
নিখিল ভারত… সমিতি
বাইরে ‘সুখ’। বাইরেই অসুখ। করোনা এফেক্ট। বাধ্যতামূলক ঘরে অন্তরিন। অমান্য মানে বিপদকে নেমন্তন্ন করে আনা। তাই সুখের চেয়ে স্বস্তি ভাল। ঘরে সেই স্বস্তি। ঘরেই অস্বস্তি। তবে উপায়? চিন্তাকে চিন্তামণির ওপর ছেড়ে মন হালকা রাখাই সবচেয়ে ভাল উপায়। এই ‘জরুরি অবস্থা’র দিনে আপনাদের জন্যেই ‘দ্য ওয়াল’ এনেছে একটি বিভাগ ‘হাসো তো দেখি’। সেখানে আছে হাসির ছবি। এবার এল হাসির লেখা ‘বারোয়ারি নকশা’। পড়ুন, মন ভাল রাখুন।
সুন্দর মুখোপাধ্যায়
শোভাবাজার ঘাট থেকে চক্ররেলের লাইন ধরে আর একটু দক্ষিণে এগোলে একটা হাফ নিরিবিলি জায়গা আছে। বেশি না, মিনিট পাঁচেক হাঁটতে হবে। হাফ নিরিবিলি বললাম এই কারণে, মানুষজন আছে অথচ নেই। মানে কেউ এখানে বিশেষ দাঁড়ায় না। পাশের রাস্তা দিয়ে তারা দ্রুত জায়গাটা পার হয়ে যায়। নোংরা মাঠ, অপরিষ্কার ভাঙাচোরা রাস্তা, উপচে পড়া ডাস্টবিন— এসব নিয়ে জায়গাটা মোটামুটি নিরিবিলি। ঠিক ওই জায়গাটায়, গঙ্গার পাড়ে একটা আড্ডা আছে। সে আড্ডার চার-পাঁচজন মেম্বার। হয়তো আরও আছে। আমি মেম্বার নই বলে ঠিকঠাক জানি না। তবে যতদিন গেছি, ওই ক’জনকেই দেখেছি। তাদের মধ্যে একজন আমায় আশ্বস্ত করেছেন, ‘আপনি শিগগিরিই সভ্য হবেন।’ সদস্যদের বয়ঃক্রম চল্লিশ থেকে ষাটের মধ্যে। এদের নাম আমি জানি, কিন্তু মাফ করবেন, হাজার অনুরোধ করলেও তা আমি বলতে পারব ন। বলে ফেললে সভ্যতা থেকে অনেক দূরে চলে যাবার চান্স আছে। মেম্বারশিপ এখনই হবে না।
ভাবছেন তো, আবার কোনও মদ্যপ বা গঞ্জিকাপ্রেমীর কথা লিখতে বসেছি। মোটেই তা নয়। এরা মদ, গাঁজা তো দূরস্থান— চা, পান, সিগারেট, সুপুরি, লবঙ্গ, মৌরি থেকেও বহুদূরে অবস্থান করেন। আড্ডার এই স্থান নির্বাচনের সেটাও অন্যতম কারণ। এত নোংরা, জঞ্জালপূর্ণ জায়গা যে আশপাশে হাফ কিলোমিটারের মধ্যে কোনও চায়ের দোকান নেই। তবে তাতেও বিপদ পুরো কাটেনি। কেটলির নীচে টিনের উনুন লাগানো জনৈক ভ্রাম্যমান চাওয়ালা একসঙ্গে পাঁচজন মধ্যবয়স্ককে দেখে একদিন লোভ সামলাতে পারেনি। চক্ররেলের লাইন থেকে তাদের কাছে যাবার উপক্রম করতেই পাঁচজন প্রথমে কপালে হাত দিয়ে, পরে দু’হাত জড়ো করে তাকে ক্রমান্বয়ে নমস্কার করতে শুরু করে দেন। চাওয়ালা ভেবেছিল নিশ্চয়ই রাস্তা দিয়ে কোনও মড়াধরা যাচ্ছে। সেও কেটলি নামিয়ে রাস্তার দিকে মুখ করে একটা সলিড প্রণাম ঠুকে বসল। সে রাস্তায় তখন সবাই চলমান, কেবল একখানা হলুদ ট্যাক্সি দাঁড়িয়ে ছিল। সে প্রণাম ডাইরেক্ট গিয়ে পোঁছল ট্যাক্সি ভেতর সাদাশাড়ি পরিহিতা জনৈকা স্থূলাঙ্গীর কাছে। তিনি জানলা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে পিচিক করে পিক ফেলে চিৎকার করলেন, ‘এই মেনিমুখো… তুই আমায় পেন্নাম কেন করলি?’
