Latest News

অথ চ্যাংড়া গদ্য কথা

বাইরে ‘সুখ’। বাইরেই অসুখ। করোনা এফেক্ট। বাধ্যতামূলক ঘরে অন্তরিন। অমান্য মানে বিপদকে নেমন্তন্ন করে আনা। তাই সুখের চেয়ে স্বস্তি ভাল। ঘরে সেই স্বস্তি। ঘরেই অস্বস্তি। তবে উপায়? চিন্তাকে চিন্তামণির ওপর ছেড়ে মন হালকা রাখাই সবচেয়ে ভাল উপায়। এই ‘জরুরি অবস্থা’র দিনে আপনাদের জন্যেই ‘দ্য ওয়াল’ এনেছে হাসির লেখা ‘বারোয়ারি নকশা’। পড়ুন, মন ভাল রাখুন।

তন্ময় চট্টোপাধ্যায়

‘শখের পাখি’ পড়তে পড়তে মানিকবাবু বলে উঠলেন, “সুগার কোলেস্টেরল দুই-ই ধরেছে।”
বলাই বলল, “কার স্যার?”
মানিকবাবু বললেন, “কার আবার, আপনার লেখা গল্পের।”
বিশ্বকর্মা মেরামতি হাউসের কর্ণধার মানিক মিত্র মহাশয়ের সামনে তখন আমরা দু’জন। আমি আর বলাই পাল। বলাই লেখক। আমি তার সঙ্গী। বলাইয়ের লেখা গল্পের মেরামতি করতেই এখানে আসা।
বলাই সাধাসিধে মানুষ। গদ্য সাধনায় পাঁচ বছর গত হয়েছে বলাইয়ের। অথচ নামডাক সেভাবে হয়নি।
“গুরুর হাত না ধরলে আর বোধহয় উপায় নেই দাদা।” কিছুদিন ধরে এই ছিল বলাইয়ের একমাত্র আক্ষেপের ভাষা।
তার সাধের প্রেমের গল্প ‘শখের পাখি’ ‘উনুন’ থেকে ব্যর্থ হয়ে ফিরে আসার পর থেকে বলাই আরও মনমরা। নামি, বেনামি কোনও পত্রিকাই ছাপেনি গল্পটাকে। শেষ ভরসা ছিল রান্নাবান্নার পত্রিকা ‘উনুন’। তা সেখান থেকেও ফিরে এল সে গল্প।
বলাইয়ের সেই মনমরা অবস্থায় হঠাৎ পাওয়া গেল এক আশার আলো। খবরের কাগজে চোখে পড়ল ছোট্ট এক বিজ্ঞাপন:
ভেতরের কাঁচা লেখককে পাকা করুন।
বিশ্বকর্মা মেরামতি হাউস
ছোট-বড় গল্প মেরামতির বিশ্বস্ত প্রতিষ্ঠান।

