সুমন গুণ
বাংলায় ফিল্ম-চর্চার প্রথমদিকে কোনও কোনও মান্য লেখক নতুন এই মাধ্যমটির প্রতি বিরূপ ছিলেন। তাঁদের হয়ত মনে হয়েছিল যে ফিল্মের আগ্রাসী সম্ভাবনা কবিতা, বা আরও বড় ভাবে বললে সাহিত্যের লয় ঘটাবে। মনে পড়ছে দীনেশরঞ্জন দাস সিনেমার টানে 'কল
বাংলায় ফিল্ম-চর্চার প্রথমদিকে কোনও কোনও মান্য লেখক নতুন এই মাধ্যমটির প্রতি বিরূপ ছিলেন। তাঁদের হয়ত মনে হয়েছিল যে ফিল্মের আগ্রাসী সম্ভাবনা কবিতা, বা আরও বড় ভাবে বললে সাহিত্যের লয় ঘটাবে। মনে পড়ছে দীনেশরঞ্জন দাস সিনেমার টানে 'কল্লোল' পত্রিকা বন্ধ করে দেবার পরে বুদ্ধদেব বসু মন্তব্য করেছিলেন, বাংলায় ‘সিনেমা প্রথম ক্ষতি করল কল্লোলের অপমৃত্যুর জন্য অন্তত আংশিকরূপে দায়ি হয়ে’।
কবিতায় এতটাই অনুগত ছিলেন বুদ্ধদেব বসু ও তাঁর সময়ের আরও অনেক কবি যে তাঁরা ভয় পেয়েছিলেন সিনেমা হয়তো শুধুই উগ্র বিনোদনের ছদ্মশিল্প নিয়ে ছড়িয়ে পড়বে।
সেই ভয় কাটতে অনেকটা সময় লেগেছিল। সত্যজিৎ রায় পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়েছিল আমাদের। আর তাঁর পরের যুগে, গোটা ভারতের পরিপ্রেক্ষিতেই ফিল্মের মধ্যে কবিতার স্পন্দ যাঁরা রক্ষা করেছিলেন, তাঁদের মধ্যে বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত ছিলেন সফলতম।
জীবনানন্দের 'আট বছর আগের একদিন' বা 'রাত্রি' কবিতা নিয়ে ফিল্মের সম্ভাবনার কথা জানিয়েছিলেন বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত একবার। কিন্তু, আক্ষেপ করেছিলেন তিনি, সমস্যা হচ্ছে এ ধরনের ছবির এদেশে চল নেই। কে দেখবে? ‘ফিল্মের মধ্যে কবিতা’ নামে একটি লেখায় শঙ্খ ঘোষও একবার জানিয়েছিলেন, সত্যি সত্যি কবিতায় ভর দিয়ে গোটা একটি ছবি তৈরি করে ফেলার, কিংবা ছবির আদলকে পুরোপুরি ভেঙে দিয়ে তার মধ্যে অবচেতনকে ধরবার কবিতাস্পষ্ট আয়তন নিয়ে আসা, সে সব চর্চায় পৌঁছতে বাংলা ফিল্মের আরও খানিকটা সময় লেগে যাবে বলে মনে হয়। বুদ্ধদেব দাশগুপ্তর অনেক ছবিতেই কিন্তু প্রত্যক্ষ ও অবচেতনের এই ছায়াচ্ছন্ন আন্তরিকতা নিয়ে কাজ আছে। 