হকচকিয়ে গিয়ে চাওয়ালার মুখ ফসকে বেরিয়ে গেল, ‘আমি ভেবেছিলাম মড়া…’
বলা বাহুল্য, এরপরের ডায়লগগুলো ঠিক ঠিক ঝাঁজ-সহ বাংলায় লেখা খুব কঠিন।
যাক গে, আপনারা ভাবছেন তো, তা হলে এই পাঁচজন কেন এখানে জড়ো হয়। আমিও একসময় তাই ভাবতাম। পরে বুঝেছি, অত্যন্ত সঙ্গত কারণেই এরা মিলিত হন। না, এদের কেউ মদ্যপায়ী নয়, ধূমপায়ীও নয়। এরা মিতব্যয়ী। ভেবে দেখুন, স্বাধীনতার পর পশ্চিমবঙ্গে সমস্ত ধরনের পেশা, নেশা ও ভাবালুতার একটা না একটা সংগঠন গড়ে উঠেছে। শ্রমিক, কৃষক, লিটল ম্যাগাজিন— কার নেই! কেবল ‘নিখিল ভারত মিতব্যয়ী সমিতি’ বলে কিছু হয়নি। মিতব্যয়ীরা এমনিতেই উপেক্ষিত। সংগঠন না থাকায় তারা স্বাভাবিকভাবেই নিরাপত্তার অভাব বোধ করছিলেন।
প্রস্তাবটা প্রথমে দিয়েছিলেন ‘ক’বাবু। মাস ছয়েক ভেবে তাতে সায় দেন ‘মু’বাবু। সামান্য একটা সায় দেওয়ার প্রশ্নে ছ’মাস কেন? ‘মু’বাবু বললেন, ‘চিন্তা হল অর্থের প্যারালাল একটা শক্তি। তাই অর্থের মতোই তা ভেবেচিন্তে খরচ করতে হয়।’
এইভাবে ‘ধা’ বাবু, ‘ব্যা’ বাবু, ‘পো’বাবুরা কেউ ছ’মাস, কেউ আট মাস সময় নিয়ে ছিলেন। শেষপর্যন্ত প্রস্তাব পেশের সাড়ে তিন বছরের মাথায় সেটি সর্বসম্মতিতে পাশ হয়।
এই ‘ধা’, ‘মু’, ‘ব্যা’, ‘পো’ নিয়েও আপনাদের মনে প্রশ্ন উঁকি দিচ্ছে নিশ্চয়ই। আমিও কৌতূহলী হয়েছিলাম। ‘পো’বাবু অত্যন্ত তাচ্ছিল্যের সঙ্গে জবাব দিয়েছিলেন, ‘এটুকু বুঝলেন না! আপনাকে দেখছি এখনও অনেক তৈরি হতে হবে।’
তারপর আমার বোবা দৃষ্টিকে খানিক স্নেহ করেই তিনি বললেন, ‘অ্যাকচুয়ালি মিতব্যয়িতা একটা সাধনা। শুধু অর্থে নয়, সর্বক্ষেত্রে মিতব্যয়ী হতে হবে। যখন লেখার দরকার তখন ‘পোড়েলই’ লিখব, বলতে গেলে দুটো লেটার এক্সট্রা খরচ করব কেন, ‘পো’ বললেই তো হয়। আমারই তো জিহ্বানিঃসৃত সাউন্ড। আরে বাবা, বাঁচলে তো আমারই বাঁচবে!’
ভেবে দেখলাম, কথাটা হান্ড্রেড পারসেন্ট ঠিক। ‘পো’বাবুর কেবল দুটো অক্ষর বাঁচছে, মুখোপাধ্যায় হলে তো অনেকগুলো লেটারের সাশ্রয়।
তবে এটা কোনও প্রকাশ্য সংগঠন নয়, গোপন। না, তাও ঠিক না, বরং বলা যায় সংগোপন।
অনেক তাচ্ছিল্য, টিটকিরি, মসকরা মিতব্যয়ীদের উদ্দেশে ধাবিত হয়। সেগুলো জমতে জমতে মনের সংগোপনে পাথরের মতো হয়ে ওঠে। এবং একজন সৎ সাচ্চা মিতব্যয়ীর সেটাই কাম্য। চট করে কোনও আঘাতে যদি সে পাথরের খানিকটাও ঝুরঝুর করে ভেঙে পড়ে, তা মিতব্যয়ী সমিতির পরাজয়। তাই বহু টাফ পরীক্ষার পরে এই সমিতির সভ্য হওয়া যায়। আমার অ্যাপ্লিকেশন এই কারণে ঝুলে আছে, মঞ্জুর হয়নি। এবং এই যে এক-দু’দিন অন্তর মুহুর্মুহু এত বৈঠক, সেও সাংগঠনিক কারণে। এখন এরা শত্রু চিহ্নিত করছেন। পরবর্তীকালে ঠিক হবে এই শত্রুদের জয় করা হবে, না কি অ্যাভয়েড।
যতদূর আমি জানি, এই সমিতির শত্রুতালিকা প্রায় সম্পূর্ণ। এখন স্ক্রুটিনি চলছে। তালিকা অনুযায়ী যেকোনও মিতব্যয়ীর নিকটতম শত্রু বউ এবং জামাই। এরপর পরিক্রমে রয়েছে দুধওলা, মাছওলা, মুদি ও অফিস কলিগ। তবে বাসে ট্রেনে খবরের কাগজ পড়া ব্যক্তিদের এরা অত্যন্ত সম্ভ্রমের চোখে দেখেন। মাথা ঝুঁকিয়ে বা গলা বাড়িয়ে পড়ার কাজটা দিব্বি হয়ে যায়। সেদিন ‘ধা’ বাবু ‘ব্যা’ বাবুকে বলছিলেন, ‘রিটায়ারমেন্টের এজ বেড়েছে, কিছু শুনেছেন নাকি?’
