
উত্তম দত্ত
নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন যাঁকে বলেছিলেন ‘আধুনিক যুগের গার্গী’ সেই জ্ঞানতপস্বিনী অধ্যাপক সুকুমারী ভট্টাচার্যের কথা বলতে গিয়ে আমাদের মনে পড়ে ভয়ানক বর্ণবৈষম্যের শিকার মেদিনীপুরের বিদ্যাসাগর বিশ্ববিদ্যালয়ের লোধা সম্প্রদায়ের তরুণী ছাত্রী চুনি কোটালের কথা। একদা উপেক্ষায়, অপমানে আর বঞ্চনায় আত্মঘাতী হয়েছিল এই মেধাবী তরুণী। তার উচ্চশিক্ষার আকাঙ্ক্ষাকে ছোটো জাতের মানুষের স্পর্ধা বলে মনে করেছিল উচ্চবর্ণের কুলীন অধ্যাপকেরা। সমস্ত যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও সেদিন পরীক্ষায় প্রাপ্য নম্বর থেকে তাকে বঞ্চিত করা হয়েছিল। তিনি আর কেউ নন বিদগ্ধ অধ্যাপক-গবেষক সুকুমারী ভট্টাচার্য।
শুধু মেয়ে হয়ে জন্মানোর অপরাধে অত্যন্ত মেধাবী ছাত্রী সুকুমারী দত্তের (ভট্টাচার্য) পক্ষে একসময় প্রেসিডেন্সি কলেজের ছাত্রী হওয়া সম্ভব হয়নি। কারণ সেসময় মেয়েদের ওই কলেজে পড়ার অধিকার ছিল না। অগত্যা তিনি ভর্তি হন ভিক্টোরিয়া কলেজে। শুধু ধর্মে খ্রিস্টান হওয়ার অপরাধে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতক-স্তরের ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে সর্বোচ্চ নম্বর পাওয়া সত্ত্বেও তাঁকে বঞ্চিত করা হয়েছিল ‘ঈশান স্কলারশিপ’ থেকে। কারণ এ বিষয়ে ঈশানচন্দ্র ঘোষের লিখিত নির্দেশ ছিল, বর্ণ হিন্দু ছাড়া এই স্কলারশিপ যেন আর কাউকে না দেওয়া হয়। অবশ্য তার পরিবর্তে ‘জুবিলি পোস্ট গ্র্যাজুয়েট স্কলারশিপ ‘ পেয়েছিলেন সুকুমারী৷ অন্যদিকে একজন খ্রিস্টান হয়ে সংস্কৃত ভাষা ও সাহিত্যে এম এ পড়তে চেয়েছিলেন বলে খোদ কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়েই তাঁকে নানা বাধার সম্মুখীন হতে হয়েছিল। ফলত বাধ্য হয়ে সংস্কৃতের পরিবর্তে ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্যে সসম্মানে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন তিনি। পরে নিজের প্রিয় বিষয় সংস্কৃতে এম এ পাশ করেছিলেন প্রাইভেটে।
না, চুনি কোটালের মতো অপমানে আত্মহত্যার পথ বেছে নেননি তিনি। বরং উচ্চশিক্ষার পথে এবং কর্মক্ষেত্রে প্রতি পদক্ষেপে এইসব বাধা ও অসম্মানকে অতিক্রম করে একজন সুপ্রতিষ্ঠিত জ্ঞানতাপস লেখক ও স্বনামধন্য অধ্যাপক হয়ে উঠেছিলেন মাইকেল মধুসূদন দত্তের সুযোগ্য উত্তরসূরী সুকুমারী দত্ত। বাবা সরসী কুমার দত্ত, মা শান্তবালা দত্তের কন্যা প্রেসিডেন্সি কলেজের ইংরেজি সাহিত্যের অধ্যাপক অমল ভট্টাচার্যকে বিয়ে করে হয়েছিলেন সুকুমারী ভট্টাচার্য। দীর্ঘদিন তিনি অধ্যাপনা করেছেন লেডি ব্রেবোর্ন কলেজে। তারপর বুদ্ধদেব বসু এই জ্ঞান-তপস্বিনীকে ডেকে নিয়ে যান যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের তুলনামূলক সাহিত্য বিভাগে। সেখান থেকে অধ্যাপক সুশীলকুমার দের উদ্যোগে তিনি যোগ দেন ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃত বিভাগে। ধর্মে খ্রিস্টান হওয়ার অপরাধে সেখানেও তাঁকে সহকর্মীদের অসূয়ার শিকার হতে হয়েছিল। প্রাচীন ভারতীয় সাহিত্য সংস্কৃতির