'রাত্রি' বা 'আট বছর আগের একদিন' নিয়ে হয়ত করতে পারেননি, কিন্তু তিনি 'নিম অন্নপূর্ণা' নিয়ে ছবি করেছেন। তাঁর সময়ে অপর্ণা সেনের 'যুগান্ত' ছাড়া, ‘দূরত্ব’, ‘চরাচর’, ‘উত্তরা’ বা ‘আনোয়ার কা আজব কিসসা’-র মতো আর কোনও ছবি কবিতার শাখাপ্রশাখাময় দিগন্ত, ফিল্মের ভাষায় স্পর্শ করতে পারেনি। ‘দূরত্ব’ ছবিটি, বুদ্ধদেব দাশগুপ্তের শেষ হয়েছিল এমন অসমাপ্ত অথচ সম্ভাবনাময় ভাষ্যে : ‘আজও মেঘ করেছে। কালো হয়ে এসেছে আকাশ। হয়তো বৃষ্টি আসবে’। হয়তো শব্দের অনিবারণীয় দ্বিধা না থাকলে গোটা কথার মানে পালটে যেত প্রায় পুরোটাই। সোজাসুজি কোনও সমাপ্তির, সূচনারও ফ্রেম বুনে নিতে পারতেন দর্শক। যে-কারণে সেটি হল না, তার সঙ্গে সখ্য আছে কবিতার নিজস্ব ব্যাকরণের। ঘটনা ও সম্ভাবনা, গন্তব্য ও অনুভবের মধ্যে যে-স্বয়ংক্রিয় ব্যবধান, এ-ছবি তারই কয়েকটি গমক ছুঁয়ে ছুঁয়ে তৈরি। ফলে, কোনও মান্য নির্ণয়, কোনও পর্যায়েই, পাওয়া যাবে না এ-ছবিতে। দেখা হবে না কোনও সম্পর্কেরই স্পষ্ট উপসংহার; কোনও ঘটনা, সিদ্ধান্ত ও সমাধানের ছক বুঝে এগোবে না কিছুতেই। তাই, গোটা ছবিটিই তৈরি হয় দুটি-একটি গৌণ ব্যতিক্রম নিয়েই, তলে তলে, অনুচ্চ অস্পষ্ট অসমাপ্ত সংলাপে। সবসময় ঠিক সংলাপেও নয়। আধো কথায়, অন্যমনস্ক সিগারেট হাতে মন্দারের ভঙ্গিতে, দূরদৃষ্টির উদাসীনতায়। ছবিতে জটিলতার আর একটি মাত্রা খুলে গেছে মন্দারকে অঞ্জলির এই প্রশ্নে : সবাই বুঝতে পারে এমন সহজ কথা বলতে পারেন না? একেবারে এই প্রশ্নই প্রায়, মনে পড়ছে, ‘ফেরা’য় সেই প্রজন্মবালক করেছিল তার আর্দ্র অভিভাবককে। সেখানেও এই আবৃত দুর্বোধ্যতার শিয়রে ছিল স্বপ্নের প্রায়-নিভে-আসা আগুন। মন্দারও, যে-মন্দার অঞ্জলির এই অবুঝ প্রশ্নের সামনে দাঁড়ানো, আসন্ন উৎসবের দিকে তাকিয়ে। কিন্তু কখনওই যেন পুরো ফ্রেম, চারকোণা, গড়ে তুলতে চান না পরিচালক। তাঁর কবিমন তাঁকে নিয়ন্ত্রিত করে এখানে। মন্দার পীড়িত হয়েছে অঞ্জলির সংসারের প্রতি লাবণ্যময় আগ্রহে, অঞ্জলি ফিরেও যায় সমস্ত সংসার ঘিরে, হাতে নিজস্ব পেটিকা।
[caption id="attachment_2313161" align="aligncenter" width="590"]'অঞ্জলি'র ভূমিকায় মমতাশংকর[/caption]
‘দূরত্ব’র পরে, বুদ্ধদেবের ছবি আরও অনমনীয় হয়েছে ‘নিম অন্নপূর্ণা’য়। এই ছবিতে, বিষয়ের বিবর্ণ রুক্ষতার জন্যই, রয়েছে এক গুমেটি অসংলগ্নতা। দূরত্বর ঈষৎ বিপরীতে, কথার ব্যবহার এখানে প্রায় পুরোপুরি জৈবিক, অবসন্ন, স্থূল। কাজের তাগিদে কলকাতায় এসে এই খারাপ শহরের নানা ধান্দা ও জটিলতাসঙ্কুল গলিখুঁজি চেনা হয়ে