আর তাই সেই মেরামতির ইচ্ছে নিয়ে আমি আর বলাই মানিকবাবুর কাছে। পড়া থামিয়ে মানিকবাবু তাকালেন বলাইয়ের দিকে।
“আমার লেখায় সুগার-কোলেস্টেরল? কী বলছেন স্যার!” বলাইয়ের চোখ কপালে তোলা প্রশ্ন।
“অকাতরে চিনি আর স্নেহ ঢাললে তো হবেই ভাই। দেখলুম আপনার গল্পের নাদুসনুদুস নায়ক জামবাটিতে মিষ্টি দই আর চিনি সহযোগে ফলার সারছেন। তাকেও যে ধরবে সে তো পরের কথা। কিন্তু আপনার লেখায় এখনই ধরেছে।”
“রোগ সারাতে কী উপায় হবে স্যার?”
“ভয় পাবেন না। লেখার তো ক্যান্সারও হয়। আর সেসবের আন্সার আছে আমার কাছে। আসলে লিখতে গিয়ে যারা থেবড়ে বসে পড়েন তাদের জন্যই তো আমার এই প্রতিষ্ঠান। সুগার-কোলেস্টেরলের রোগীর যা বিধান, আপনার লেখার জন্যও তাই। লেখাকে ট্রেডমিলে তুলুন, সঙ্গে আরও ডায়েটিং।”
“ঠিক বুঝলাম না স্যার, একটু ব্যাখ্যা করে যদি বলেন।”
“আপনার লেখা থেকেই বরং উদাহরণ দিই। আপনি লিখেছেন— ‘ঘাম ঝরানো পরিশ্রমী বিশু, রাতজাগা নিশাচর বিশু, হকার বিশুর জীবনে…’ একমনে লিখে গেছেন। বিশুর কথা একবারও কি ভেবেছেন? বিশেষণের মধুতে সে তো প্রায় যায় যায়! শুধু ‘বিশু’ লিখুন, নয়তো বিশুকে এবার ইনসুলিন দিতে হবে।”
বলাইকে আশ্বস্ত দেখাল। তার মুখে হাসি দেখে মানিকবাবু বলে চললেন, “তারপর আসি ‘কমা’-র কথায়। লেখায় এত কমা মেরেছেন যে গদ্য বেচারি খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটছে। লিখেছেন— ‘ভালবাসা তাহার নিশ্বাস, ভালবাসা তাহার প্রশ্বাস, ভালবাসা তাহার বিপাক-পরিপাক সব কিছুকে গ্রাস করল’। এই সর্বগ্রাসী ভালবাসা এমন ইনস্টলমেন্টে এগোলে তো চলবে না ভাই। লেখা তো ল্যাংড়াচ্ছে। তার সঙ্গে আবার কান্নাকাটি জুড়ে দিয়ে পরিবেশ একেবারে মেঘাচ্ছন্ন। এইসব মিইয়ে যাওয়া ‘ল্যাংড়া গদ্য’ ছেড়ে এখন থেকে বরং ‘চ্যাংড়া গদ্য’ ধরুন। তবে মানুষ খাবে।
‘চ্যাংড়া গদ্য’ বোধহয় হজম হল না বলাইয়ের। হাঁ করে সে তাকিয়ে রইল মানিকবাবুর দিকে।
মানিকবাবু বললেন, “সাহিত্যে এখন একটা ‘রক এন রোল’ চলছে কিনা। তাই চ্যাংড়া গদ্যের বেশ কদর।”
“মানে মিউজিকের ভাষা?”
“মিউজিক নয় রে ভাই। বলতে চাইছি, ‘রক’-এর ভাষা এখন বেশ ‘রোল’ করছে সাহিত্যের বাজারে। চ্যাংড়া গদ্য হল রকের সেই চ্যাংড়া ছোঁড়াদের ভাষা। সেই ভাষায় গদ্য লিখে অনেকেই ইদানীং চড়চড়িয়ে ওপরে উঠে যাচ্ছেন।”
বলাইয়ের বিস্ময় দেখে মানিকবাবু বললেন, “একটু খটমট ভাষা। চোখ-কান খোলা রেখে শিখতে হবে। যেমন ধরুন, কোনও ঝামেলায় পড়েছে রকে বসা এক আড্ডাধারী। সে কীভাবে কথাটা ছাড়বে এটা ভাবতে হবে।”
“বলাই বলল, ‘বাঁশ খেয়ে গেছি’ চলবে?”
“এই তো বুঝেছেন দেখছি। ‘বাঁশ খেয়েছি’ বেশ চলবে, ‘কী গাড্ডায় পড়লাম’ মন্দ না, কিংবা আরও ভাল হয় যদি বলেন, ‘কী আছোলা একটা খেয়ে গেলাম।”
বলাইকে হাসতে দেখে মানিকবাবু বললেন, “আরও একটা উদাহরণ দিই। ধরুন ‘মধুবাবুর সুগার ধরেছে’ চ্যাংড়া ভাষায় কী হবে?”
“এটা তো পারব না স্যার।”
“এটা তো আরও সোজা, মধুবাবু এখন ‘হিসু-রোগী’।”

