
রাজদীপ রায়
একবার পুড়ে গিয়েছিল সে। তবুও সে ফুরিয়ে যায়নি। ছেঁড়া পাতার স্তূপের মধ্যে থেকেই উড্ডীন হয়েছিল তার দগ্ধ ডানা। বাঙালির আবেগের কাছে, আকাঙ্ক্ষার কাছে, বাণিজ্যের কাছে তাকে ফিরে আসতেই হয়েছে অক্ষর হয়ে, অস্তিত্ব হয়ে।
কিন্তু এ-বছরটা আলাদা। পুরো পৃথিবীটাই ভাগ হয়ে গেছে করোনা-পূর্ব ও করোনা-উত্তর কালে। প্রাথমিক প্রভাব কাটিয়ে এখনো ইউরোপের কিছু-কিছু দেশে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে ভাইরাস। লোকসংখ্যার তুলনায় ভারতের তথা পশ্চিমবঙ্গের সুস্থতার হার ইতিবাচক। পেটের তাড়নায় স্বাভাবিক হচ্ছে জীবন-যাপন। এমনকি জেলায়-জেলায় বিভিন্ন বইমেলাও শুরু হয়েছে। তবু সরকার ঝুঁকি নিতে চাইছেন না। কেননা বইমেলা পশ্চিমবঙ্গে হলেও তা আন্তর্জাতিক। আর এই মেলায় ভিড় কেমন হয়, তা বলে দেবার প্রয়োজন নেই। তবে কোথাও একটা মনখারাপ ঘনিয়ে ওঠে। পাঠক এসে এখানেই তো আলাপ করেন তাঁর প্রিয় লেখকের সঙ্গে কিংবা লেখক, যাদের হাতে গ্রহণ-বর্জন হয় তার সৃষ্টি, তাদের চাক্ষুষ করবার সুযোগ পান। বর্ষীয়ান, অগ্রজ ঔপন্যাসিকের মুখোমুখি হয়ে পড়বেন তরুণ কবি। এইভাবে সমস্ত শিল্পকলার এক অনবদ্য মিলনভূমি বইমেলা। এবং এর বাইরেও যে-ক্ষেত্রটি একেবারেই উপেক্ষার নয়, বরং আরও বেশি গুরুত্বের, সেই বই বিক্রির বিষয়টা প্রায় অধিকাংশই নির্ভর করে থাকে বইমেলার সময় জুড়ে। পয়লা বৈশাখ বইপাড়ায় খুব ঘটা করে পালন হলেও বাংলা বই বিক্রির কোনও বৃহত্তর বাজার তৈরি হয় না। একই কথা বলা যায় দুর্গাপুজোর সময়ের ক্ষেত্রেও। শারদীয় সংখ্যার বাইরে বইপ্রকাশের হিড়িক সেখানেও অনুপস্থিত।
এই ভরা শীতের সময়ে, অর্থাত্ ডিসেম্বর-জানুয়ারি করে যদি আপনি বইপাড়ায় পা রাখেন, খুব অনায়াসেই চোখে পড়বে ব্যস্ততা। বই একটি উত্কৃষ্ট পণ্য। সেই পণ্যের সঙ্গে জড়িত আছেন প্রকাশক, মুদ্রক থেকে শুরু করে বাঁধাইকর্মী পর্যন্ত। কনকনে এই ঠান্ডার সময়ে উষ্ণতা বলতে তাদের কাছে বইমেলার বৃহত্ ইভেন্ট। শুধু কি কলকাতা? তামাম শহরতলি, মফস্সল, গ্রামে-গঞ্জে ছড়িয়ে থাকা অসংখ্য পত্রিকা, বই, এই সময়ের দিকে তাকিয়ে প্রকাশ পায়। একজন লেখক তাঁর বইটি প্রকাশের জন্যে এই সময়টিকেই প্রধানত বেছে নেন। কারণ? নিঃসন্দেহে জনসংযোগ। এমনিতেই বইবাজারের মূল বাণিজ্য কলেজ স্ট্রিট অঞ্চলে সীমাবদ্ধ। মালদার ‘পুনশ্চ’, শান্তিনিকেতনের ‘সুবর্ণরেখা’,’রামকৃষ্ণ বুক স্টোর’, সাঁইথিয়ার ‘চয়নিকা’, মেদিনীপুরের ‘ভূর্জপত্র’, উত্তর দিনাজপুরের ‘ধানসিড়ি’, শিলচরের ‘আবাহন’, প্রভৃতি আউটলেট এই বাণিজ্যের বিকেন্দ্রীকরণে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেছে। তবুও এই প্রবণতা খুব বেশি দেখা যায় না, একজন বই-ক্রেতা ও পাঠক কলেজ স্ট্রিটের বাইরে যেতে খুব স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করছেন। এই