পরচর্চার সাইড এফেক্ট
বাইরে ‘সুখ’। বাইরেই অসুখ। করোনা এফেক্ট। বাধ্যতামূলক ঘরে অন্তরিন। অমান্য মানে বিপদকে নেমন্তন্ন করে আনা। তাই সুখের চেয়ে স্বস্তি ভাল। ঘরে সেই স্বস্তি। ঘরেই অস্বস্তি। তবে উপায়? চিন্তাকে চিন্তামণির ওপর ছেড়ে মন হালকা রাখাই সবচেয়ে ভাল উপায়। এই ‘জরুরি অবস্থা’র দিনে আপনাদের জন্যেই ‘দ্য ওয়াল’ এনেছে হাসির লেখা ‘বারোয়ারি নকশা’। পড়ুন, মন ভাল রাখুন।
তন্ময় চট্টোপাধ্যায়
কথা হচ্ছিল সুজনদার সঙ্গে। বলছিলাম, “ধরুন চকচকে এক ছুটির সকাল। আপনি চায়ে প্রথম চুমুকটা দিয়ে সবে হয়তো থমকেছেন কাগজের প্রথম পাতায়। চেয়ে চেয়ে দেখছেন কাগজের পাতা জুড়ে থাকা শপিং মলের সস্তা অফারের বিজ্ঞাপন আর অফারের ঝুলি হাতে দাঁড়িয়ে থাকা খোলামেলা পোশাকের মডেল কন্যাটিকে। সস্তা অফার না
মডেল? কোনটা বেশি চোখ টানছে— এ নিয়ে আপনি হয়তো একটু কনফিউজড। আর ধরুন ঠিক
সেই সময়েই আপনার কানে এল কয়েকটা মোক্ষম সমালোচনার শব্দ।”
সুজনদা বললেন, “আর বলতে হবে না ভাই। সকাল সকাল রোজই এই সময়টায় কিছু না কিছু আমার কানে আসে। আর তাতে আমার কাগজ পড়া লাটে ওঠে। আসলে আমাদের কাজের দিদিটি হল এক রয়টার। তার ইন্টারনেটে সারা মহল্লার খবর। আর মাঝে মাঝেই পড়ে তার অ্যাটম বোম। সেদিন কী শুনলাম জানিস? শুনতে পেলাম, সে আমার গিন্নিকে
বলছে, ও বউদি, জানো, সাত নম্বরের সেনবাবুর বউ কাল রাতে সেনবাবুকে কান ধরে ওঠবোস করিয়েছে।”
“তারপর?”
“তারপর আর কী ? আমার তো হয়ে গেল। প্রতিবেশী সেনবাবুর খবর জানব বলে কাগজকে মাথায় রেখে কুকুরের মতো নিজের কানদুটোকে সজাগ করে তুললাম। আমার গিন্নি তো মোটে তিনটে শব্দের একটা জ্বালানি যোগাল— ওমা, তাই না কি? আর
তাতেই দেখলাম কাজ হল। সেই মহিলা শুরু করলেন সেনবাবুর দুরবস্থার গল্প। সে এক অভিজ্ঞতা ভাই। মাঝে মাঝে গিন্নি মেশাচ্ছে পাঁচফোড়ন আর আমি কান পেতে থাকা একনিষ্ঠ শ্রোতা।”
“একটা মানুষ কান ধরে ওঠবোস করছে আর আপনি মজা নিচ্ছেন। কী ভয়ানক অ্যাঁ?”
“ব্যাপারটা ওভাবে নিলে হবে না ভাই । এটা তো মোটে একটা রিপোর্টিং। আমি তো আর ওঠবোস করাচ্ছি না। শুনছি মোটে। কিন্তু শুনে কী ফল হল সেটাই ভাবার বিষয়।”
“তা কী হল?”
“তিনজনের মনে তিন রকমের ব্যাপার ঘটল। কাজের মাসির বুকের ভার যে একটু হালকা হল তা নিয়ে সন্দেহ নেই। একজন ওপরতলার মানুষ তার গিন্নির হাতে হেনস্থা হচ্ছেন— এ খবর শোনার পর থেকেই তার প্রাণের হাঁকুপাঁকু দশা। রসিক শ্রোতার কানে সে কথা তুলতে পেরে তার মনে তো একরকম মোক্ষলাভের তৃপ্তি।
সেটা বুঝলাম তার বত্রিশ পাটির বাহার দেখে। আমার গিন্নির ভোট যে সেনবাবুর গিন্নির পক্ষে গেল তাও পরিষ্কার হয়ে গেল আমার কাছে। সে বুঝল, নিশ্চয়ই
চরিত্রগত কোনও গোলমাল, নয়তো এমন ঘটনা কী করেই বা ঘটে! পুরুষ চরিত্রের ওপর তার বিশ্বাসটা আরও একটু ফিকে হল। আর আমি মনে মনে ভাবতে লাগলুম, ওঃ, কী মিলিটারি গিন্নি রে বাবা। এই জন্যই বোধহয় স্বামীরা আসামি হয়।”
“তাহলে সাইড এফেক্ট আছে, কী বলেন?”