‘‘ব্যা’ বাবু বললেন, ‘কই, শুনিনি তো!’’
‘ধা’ বাবু বললেন, ‘খবরের কাগজে দেখলাম মুখ্যমন্ত্রী বলেছেন রাজ্য সরকারি কর্মচারীদের অবসরের বয়সের ঊর্ধ্বসীমা–।’
‘ব্যা’ বাবু ব্যগ্র হয়ে বললেন, ‘কত?’
‘ধা’ বাবু বললেন, ‘সেটা দেখতে পাইনি, বাকিটুকু লোকটার হাতের আড়ালে ছিল তো…।’
এই সেদিন এই সমিতির মেম্বারশিপের জন্য আমার একপ্রস্থ সংক্ষিপ্ত ইন্টারভিউ নেওয়া হল।
‘ক’ বাবু বললেন, ‘নিজের জীবনে হয়েছে, এরকম সাশ্রয়কারী দু-একটা ঘটনা বলুন।’
‘আজ্ঞে, এই জামাখানা একটানা সাতদিন পরি। কেচে সাবান নষ্ট করি না।’
‘ব্যা’ বাবু মাথা নাড়িয়ে বললেন, ‘ভেরি ব্যাড… অস্বাস্থ্যকর। প্রতিদিন কাচবেন।’
আমি বিস্মিত হয়ে বললাম, ‘রো-জ? সে তো বিপুল খরচ!’
‘ব্যা’ বাবু বিরক্ত হয়ে বললেন, ‘আহা-হা, পুরো কাচতে কে বলেছে, হ্যাঙারে ঝুলিয়ে কেবল বগল দুটোয় সাবান দেবেন।’
আমি হাঁ। ‘ক’ বাবু বললেন, ‘নেক্সট ইভেন্ট?’
বললাম, ‘আজ্ঞে, আমার ডাবল বেড খাট, কিন্তু তাতে সিঙ্গল মশারি লাগিয়েছি। তাতে শোয়া হয়, বসাও যায়। চেয়ার কিনতে হয়নি।’
‘ক’ বাবু ভীষণ রেগে বললেন, ‘একা মানুষ, ডাবল খাট কিনেছেন কেন… অপচয়…।’
কথাটা বলতে বলতে হঠাৎ চুপ করে তিনি মাটি থেকে সবেগে কয়েকখানা ঘাস ছিঁড়ে নিলেন। তারপর দু-এক মুহূর্তের মধ্যে ভোল বদলে হাসিমুখে বললেন, ‘মাপ করবেন, এক ছিলিম বেশি রেগে গিয়েছিলুম। ক্রোধও একটা শক্তি, খরচ করে ফেললুম…।’
ভীষণ অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, ‘এক ছিলিম রাগ মানে?’
‘ক’ নয়, ‘মু’ বাবু জবাব দিলেন, ‘আনন্দ, সুখ, ক্রোধ, অভিমান– এসব আমরা ছিলিমের হিসেবেই মাপি। এক ছিলিম মানে কতটা পৃথিবীর কেউ জানে না, আমরাও না। তাই ওতেই সুবিধে, খরচ কম হয়।’
‘ধা’ বাবু গলাখাকারি দিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, ‘আর কোনও ইভেন্ট মনে পড়ছে আপনার?’
আমতা আমতা করে বললাম, ‘আজ্ঞে… ঠাকুরঘরে দশ-বারোজন দেবদেবীর ছবি আছে। মাত্র দুটো বাতাসা দিই… পার হেড একটাও না।’
এবার কিন্তু ‘ক’ বাবু এক ছিলিমও রাগলেন না। বরং আধ ছিলিম হেসে মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন, ‘বাবা, ওটা একটা দিলেও তো হয়…।’
ডিসক্লেমার: এই কলাম হইতে অন্তর্হিত হইবার পূর্বে ঘোষণা করিতেছি, আমার বারোখানা লেখায় ব্যবহৃত সমস্ত ডায়ালগ, আসবাব, নেশাভাঙ এবং চরিত্রগুলি কাল্পনিক। এই লকডাউনের বাজারে যদি কেহ এইসবের সহিত সামান্যতম মিল খুঁজিয়া পান, তবে জানিবেন তাহা এই দীর্ঘ পতি-বন্দি বা পত্নী-বন্দি দশার আত্মোপলব্ধি।
চিত্রকর: রাজ রায়