বিপণিগুলিও নির্ভরশীল কলেজ স্ট্রিটের কাছেই। কেননা তাদের যোগাযোগ করতে হয় প্রকাশকের ঠেকে, যার বেশিরভাগই বইপাড়ায়, আর বাকিটা কলকাতারই মধ্যে। মেদিনীপুর, তারকেশ্বর কিংবা বনগ্রামের পাঠককেও তাই প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে কলেজ স্ট্রিটের মুখাপেক্ষী হয়েই থাকতে হয়। তবে এই অবস্থার খানিক পরিবর্তন হচ্ছে। গেল ডিসেম্বরেই লিটল ম্যাগাজিন মেলা নির্বিঘ্নে সম্পন্ন হয়েছে পুরুলিয়ায়। ঘোষণা হয়েছে তারকেশ্বর লিটল ম্যাগাজিন মেলার দিনক্ষণ। কলকাতা লিটল ম্যাগাজিন মেলাও অনুষ্ঠিত হতে চলেছে ফেব্রুয়ারিতেই। লিটল ম্যাগাজিন ও লিটল ম্যাগাজিন প্রকাশনার বই বিপণনের ক্ষেত্রে যা সুসংবাদ।
অন-লাইন বিপণন এই করোনা-কালে ত্রাতার ভূমিকা পালন করেছে । অন-লাইনে ডোর-স্টেপ ডেলিভারির আশ্বাস দিয়ে বই পৌঁছে দিয়েছে বেশ কিছু পরিচিত ও নবাগত সংস্থা। অন-লাইনে বিক্রির সাফল্যের কথা বলতে শোনা গেছে কলেজ স্ট্রিটের নামী প্রকাশককেও। অবশ্যই এই কঠিন সময়কালে বিকল্প হয়ে উঠতে পেরেছে অন-লাইন পরিষেবা। তবুও বই-ব্যবসা কিন্তু মার খেয়েছে করোনা, লক-ডাউন এবং আমফানের ঝাপটায়।
বই, হাতে নিয়ে, নেড়ে-চেড়ে দেখেই যে পাঠক কিনতে পছন্দ করেন তা নিয়ে সন্দেহ নেই। ফলে সমস্ত বইপাড়া এবং আপামর বইপ্রেমীরা প্রবলভাবে আঁকড়ে ধরতে চাইছেন এমন কিছু, যার মাধ্যমে আবার বইবাজার ও পাঠকের চাহিদা—দুইই চাঙ্গা হবে। অন-লাইনের সময়চিত বিকল্পের সঙ্গে অফ-লাইনের অভিজ্ঞতাও আগের মতোই পাঠকের দরবারে বইপাড়ার এসেন্সকে আবার বাঁচিয়ে তুলবে। নিঃসন্দেহে এই বিপুল ক্ষতি ও চাহিদার পূরণ করতে পারে একমাত্র বইমেলাই। জেলার মেলাগুলির সাফল্য মাথায় রেখেও কিন্তু এ-কথা বলা যায়,বই বিক্রি সেখানে স্থানীয় পাঠকের বাইরে সাধারণত যেতে পারে না। ফলে বাজার সঙ্কুচিত হয়ে পড়ে। জেলার মেলায় বিক্রির পাশাপাশি কলকাতা বইমেলার বিক্রিও তাদের বইবাণিজ্যে অনেকখানি সুরাহা নিয়ে আসে।
বইমেলা নিয়ে দু-রকম মতই উঠে আসছে। একদল মনে করছেন সামাজিকও দূরত্ববিধি বিষয়টাই যেখানে প্রায় অসম্ভব হয়ে উঠছে, সেখানে যাবতীয় কোভিড-বিধি মেনে মেলা করা বেশ কঠিন। বিপক্ষে থাকা জনমত বলছে, সমস্তকিছুই তো হচ্ছে, এত বড় দুর্গাপুজো সামলে দিল বাঙালি। শীতকাল পড়তেই অন্যান্য মেলাও শুরু হয়েছে। শুধু বইমেলার ক্ষেত্রেই সমস্যা কেন? ভেবে দেখলে উভয়পক্ষের বক্তব্যেই কিছু সারবত্তা রয়েছে। বইমেলার মতো বিপুল গ্র্যাঞ্জার কলকাতার বুকে অন্য কোনও মেলায় থাকে না। সরকারকে এত যোগাযোগ ব্যবস্থার ফিরিস্তি সামলাতে হয় না অন্যান্য মেলার ক্ষেত্রেও। যদিও গঙ্গাসাগরের মেলার জন্যে ব্যবস্থাপনা করাও সরকারের কাছে চ্যালেঞ্জের বিষয়। সেই মেলাও হচ্ছে। তবে নিয়ন্ত্রিত। ই-স্নানের মতো কোনও উদ্ভাবনী চিন্তা যদি বইমেলার ক্ষেত্রে ওঠে, পাঠক মানবেন কি সে-কথা? বই স্পর্শ করবার, উল্টে-পাল্টে দেখবার যে শিহরণ-চাহিদা-প্রীতি আমাদের মধ্যে রয়েছে, অজস্র পি-ডি-এফের সমাহারও তার বিকল্প হয়ে উঠতে পারেনি। বই সম্পর্কে পাঠক এখনো তার চূড়ান্ত ধারণাটি আঁচিয়েই বিশ্বাস করতে চান।