যায় ব্রজর, তার স্ত্রী ও সন্তানদেরও। পর্দায় গতির সঙ্কেত বোঝাতে বিস্তীর্ণ রেললাইনের ছবি। পাশাপাশি ব্রজর একইসঙ্গে বিখ্যাত ও নিস্তরঙ্গ জীবন, চারপাশে নিরন্ন উল্লাস। ঘটনাময় পাখির কাছেই আবার, একটি নিরাবেগ টিয়া। যাকে খাবার জন্য দেওয়া গোটা গোটা ছোলা হরণ করতে গিয়েই রূঢ় বৃদ্ধার কোপে সন্ত্রস্ত হয়ে ওঠে ছবির কিছুক্ষণ। আকাশে তবুও মেঘ, বৃষ্টি পড়ে সামান্য বাড়িতে। কিন্তু ব্রজ-প্রীতিলতার আক্রান্ত সংসার ও তার আশেপাশে, প্রীতিলতার কোপনস্বভাবের অনুষঙ্গেই, শুধু নিভে-যাওয়া সম্পর্কের পরিচয়লিপি। ব্রজর সঙ্গে তার ঈষৎ দাম্পত্যপ্রেমেও শুধু কাতর ও অবসন্ন উষ্ণতা।
ব্রজও, আমাদের সময়ের সমস্ত ব্যর্থ, ভঙ্গুর ও কুশলী মানুষজনের মতোই আহ্লাদে, ক্রোধে, ছলনায় অনবরত ছুটে বেড়ায়। তাদের ছেলেমেয়েরা সজ্ঞানে নয় হয়ত, কিন্তু অভিজ্ঞতায়, স্বপ্নের দূরবর্তী আয়তনের দিতে তাকাতে পারে। প্লেনটা যে চাঁদে যাচ্ছে তা টের পেয়েছে তারা। দেখতে পেরেছে সেই প্লেনের অতিমানবিক চালককেও। ‘পথের পাঁচালী’র ঐতিহ্য এখানে মনে পড়বেই, কিন্তু অপু-দুর্গার গ্রামীণ ও একমাত্রিক বিস্ময়পুলকের উলটোদিকে এখানে কর্কশ নাগরিকতার আঁচ টের পাই আমরা। ‘দূরত্ব’ও শহরের ছবি, কিন্তু ‘নিম অন্নপূর্ণা’র শহর টালি ও বেড়ার তৈরি দৈবাৎ দিনযাপনের, মন্দার-অঞ্জলির সমস্যা আর ব্রজ-প্রীতিলতার অনটন একেবারে দুই মাত্রার। মানবিক স্ফূর্তি ও অসঙ্গতির টুকরো সখ্য নিশ্চয়ই আছে, কিন্তু বুদ্ধদেব এ-ছবিতে ছুঁতে চেয়েছেন অন্তর্গত টানাপোড়েনেরও আগে আদিম এক প্রবণতাকে, যার উপায়হীন তাড়নায় বেঁচে থাকে এই সময়েই বেশির ভাগ মানুষ, যে-মুমূর্ষু বেঁচে-থাকাকে লক্ষ রেখে পুরো আকাশ জুড়ে শুধু অসমীচীন চিল ওড়ে।
‘ফেরা’ বা ‘বাঘ বাহাদুর’-এর চরিত্র দুজন যে-অর্থে শিল্পী, ‘চরাচর’-এর লখিন্দর সেভাবে নয়, কিন্তু অনুভূতির লালন ও কল্পনায় সে-ও রচনা করে চলে শিল্পেরই অন্য এক প্রকরণ। তার মাধ্যম পাখি। পাখির প্রতি সর্বস্ব মমতায়, স্নেহে-স্বপ্নে-আলোড়নে সে অন্য সবার থেকে বিশিষ্ট। একজন কবি যেভাবে একক, লখিন্দরও তাই। তাঁর কবিতার মতোই বুদ্ধদেবের ফিল্মও আগাগোড়া কৌণিক ও অসরল। 'চরাচর' এই অসরলতা মায়া দিয়ে, আলো দিয়ে, স্তব্ধতা দিয়ে নমনীয় করেছে ঠিকই, কিন্তু অনিশ্চয়তার অর্চনা এখানেও নির্মম। 