Latest News

অফারপ্রেমী

বাইরে ‘সুখ’। বাইরেই অসুখ। করোনা এফেক্ট। বাধ্যতামূলক ঘরে অন্তরিন। অমান্য মানে বিপদকে নেমন্তন্ন করে আনা। তাই সুখের চেয়ে স্বস্তি ভাল। ঘরে সেই স্বস্তি। ঘরেই অস্বস্তি। তবে উপায়? চিন্তাকে চিন্তামণির ওপর ছেড়ে মন হালকা রাখাই সবচেয়ে ভাল উপায়। এই ‘জরুরি অবস্থা’র দিনে আপনাদের জন্যেই ‘দ্য ওয়াল’ এনেছে হাসির লেখা ‘বারোয়ারি নকশা’। পড়ুন, মন ভাল রাখুন।

তন্ময় চট্টোপাধ্যায়

ডিপার্টমেন্টাল স্টোরে কত কিসিমের মানুষ। একদল তো ঠান্ডা ঘরে পা দিয়েই খুশি। চোখ বুজে “আহ আহ” বলে হাঁফ ছাড়েন। ভাবটা এই, আহা! এমন একটা আস্তানা চিরদিনর জন্য কেন হয় না! উইন্ডো শপিংয়ে খুশি আর এক দল। ট্রায়াল রুমে হানা দিয়ে হাসিহাসি মুখের
অসংখ্য সেলফি নিয়ে বাড়ি ফিরে যান তারা। আর এক দল থাকেন কান খাড়া করে— সাধের অফার যেন মিস না হয়।
এই কান খাড়া করা দলের মানুষ হলেন আমাদের পাড়ার সত্যদা। সেদিন দেখলাম হাতিবাগানের এক ডিপার্টমেন্টাল স্টোরের সামনে মুখ লটকে বসে আছেন এই অফারপ্রেমী মানুষটি।

এগিয়ে গিয়ে বললাম, “কী ব্যাপার সত্যদা, এখানে বসে?”

আর বলিস না ভাই, মাত্র হাফ মিনিট লেট করার জন্য কী আক্কেল সেলামিই না দিচ্ছি। স্টোরের দরজা খুলে ঢোকামাত্রই আগের সেলটা শেষ হয়ে গেল।” 