একনিষ্ঠ উপাসক এবং আমৃত্যু গবেষক সুকুমারী ভট্টাচার্য লিখেছেন ৩৫টির বেশি ইংরাজি ও বাংলা ভাষায় দ্যুতিময় গ্রন্থ। নৃসিংহপ্রসাদ ভাদুড়ী, নবনীতা দেবসেন এবং অভিজিৎ ঘোষের মতো প্রখ্যাত লেখক ও গবেষকেরা ছিলেন তাঁর নিজের হাতের তৈরি ছাত্র। কর্মসূত্রে তিনি নিবিড় সান্নিধ্য পেয়েছেন সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়, সুশীল কুমার দে, নীরদ চন্দ্র চৌধুরী, ভি ভি কোশাম্বী, আর এস শর্মা, হীরেন মুখোপাধ্যায়, চিন্মোহন সেহানবিশের মত বিদগ্ধ পণ্ডিত অধ্যাপকদের। মুক্ত মনের মানুষ সুকুমারী আমাদের বেদ, উপনিষদ ও মিথলজিকে নতুন করে ব্যাখ্যা করেছেন নিজস্ব মননের আলোকে। আমাদের পৌরাণিক চরিত্র ও আখ্যানগুলি যে নিছক নিশ্চল জড়বস্তু নয়, তারা যে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে জীবন্ত পদার্থের মতো বদলে যায়, তা তিনিই প্রথম আমাদের দেখালেন।
সুকুমারী ভট্টাচার্যের আদি নিবাস চিত্রা নদীর তীরে শিঙে-শোলপুর গ্রামে। ১৯২১ সালের ১২ জুলাই মেদিনীপুরে মামাবাড়িতে তাঁর জন্ম হয়। জুলিয়াস সিজারেরও জন্ম হয়েছিল ১২ জুলাই। তাই সুকুমারী ভট্টাচার্য মজা করে বলতেন: আমি জুলিয়াস সিজারের সঙ্গে আমার জন্মদিন ভাগ করে নিয়েছি। জনশ্রুতি আছে, তাঁর পিতামহ বিপিনবিহারী দত্ত হিন্দু ধর্মের আচার বিচারের অত্যাচারে ছোটোবেলার এক খেলার সাথী-র মৃত্যু প্রত্যক্ষ করেন। একাদশীতে হিন্দু বিধবাদের জলস্পর্শ নিষিদ্ধ ছিল বলে জ্বরাক্রান্ত সেই বাল্যবিধবাকে এক ফোঁটা জল পর্যন্ত দেওয়া হয়নি। হিন্দু সমাজের এই অযৌক্তিক তমসাচ্ছন্ন আচার ব্যবহারে বীতশ্রদ্ধ হয়ে কলকাতায় এসে রাতারাতি খ্রিস্টান ধর্মে দীক্ষিত হন তিনি। সেই বংশের মেয়ে সুকুমারীও আজীবন কুসংস্কারাচ্ছন্ন হিন্দু মৌলবাদের বিরুদ্ধে লড়াই করে গেছেন।
এই উপমহাদেশে নারীর অধিকার, সাম্য ও স্বাধীনতা নিয়ে বাংলা ভাষায় লিখে যে চারজন বিখ্যাত লেখক সমাজে আলোড়ন সৃষ্টি করেছিলেন তাঁরা হলেন বেগম রোকেয়া, সুকুমারী ভট্টাচার্য, আকিমুন রহমান ও তসলিমা নাসরিন। তসলিমার লেখায় আজও বারংবার উঠে আসে সুকুমারী ভট্টাচার্যের কথা।
শিক্ষক হিসেবে তিনি কেমন ছিলেন? সেকথা জানাতে গিয়ে প্রাচীন মহাকাব্য গবেষক নৃসিংহপ্রসাদ ভাদুড়ী লিখেছেন:
“ছাত্রছাত্রীরা ওঁর সঙ্গে তর্ক করলে খুশি হতেন। আর সুকুমারীদি যে যুগের থেকে এগিয়ে ভাবতেন, তাঁর ‘ইন্ডিয়ান থিওগনি’ বইটিই তার প্রমাণ।”
বেদে সংশয় ও নাস্তিক্য, নিয়তিবাদের উদ্ভব ও বিকাশ, বেদের যুগে ক্ষুধা ও খাদ্য, হিন্দু সাম্প্রদায়িকতা এবং বিবাহপ্রসঙ্গে লেখা বিভিন্ন বই সুকুমারী ভট্টাচার্যের মৌলিক বিশ্লেষণী চিন্তার স্বাক্ষর বহন করছে। তাঁর একদা ছাত্রী, প্রখ্যাত কবি ও লেখক নবনীতা দেবসেন অসুস্থ সুকুমারীকে দেখে এসে লিখেছিলেন: “ওঁর শরীর ভাঙলেও মন তাজা ছিল। বয়সকালে অনেকেই আত্মকরুণায় পীড়িত হন, নিজের কষ্টে ভারাক্রান্ত হয়ে থাকেন। সুকুমারীদি সে-সবের শতহস্ত দূরে।”