'দূরত্ব'র মন্দার ও অঞ্জলির সম্পর্কের অপূরণীয় সখ্য আর এখানে পাখিপ্রবণ লখিন্দরের সঙ্গে সারি আর গৌরীর কুণ্ঠিত সান্নিধ্য এই সূত্রেই পাশাপাশি পড়া যায়।বুদ্ধদেব ‘ফেরা’ পর্বের ছবিগুলিতে দেখিয়েছেন এই বিপণনসর্বস্ব সময়ের সঙ্গে হৃদয়বান মানুষের সংঘর্ষের স্বরলিপি। এই যুদ্ধে মানুষ ক্ষতবিক্ষত হয়, কিন্তু শেষ পর্যন্ত হার মানে না। এই পর্বের সবগুলি ছবির ভাষ্য তাই। ‘ফেরা’য় বিধ্বস্ত যাত্রাশিল্পী, ‘বাঘ বাহাদূর’-এ বিপন্ন লোকশিল্পী, ‘চরাচর’-এ পাখিপ্রবণ মানুষটি, শেষ পর্যন্ত নিজের অনুভবের প্রতি, শিল্পের প্রতি দায়বদ্ধ থেকে যায়। ‘ফেরা’ বা ‘বাঘ বাহাদুর’-এর চরিত্র দুজন যে অর্থে শিল্পী, ‘চরাচর’-এর নায়ক সেভাবে নয়। কিন্তু অনুভূতির লালন ও কল্পনায় সে-ও রচনা করে চলে শিল্পেরই অন্য এক প্রকরণ। তার মাধ্যম পাখি। পাখির প্রতি সর্বস্ব মমতায়, স্নেহে-স্বপ্নে-আলোড়নে সে অন্য সবার থেকে বিশিষ্ট। একজন কবি যেভাবে একক, সেও তাই।
ছবির শুরুতেই সমুদ্রের ওপরে অসংখ্য ডানা আর এই ছন্দের সঙ্গে মিল দিতেই যেন। তারপরেই, প্রস্তুতির মতো একটি খাঁচা, ভেতরে একই রকম চঞ্চল, উচ্ছ্বসিত পাখির গুচ্ছ এবং একটি অবধারিত হাত সন্তর্পণ মমতায় একটার পর একটা পাখিকে মুক্ত করে। পরের দৃশ্যে সেই হাত মুক্ত পাখিগুলিকে ভোর-হয়ে-আসা আকাশে ভাসিয়ে দেয়। প্রসঙ্গটি এবং সেই সঙ্গে দৃশ্যের অভ্যন্তরীণ মিলটিও সম্পূর্ণ হয়।
বুদ্ধদেবের ‘লাল দরজা’র বিষয়, এই নষ্ট সময়ের থাবা উপেক্ষা করে শুদ্ধতায় আরাধনা। ‘চরাচর’-এর মতোই এখানে আছে এমন এক চরিত্র, সারল্য যার রক্তে। ক্ষতশতাব্দীর কোনও প্ররোচনাই যাকে ছুঁতে পারেনি। এই ছবিটিও ‘নিম অন্নপূর্ণা’,‘তাহাদের কথা’র সরণিতেই পড়বে। এই সূত্রেই মনে পড়বে ‘উত্তরা’র সেই অতিলৌকিক দৃশ্যটি। একটি বিপন্ন শিশু ছুটতে ছুটতে হঠাৎ পেয়ে যায় লোকগানের এক দল, সেই দলের একজনের কাছ থেকে মুখোশ নিয়ে পরে ফেলে। উন্মত্ত খুনিরা তাকে আর খুঁজে পায় না। সম্পর্ক আর সংস্কৃতিই যে আমাদের আশ্রয়, আমাদের শুশ্রূষা, এই দৃশ্যটি তার পবিত্রতম উচ্চারণ।
বাংলা ভাষার অগ্রণী কবি ও প্রাবন্ধিক সুমন গুণের জন্ম কলকাতায়। কলকাতা বিশ্ববিদ্যলয় থেকে স্নাতকোত্তর। তুলনামূলক সাহিত্য বিভাগের অধ্যাপক। কৃত্তিবাস পুরস্কার এবং পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি পুরস্কারে সম্মানিত।