“নেই আবার! ভাল পরচর্চা তো শরীরচর্চার মতোই— বেশ উপকারী জিনিস।”
আবার প্রমাণ পেলাম কিছুদিন পরে। গিয়েছিলাম এক আত্মীয়ের বাড়ি। অসুস্থতার
পরে ভদ্রলোক তখন ক’দিনের বেড রেস্টে আছেন। আত্মীয়, বন্ধুরা ঘরে আসছে।
হরেক রকমের গল্প। তিনি নেহাত শ্রোতা। যেদিন আমি গিয়ে পড়লাম সেদিন আলোচনা
শুরু হয়েছে কোনও এক দুর্ভাগা বলাইকে নিয়ে।
কেউ একজন শুরু করলেন, “বলাইয়ের কথা আর বোলো না ভাই, ও আর মানুষ হল না।
পড়াশোনাতেই যা ভাল কিন্তু আর কী গুণ আছে বলো! বোবার মতো জীবন। কারও সাতে
নেই, পাঁচে নেই। যেন একটা আনসোশ্যাল!”
পাশ থেকে আওয়াজ এল, “আনসোশ্যাল তো আর সাধে না, গিন্নির ভয়ে। তার তো শুনি
বেজায় বদমেজাজ।”
“বদমেজাজ তো হবেই ভাই, চাকরি করে যে, চাকরি করা মেয়ে বিয়ে করলে এই এক
জ্বালা। নজরবন্দি করে দেবে।”
বিরোধিতা এল অসুস্থ মানুষটির স্ত্রীর পক্ষ থেকে। তিনি বললেন, “কই, আমাদের
মানুও তো চাকরি করে, মানু তো অমন নয়। স্বামীকে ভয় দেখাবে, নজরবন্দি করবে
এ আবার কী, ছিঃ ছিঃ। আমাদের জামাই তো দিনরাত সোশ্যাল ওয়ার্ক করে। এনজিও
চালায়।”
পাশ থেকে সমর্থন এল, “আসলে চাকরিবাকরি কোনও ফ্যাক্টর না, বংশটাই হল বড়
কথা, বুঝলে, কোন গাছের ফল সেটা আগে জানতে হবে।”
দাঁত বের করে আর একজন বললেন, “এই হল লাখ কথার এক কথা। ভাল থান হলে তবেই
তো ভাল কাটপিস।”
দেখলাম শয্যাশায়ী মানুষটির মুখ এক স্বর্গীয় হাসিতে ভরে গেছে। হাসছেন কেন?
বুঝলাম এও এক সাইড এফেক্ট। তিনি বুঝেছেন, তিনি হলেন সেই বিশেষ থান যার
থেকে মানুর মতো অসাধারণ কাটপিস বেরিয়েছে। নিজের আর নিজের বংশের এই উচ্চ
অবস্থানটির জন্যই স্বর্গীয় হাসি। মানুর মায়ের মুখেও সেই খুশির রেশ।
“রিলিফ দেয় বইকি ভাই! ভাল রিলিফ দেয়।” মন্তব্য করল এক ডাক্তার বন্ধু।
“কেউ করে মজা পায়, কেউ শুনে। ডাক্তারি শাস্ত্রে এর নাম হল পারগেশান অব
ইমোশনস।”
“একটু বুঝিয়েই বলো না।”
“বলব ভাই, একদিন সময় নিয়ে বলব এখন।”
সময় মিলল ক’দিন বাদেই এক বউভাতের আসরে। আমরা দু’জনেই নিমন্ত্রিত। উপহার
পর্বে দেখা হল বর-কনের সঙ্গে। খুব সাদামাটা নিরীহ আটপৌরে চেহারার বর,
পাশে তার সুন্দরী বউ।
খাওয়াদাওয়া শুরু হতে তখনও কিছুটা দেরি। ছাদের ওপর দাঁড়িয়ে দেখলাম ডাক্তার
বন্ধুটি ইশারায় ডাকছে আমাকে। কাছে যেতেই নিচু গলায় বলল, “চুপ করে শুধু
শুনে যা।”
দেখলাম ছাদের এক কোণে চলছে এক আলোচনা পর্ব।
এক বিচক্ষণ বলছেন, “খগেনের তো এই অবস্থা— না রূপ না রোজগার! তারপর ওই
আগুনে বউ নিয়ে এল সংসারে! কোনও মানে হয়!”
কে একজন সুরে সুর মেলালেন। “উচিত তো ছিল কোনও সাদামাটা মেয়ে বিয়ে করা,
খুঁজলে কি তেমন মেয়ে পাওয়া যেত না?”
“খুব যেত, তা না করে এ তো সেই খাল কেটে কুমির আনা! বুঝবে, নিজেই বুঝবে!”
বিশেষজ্ঞের মত এল অবশেষে, “ওই যে বলে না বিনাশকালে বিপরীত বুদ্ধি!
সম্পর্ক ক’দিন টেকে দ্যাখো না।”
বন্ধুকে নিচু গলায় বললাম, “এ কী জিনিস ভাই। আজই তো ডিভোর্সের কাঁচি
চালাবে মনে হচ্ছে।”
বন্ধু বলল, “নেবারস ওয়াইফ তো সমালোচনায় আসতেই পারে, যিশু তো ‘লাভ দাই
নেবার’ বলেছেন।”
বললুম, “কিন্তু লাভটা কী?”
বন্ধু বলল, “আছে বইকি, এ তো লোকাল অ্যানাস্থেসিয়া চলছে। এ দিচ্ছে ওকে, ও
দিচ্ছে তাকে। চলছে ক্লোরোফর্মের ডোজ। আর সাইড এফেক্টে গায়েব হয়ে যাচ্ছে
নিজের যন্ত্রণা। গোটা দেশ জুড়ে চলছে এই স্বস্তিদান পর্ব। আমি তো নাম
দিয়েছি হিলিং টাচ এপিসোড। ওষুধের চেয়েও এ জিনিস ঢের বেশি শক্তিশালী
ব্রাদার।”
চিত্রকর: রাজ রায়