“কীসের সেল মিস করলেন দাদা?”
“মগের সেল রে ভাই। দুটোয় দুটো ফ্রি ছিল। এখন চলছে পাপোষের সেল। কখন আবার মগ আসে, সেই অপেক্ষায় বসে আছি।”
মলে ‘মগের মুলুক’ না এলে শেষমেশ পাপোষের সঙ্গেই হয়তো আপস করে বাড়ি ফিরবেন সত্যদা। তবে অফার না হাতিয়ে হাঁটবেন না তিনি।
পাড়ায় প্রবাদ— অফারের জন্য ‘ফার অ্যাওয়ে’ ভ্রমণ করতে পারেন এই মানুষটি। হনিমুনে গিয়ে ‘ড্যাম চিপ’ পেয়ে বেবিস্যুট কিনে এনেছিলেন এক ডজন। নিজের মুখে সে গল্প ফাঁস করার পরে পাড়ায় সে কী হাসাহাসি! সত্য-গিন্নি তো লজ্জায় রাঙা। সত্যদা হো হো করে হেসে বললেন, “স্পষ্ট কথায় কষ্ট কী ভাই। কবি তো বলেইছেন, ইন ড্রিমস বিগন আওয়ার রেসপন্সিবিলিটজ।”
সেই সত্যদা সারাবছরের জামাকাপড়ের বাজার সেরে ফেলতেন চৈত্র সেলের সময়। চারপাশে কানাঘুেষা। কেউ বলত, “ওঃ, সাত কিপটের এক কিপটে।” সত্যদা বলতেন, “শোন ভাই, কিপটে নয় রে, সত্য হল তারও ওপরে। সাত কিপটে মরে এক চামার, আর সাত চামার মরে এক
সত্য। তবে আমার পুরোটাই সত্য, আমার মধ্যে ভেজাল পাবি না।”
ক্লাবের বিভিন্ন পুজোয় বাজার-টিমের লিডার তিনি। বাজারের আগে চলত বাজারুদের খ্যাঁটনপর্ব। শ্রীগুরুর বিখ্যাত কচুরি-আলুরদম এপিসােডে তার উপদেশ শোনা যেত, “শোন ভাই, মন দে ওই আলুরদমে। কচুরি তো বিবাহিত স্ত্রী, আলুরদম হল শ্যালিকার মতো।”
বাজারের সময় নিয়ে কক্ষনও বনিবনা হয়নি। তার সাধের সময় ছিল বারবেলা। বারবেলায় ‘যাত্রা নাস্তি’-র কথা মনে করালে বলতেন, “ওরে ব্যতিক্রমটা জানতে হয়। এক্সেসপশন প্রুভস দি ল। খনা-বরাহ কী বলে জানিস? বলে, বারবেলার বাজারে নেইকো নাস্তি, গেলে হয় না কোনও শাস্তি। যা মেলে তার সবটাই আশীর্বাদ।”
“আশীর্বাদটা কী শুনি?” প্রশ্ন রাখতাম আমরা।
উত্তরে বলতেন, “বারবেলার বাজার হল কাস্টমার’স প্যারাডাইস। অনেকটা ঘোলা জলের মতো। আর সেই ঘোলা জলে পটাপট চ্যাং, ল্যাঠা, কই ধরতে হয়। ড্যাম চিপ। তবে হ্যাঁ, চোখ-কান খোলা রাখতে হয় বইকি।” বলেই ছড়া কাটতেন, “না বুঝে না জেনে, ঘরে আনলে সস্তা/ চোখ বুজে বলা যায় হবে দুরবস্থা।”
বাজারপর্বে তার লড়াই ছিল চোখে পড়ার মতো। ব্যারিটােনে হাঁক পাড়তেন, “বলিস কী রে? এই গনগনে দাম গরমকালে? শীতে নিতিস, কিচ্ছুটি বলতাম না। দু’টাকা বেশি দিতাম, সঙ্গে নিজেকে সেঁকেও নিতাম। কিন্তু গরমে তো এ গল্প চলবে না ভাই। সূর্য সেঁকবে তুইও সেঁকবি? ওসব শুণ্ডি রাজ্যে কর গিয়ে এ রাজ্যে এসব চলবে না। ঠান্ডা কর, দাম ঠান্ডা কর বলছি।”
পটল বিক্রেতা মদনের দাম বরাবর একটু বেশি। তাকে বলতেন, “তোর পটলের দাম শুনে আমি যদি পটল তুলি তাহলে তুই তো কেস খাবি রে হতভাগা, তার চেয়ে যা বলি শোন মন দিয়ে…।”
বলে নিজের অফার দিতেন পটল বিক্রেতাকে।