বইমেলার চেয়ে চমকপ্রদ ও উপযোগী পরিসর আর কী হতে পারে, যেখানে পেঙ্গুইন, অক্সফোর্ড থেকে আনন্দ-দে’জ-মিত্র ঘোষ হয়ে আপনি লিটল ম্যাগাজিন প্যাভিলিয়নে পৌঁছে সংগ্রহ করতে পারেন দুস্প্রাপ্য অথচ চমত্কার কোনো লিটল ম্যাগাজিন। হতেও পারে লিটল ম্যাগাজিনের স্ব-উদ্যোগে প্রকাশিত একটি বই দেখে আপনি রীতিমতো বুঝতে পারলেন, প্রকাশন নৈপুণ্যে তারাও বই সম্পর্কে আপনার চিরায়ত মেকি ধারণার বুকে সজোরে ঘা মারতে পারেন। এই মুহূর্তে পুরুলিয়ায় বসে একটি ছেলে যে-কবিতা লিখছে, কিংবা বীরভুমের কোনো প্রত্যন্ত প্রান্তে একটি মেয়ে যে ছোটগল্পটি লিখছে, তাদেরও লেখার কাছে আপনাকে শ্রদ্ধায় নতজানু হতে হবে। এই অভূতপূর্বতাও ঘটিয়ে ফেলে একমাত্র বইমেলার প্রাঙ্গণ। এমন পাঠকও দুর্লভ নন, যারা কলেজ স্ট্রিটে নিয়মিত যোগাযোগ রাখতে পারেন। তারা বইমেলা এসে মূলত সন্ধান করেন সেইসব প্রকাশনীর, যাদের বই বইপাড়াতেও সুলভ নয়। কাজেই বইমেলা নিছকই আবেগমাত্র নয়। আবেগের দিকটা সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন করেও শুধুমাত্র বাণিজ্যিক স্বার্থেই বইমেলা হওয়াটা ভীষণ জরুরি।
তবে বইমেলা যে বিপুল সংখ্যার স্টল নিয়ে হয়ে থাকে, কোভিড-বিধি মেনে তাকে ঢেলে সাজানো যাবে কী না, তা নিয়ে বিস্তর সংশয় আছে। সেক্ষেত্রে স্টলের সংখ্যা কমাতে গেলেই স্বাভাবিকভাবেই উঠবে বিতর্ক—কারা থাকবে, কারা যাবে। লিটল ম্যাগাজিনের টেবিল যেভাবে পাশাপাশি রাখা হয়, এ-বছর সেই বিন্যাস রাখা ঠিক হবে কী না। বইমেলায় শুধু তো বইয়ের স্টল থাকে না, ছোট-বড় সংস্থার খাবারের দোকান এই সময় দুটো পয়সার মুখ দেখে। মেলায় স্টল নেওয়া কর্মী এবং মেলায় ঘুরতে আসা আমোদী, ক্ষুধার্ত ক্রেতা, উভয়েরই প্রয়োজন মেটায়। তাদের জন্যেই বা ঠিক কোন পরিকল্পনা নেওয়া হবে, ভাবার আছে সেটাও। লোকসংখ্যা যেখানে নিশ্চিতভাবে বিপুল, সেখানে স্যানিটাইজেশন ও সামাজিক দূরত্ব মানা প্রায় অসম্ভব।
অতঃকিম? তাহলে কী হবে এ-বছরের বইমেলার? ফেব্রুয়ারিতেই হয়ত বেরিয়ে যাবে নির্বাচনের বিজ্ঞপ্তি। তারপর মার্চ-এপ্রিল জুড়ে ভোট। তাহলে বইপার্বণ কি সম্পন্ন হবে তুমুল গ্রীষ্মে? নাকি আগুনের লেলিহান শিখা যা পারেনি, তাই করে দেখিয়ে দিল অণু-পরিমাণ একটি ভাইরাস? আপাতত কোনো উত্তর নেই। একটি না-পড়া বইয়ের পাতা উল্টে চলেছি আমরা সবাই। পরের পাতায় কোন নব্য-স্বাভাবিকতার ভাষ্য লেখা রয়েছে, সত্যিই, এখনো জানি না।
(লেখক পেশায় স্কুল শিক্ষক। কবি ও প্রাবন্ধিক হিসাবে সুপরিচিত সারস্বত সমাজে। যুক্ত আছেন ছোটো-বড় একাধিক লিটল ম্যাগাজিনের সঙ্গেও )