বলাই এবার হো হো করে হেসে ফেলল দেখে মানিকবাবু বললেন, “দেখছেন, কেমন হাসি পাচ্ছে। এই হাসি পাঠক হাসলেই কেল্লা ফতে। চ্যাংড়ারা সে গল্প চাটবে। আর ‘ভাষার কী হল, ভাষার কী হল’ বলতে বলতে বিশুদ্ধতাবাদীরাও আড়ালে উল্টেপাল্টে দেখবে সে বই। আর তাতেই আপনার লাভ।”
“কিন্তু স্যার, আমার ন্যাকটা যে বরাবরই ট্র্যাজেডির দিকে। লিখতে বসলেই কেমন একটা দুঃখ দুঃখ পরিবেশ তৈরি করে ফেলি।”
“ওটাই তো সমস্যা। শুনুন, ট্র্যাজেডি ট্যাকল করা চাট্টিখানি কথা না। তারপর পাঠকের কথাও তো ভাবতে হবে। জীবনের গুঁতো খেতে খেতে মানুষ এখন এত ক্লান্ত যে বইয়ের গুঁতো আর এখন সেভাবে নিতে পারে না। ট্র্যাজেডির পাঠক এখন তাই ট্র্যাজিক রেটে কমছে। তাই বলছি, চ্যাংড়া গদ্যের পথে হাঁটুন। পাঠককে হালকা মুচমুচে জিনিস দিন। গার্হস্থ্য গুঁতোগুঁতি দেখান, পিন ফোটানো ‘পিএনপিসি’ দেখান, হালকা পরকীয়া, মিষ্টি চিটিংবাজি দেখান— যেভাবে হোক হাসিটা ধরে রাখুন। দেখবেন ‘আতা পাঠক’ চেটেপুটে খাচ্ছে।”
“আতা পাঠক কী জিনিস স্যার?”
“আমজনতাই সংক্ষেপে ‘আতা’। আপনার তো দেখছি চ্যাংড়া গদ্যের সঙ্গে সেভাবে পরিচয় নেই। শুনুন, আতা পাঠকের দাঁতের জোর কম। এরা সাহিত্য চিবিয়ে রস নিতে পারে না। তাই চেটে খায়। এদের ধরতে ভাষায় তো চাটনি লাগবেই।”
“বুঝেছি স্যার, কমেডির পথেই হাঁটতে বলছেন, তাই তো? ট্র্যাজেডি বেছে ভুল করে ফেলেছি মনে হয়। ভাগ্যটাই খারাপ আমার।”
“শুনুন, ভাগ্য আর গামছা— কখন যে খুলবে তা কিন্তু কেউ জানে না। তাই আফসোস ছেড়ে মন দিয়ে লিখুন। মুচমুচে করে লিখুন, চিপ্‌সের মতো লিখুন। মনে রাখবেন, আলু চিপ্‌স হলে তার দাম দুশো গুণ বেড়ে যায়।”
মানিকবাবুর থেকে ছাড়া পেয়ে আমরা তখন কলেজপাড়ায়। বলাই বলল, “কয়েকটা বই কিনব।”
চারপাশে সেলসম্যানদের হাঁকডাক। একটা ফাঁকা দোকানের কাউন্টারের সামনে দাঁড়িয়ে পড়লাম।
“বলুন কী বই নেবেন?” প্রশ্ন ছুড়লেন এক সেলসম্যান।
বলাই ভেবেচিন্তে বলল, “মানে, চ্যাংড়া গদ্যের ওপর কিছু থাকলে দিন না।”
“কী গদ্য?” হকচকিয়ে গেলেন সেলসম্যান।
গলা ঝেড়ে বলাই বলল, “চ্যাংড়া গদ্যের বই, মানে আতা পাঠকের মনে ধরার মতো বই চাইছি।”
সেলসম্যানের চোখ তো প্রায় কপালে। পরিস্থিতি সামাল দিতে পাশ থেকে বললাম, “বেশ মুচমুচে রম্যরচনার কয়েকটা বই দেখান না। ওগুলোই চলবে।”
“তাই বলুন।” বলে বই খুঁজতে লাগলেন সেলসম্যান।
বলাই নিচু গলায় বলল, “এত ভাল ভাল টার্মগুলো বইয়ের জগতের মানুষজন এখনও শোনেইনি! কী আশ্চর্য না!”

 

চিত্রকর: রাজ রায়

পড়ুন আগের পর্বগুলি…

দূরবীনে চোখ

আঁতেলনামা

লকডাউনে কল্লোলিনী

কান্না-হাসির কথা

লকডাউনে প্রশিক্ষণ

‘বারোয়ারি নকশা’য় সুন্দর মুখোপাধ্যায়ের ১২টি পর্ব পাবেন নীচের লিঙ্কে।

নিখিল ভারত… সমিতি

‘বারোয়ারি নকশা’য় জয়দীপ চক্রবর্তীর ১২টি পর্ব পাবেন নীচের লিঙ্কে।

গৃহবন্দির জবানবন্দি ১২

You might also like