চেতনায় বামপন্থী সুকুমারী তাঁর নিরলস ভারতচর্চা ও আজীবন গবেষণার স্বীকৃতি হিসেবে পেয়েছেন নানা পুরস্কার : ১৯৮৮ সালে আনন্দ পুরস্কার, ১৯৯৪ সালে বিদ্যাসাগর স্মৃতি ও রাহুল সাংকৃত্যায়ন পুরস্কার, ১৯৯৯ সালে মুজফ্ফর আহ্মদ পুরস্কারে ভূষিত হন তিনি। বাংলা আকাদেমির সদস্য, এশিয়াটিক সোসাইটির ফেলো হিসেবেও দীর্ঘদিন কাজ করেছেন তিনি।
যেসব গ্রন্থে তাঁর উজ্জ্বল মনীষার স্বাক্ষর রয়েছে সেগুলির মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য হল :
The Indian Theogony
Literature in the Vedic Age
History of Classical Sanskrit Literature
Buddhist Hybrid Sanskrit Literature
Women and Society in Ancient India
Goddesses of India
Legends of Devi
Some Thoughts on Tagore Draupadi
In Those Days
The Gita – Its Why and How
Fate and Fortune in the Indian Scriptures
মৃচ্ছকটিক (ভূমিকা ও বাংলায় অনুবাদ)
প্রাচীন ভারত – সমাজ ও সাহিত্য
সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়
ইতিহাসের আলোকে বৈদিক সাহিত্য (বাংলা অনুবাদ – নীলাঞ্জনা সিকদার-দত্ত)
ধ্রুপদী সংস্কৃত সাহিত্য (বাংলা অনুবাদ – নীলাঞ্জনা সিকদার-দত্ত)
হিন্দু সাম্প্রদায়িকতা
বিবাহ প্রসঙ্গ
রামায়ণ ও মহাভারত – আনুপাতিক জনপ্রিয়তা
বেদের যুগে ক্ষুধা ও খাদ্য
বেদে সংশয় ও নাস্তিক্য
বাল্মীকির রাম – ফিরে দেখা
অপসংস্কৃতি
গৌতম বুদ্ধ
প্রাচীন ভারতে নারী ও সমাজ (বাংলা অনুবাদ বিজয়া গোস্বামী, নীলাঞ্জনা সিকদার-দত্ত, করুণাসিন্ধু দাস)
গীতা কেন?
প্রবন্ধ সমগ্র (৪ খন্ড)
রবীন্দ্রকবিতায় মৃত্যু
নিয়তিবাদ – উদ্ভব ও বিকাশ
এয়োতি এবং।
সুকুমারী ভট্টাচার্যকে নিয়ে কথাপ্রসঙ্গে প্রখ্যাত ইতিহাসবিদ রোমিলা থাপারের লিখেছেন , “ওঁর কাজ প্রাচীন ভারতীয় ইতিহাসচর্চার ক্ষেত্রে মাইলফলক হয়ে আছে।”
সুকুমারীর অত্যন্ত প্রিয় ছাত্রদের একজন পুরাণবিশারদ নৃসিংহপ্রসাদ ভাদুড়ী। তাঁর কাছে গবেষণা করতে গিয়ে যে বিস্ময়কর ও মনোরম অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হয়েছিলেন সেকথা জানাতে গিয়ে তিনি লিখেছেন :
“১৯৮৫ সালে আমি যখন ওঁর কাছে গবেষণা করছি , তখন উনি ফ্রান্সের পণ্ডিতানী মাদাম বিয়ার্দোর কাছ থেকে আমার ‘রিসার্চ মেটেরিয়াল’ বয়ে নিয়ে আসছেন এবং উপহার হিসেবে ছাত্রের জন্য দু’প্যাকেট বেনসন অ্যান্ড হেজেসও — এটা কী পঁচাশি সালে কেউ কল্পনা করতে পারতেন? গবেষণার কালে অনেক বিষয়েই তাঁর সঙ্গে আমার মত মেলেনি, তর্কাতর্কিও হয়েছে প্রচুর৷ কিন্তু সুকুমারী এমনই একজন অধ্যাপিকা, যিনি কখনও নূপুরের মতো চরণে চরণে বাজতে শেখাননি৷ আমি এতটাই স্বাধীনভাবে তাঁর কাছে কাজ করতে পেরেছি , আমার পড়াশুনোর ক্ষেত্রে এতটাই তিনি দ্বারমুক্তি ঘটিয়েছিলেন, যাতে সংস্কৃতের তথাকথিত এক বাহ্যাবরণ ভেদ করে আমি অন্তত এক বিরাট মুক্ত জগতে বিচরণ করতে শিখেছিলাম৷”
আবহমানকালের নিয়তিবাদের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে এই ইন্ডোলজিস্ট এবং নারীমুক্তি চেতনার পথিকৃৎ আজীবন ভেবেছিলেন। ভারতবর্ষের অন্তত একটা মানুষও যদি একবার নিয়তি ছেড়ে নিজের কর্মোদ্যমের ওপর নির্ভর করে, মেয়েরা যদি একবার তাদের জড়তা ছেড়ে কোনও এক স্পষ্ট জগতের দাবিদার হয় , তবেই সার্থক হবে তাঁর জীবনব্যাপী গবেষণা ও পঠনপাঠন।