সবজির ইতিহাস-ভূগোল সব জানতেন সত্যদা। বলে উঠতেন, “এই ঢ্যাঁড়শ পঞ্চাশ? তাও দিশে হত বুঝতাম, বেচছিস তো হাইব্রিড মাল। নালিকুলের রেট কত জানিস? দশ করে কিলো। ভাঙড়ে তো আরও কম। আর তুই হাঁকছিস পঞ্চাশ? দিনেদুপুরে গলা কাটবি নাকি ভাই?” লম্বা বাজার শেষে সিগারেটে টান মেরে বলতেন, “আজ শ’দেড়েক মতো বাঁচিয়েছি। তবে আরও সাত টাকা হতে পারত বুঝলি। শেষে এই ঢ্যাঁড়শে এসে লসটা খেলাম।”
সত্যদার চেলাগিরি করে ক্লাবের অনেকেই বাজার ধরতে শিখেছে। তাদের থেকে গুরুপ্রণামী বাবদ একটা করে সিগারেট নেন সত্যদা। আর সিগারেটে টান মারলেই তার মনে পড়ে অফারের নামী-দামি সব গপ্পো। বেশ ক’বছরে সেসব গপ্পো আমাদের মোটামুটি জানা হয়ে গেল। এবার বিজয়া সম্মিলনীতে তাই অন্য এক আবদার রাখা হল তার কাছে।
সবাই বলল, “দাদা, তোমার অফার ধরার সব গল্প তো জানা। এবার অফারে লস খাওয়ার গল্প কিছু বলো।”
সত্যদা বলল, “ইস, গোপন কথা জেনে নিবি? তবে শোন দু-দু’বার মুরগি হয়েছি জীবনে।
একবার সমস্তিপুর অফারে কিনেছিলাম এক কুকুরের বাচ্চা। নাম বলল পমেরেরিয়ান। কুুকুরের সঙ্গে কুকুরের তিন মাসের খাবার ফ্রি মিলল। আমি তো খুব খুশি। তার পর মাস দুই
কাটল কিন্তু সে কুকুরের মুখে কোনও রা-বাক্যি নেই। আমি ভাবলুম দামি কুকুর, ধীরেসুস্থে ডাকবে এখন। আরও মাস দুই খুব তোয়াজ করলুম তাকে। তারপর এক কাকভােরে সেই কুকুর ডাক শুরু করল হুক্কা হুয়া দিয়ে।”
“তার মানে শেয়াল?” হাসতে হাসতে আমাদের প্রশ্ন।
“তা হলে আর বলছি কী? এ গল্প কাউকে করিনি এতদিন। আর একবার পড়েছিলাম এক বিজ্ঞাপনের পাল্লায়। নামকরা এক খবরের কাগজে মাঝেমাঝেই বের হচ্ছিল বিজ্ঞাপনটা— ‘নামমাত্র টাকায় অদৃশ্য হন, মনের সাধ মেটান। বাই ওয়ান, গেট ওয়ান ফ্রি’। মোটে চার হাজারে দু-দুটো জিনিস। ড্রাফট করে টাকা গোরক্ষপুের পাঠালেই পোস্টে আসবে সেই অদৃশ্য হওয়ার যন্ত্র। তখন বয়েস কম। সায়েন্স ফিকশন পড়ে মাথাটাও বিগড়ে ছিল বেশ। তাই কী করি, কী করি করে টাকাটা শেষমেশ পাঠিয়েই দিলাম ওদের ঠিকানায়।”
“তারপর?”
“তারপর তো অস্থির অপেক্ষা— কখন আসে সেই জিনিস? অবশেষে মাস দেড়েক বাদে বাক্সবন্দি হয়ে এল সেই যন্ত্র। বেডরুমে ছিটকিনি তুলে ঝটপট কের সেই মোড়ক তো খুলে ফেললাম। কিন্তু প্যাকেট খুলে যা মিলল ভাই, তাতে স্থির হয়ে আরও আধ ঘণ্টা বসে রইলাম বিছানায়। প্যাকেটবন্দি হয়ে এসেছিল নিকষ কালো একটা কাপড়। তাই তো বলি—
অফারের মাল দারুণ সস্তা/ না বুঝে কিনলে দুরবস্থা।”

চিত্রকর: রাজ রায়

পড়ুন আগের পর্বগুলি…

দূরবীনে চোখ

আঁতেলনামা

লকডাউনে কল্লোলিনী

কান্না-হাসির কথা

লকডাউনে প্রশিক্ষণ

অথ চ্যাংড়া গদ্য কথা

পত্রঘাতক

‘বারোয়ারি নকশা’য় সুন্দর মুখোপাধ্যায়ের ১২টি পর্ব পাবেন নীচের লিঙ্কে।

নিখিল ভারত… সমিতি

‘বারোয়ারি নকশা’য় জয়দীপ চক্রবর্তীর ১২টি পর্ব পাবেন নীচের লিঙ্কে।

গৃহবন্দির জবানবন্দি ১২

You might also like