্ষদর্শী ক্যামেরা নেই।
ক্যামেরা আছে তাঁদের, যাঁদের আসলে কিছুই এসে যায় না। আর তাঁদের পিছনে মিডিয়া দৌড়চ্ছে, তৈরি করছে আলোড়ন। দর্শকদের মধ্যে একটা থ্রিলিং অভিজ্ঞতা তৈরি হচ্ছে। যেন সে নিজেই এক ঘোস্ট ক্যামেরা। আর সেই মুহূর্তে সে ভুলে যাচ্ছে ঘোস্ট ক্যামেরারও ডিওপি থাকে। তার উদ্দেশ্য মোটেই সন্দেহের বাইরে নয়।
কিন্তু কী আর করা যাবে! আপনার ঘাড়ের কাছে নিঃশ্বাস ফেলছে মৃত্যু, কর্মহীনতা, মুদ্রাস্ফীতি, করোনা, ক্ষুধা, খরা, বন্যা, রাষ্ট্রের রক্তচক্ষু। আর আপনার সামনে চলছে যুদ্ধের মহড়ার শো, দেশপ্রেমের সার্কাস, ঘোস্ট ক্যামেরার তদন্ত, হিরোইনের রিয়্যল লাইফ হিরোইজম, রিংমাস্টারের ভাষণ, খবরিওয়ালার নাটমন্দির। এবার ভাবুন আপনি মরতে মরতে মাতবেন, না মাততে মাততে মরবেন?
নাকি বুঝতে পেরে দাবি করবেন সোচ্চারে? প্রশ্ন করবেন এই রাষ্ট্রীয় ও মিডিয়াসন্ত্রাসের বিরুদ্ধে?
* শিরোনাম নেওয়া হয়েছে কবীর সুমনের 'ব্রিগেডে মিটিং' গানটি থেকে।
(লেখক কবি, অনুবাদক ও গদ্যকার। পেশায় বিজ্ঞাপনকর্মী। লিখেছেন পনেরোটি কাব্যগ্রন্থ, দুটি গল্প সংকলন ও একটি উপন্যাস। পেয়েছেন বীরেন্দ্র পুরস্কার (২০০৯) ও অনিতা- সুনীল বসু পশ্চিমবঙ্গ বাংলা অকাদেমি (২০১৮)।)