
মৌতাত
বাইরে ‘সুখ’। বাইরেই অসুখ। করোনা এফেক্ট। বাধ্যতামূলক ঘরে অন্তরিন। অমান্য মানে বিপদকে নেমন্তন্ন করে আনা। তাই সুখের চেয়ে স্বস্তি ভাল। ঘরে সেই স্বস্তি। ঘরেই অস্বস্তি। তবে উপায়? চিন্তাকে চিন্তামণির ওপর ছেড়ে মন হালকা রাখাই সবচেয়ে ভাল উপায়। এই ‘জরুরি অবস্থা’র দিনে আপনাদের জন্যেই ‘দ্য ওয়াল’ এনেছে একটি বিভাগ ‘হাসো তো দেখি’। সেখানে আছে হাসির ছবি। এবার এল হাসির লেখা ‘বারোয়ারি নকশা’। পড়ুন, মন ভাল রাখুন।
সুন্দর মুখোপাধ্যায়
সন তেরোশো তেতাল্লিশ, ইংরেজির উনিশশো ছত্রিশে চরণবালা স্মৃতি মহিলা বিদ্যামন্দিরের উদ্বোধনে পণ্ডিত তারিণী চক্রবর্তী, বিএ (ডাবল)-এর অসাধারণ বাগ্মীতায় শ্রোতাগণ মুগ্ধ হয়েছিলেন। তারিণীবাবু বলেছিলেন, ‘‘কিছুদিন পূর্বে এন্ট্রান্স পরীক্ষার একখানা উত্তরপত্র দেখবার দুর্ভাগ্য আমার হয়েছিল। প্রশ্নপত্রে ছিল ‘মানবজাতি’ শীর্ষক একটি রচনা লিখ। তাতে জনৈক পরীক্ষার্থী লিখেছেন, ‘দুর্ভাগ্যের বিষয় এই যে সসাগরা এই বসুন্ধরায় মানুষ সর্বশ্রেষ্ট হইলেও সে মরণশীল। শ্রাদ্ধাদি মিটিবার কিছুকালের মধ্যে আত্মীয়কুটুম্ব তাহাকে বিস্মৃত হয়। অথচ একটি রসসিক্ত আম, সুস্বাদু ইলিশ অথবা নধর পাঁঠা নিজগুণে অমর। একদিন খাইলে বছরভর তাহার স্মৃতি অমলিন থাকে’।’’
এতদূর বলার পর শ্রোতাগণের হাস্যরোলের কারণে তারিণী চক্রবর্তীকে থামতে হয়েছিল। তাতে তিনি ক্রোধে অন্ধ হয়ে ভাষণের পরবর্তী অংশে আরও জ্বালাময়ী হয়ে ওঠেন। তিনি বলেন, ‘যে জাতি কেবল স্বাদ দিয়া এই বসুন্ধরার বিচার করে, যে জাতি যেখানে-সেখানে টিপ্পনি দিতে অভ্যস্ত এবং যে জাতির বিদ্যার চেয়ে ফাঁকি-বুদ্ধির আস্ফালন বেশি, তাহার ভবিষ্যৎ নাই।’
শ্রোতাগণ মাথা হেঁট করে, করতালি দিয়ে তারিণী মহাশয়কে স্বাভাবিক করে তোলেন। এরপর তিনি বঙ্গনারীর প্রতি প্রগাঢ় সমবেদনা জানিয়ে বলেন, ‘কন্যাগণ, আপনারা যেভাবে লাউয়ের সঙ্গে চিংড়ি মিশিয়ে একটি অপাপবিদ্ধ ফলকে স্বাদযুক্ত করে তোলেন, সেভাবেই রন্ধনবিদ্যা, গৃহস্থালি বিদ্যার সহিত অর্থকরী জ্ঞান ও বিদেশি ভাষাজ্ঞান আয়ত্ত করে একদিন স্বাবলম্বী হয়ে উঠবেন।’
তারিণী চক্কোত্তির আশীর্বাণীর কথা মোহিনী মাস্টার জানতেন না। জানার কথাও নয়। আরও বছর দশেক আগে, সেই পঁচিশ-ছাব্বিশ সালে তিনি বিবাগী হয়ে যান। মোহিনীবাবু বিদ্যালয়ের শিক্ষক ছিলেন না। টেলর বা স্টেশনমাস্টারও নন। কেবল খেয়ে খেয়েই তিনি মাস্টার। কবে কীভাবে এই উপাধি প্রাপ্ত হয়েছিল কেউ জানে না। একটা ফুল সাইজের কাঁঠাল তার কাছে নস্যি। গোটা নধর পাঁঠা একা খেয়ে তিনি দিব্বি দ্বিপ্রাহরিক নিদ্রায় যেতেন। ভাতটাত ছাড়াও তার সারাদিনের খাদ্যতালিকায় ছিল মিনিমাম দু’সের দুধ, কয়েক ধামা ফল, নানাবিধ মিষ্টান্ন ইত্যাদি। শোনা যায়, বিবাহের ভোজে তাকে ভাড়ায় যেতে হত। বর বা কনেপক্ষ অপরপক্ষকে টাইট দেওয়ার জন্য বা নিছক আমোদের কারণে তাকে নিয়ে যেত।
এহেন মানুষ একদিন নিজের পঞ্চমবর্ষীয় নাতনির আলতা রাঙানো শিশুচরণ দু’খানি দেখে এতটাই শোকাতুর হয়ে যান যে, এরপরে সংসারে মন টেকানো অসম্ভব হয়ে ওঠে। বিবাগী হয়ে অধ্যাত্মসাধনায় তিনি বাকি জীবন অতিবাহিত করেছিলেন। সেই জীবনে সামান্য কিছু ফলমূল কেবল ছিল তার আহার্য। শোনা যায়, পরিবর্তিত সেই জীবনে কোনও এক ভক্তকে তিনি বলেছিলেন, ‘যাহাকে খাইবে তাহাকে ভালও বাসিবে…।’ আধ্যাত্মিক পুরুষ, বেশি কথা বলেন না। তাই বিশদে ব্যাখ্যা পাওয়া যায়নি। তবু ভক্তগণ ‘অহো অহো’ করতে করতে বাড়ি ফিরেছিল। এটা কি সুখী সংসার নির্বাহের টিপস, নাকি পরিবেশরক্ষার সারকথা আজও ফয়সালা হয়নি।
আধ্যাত্মের আভাস ও ইলিশের সুবাসে মাতোয়ারা বাঙালির সবচেয়ে বড় অসুবিধে, একই সঙ্গে দু’টি বিপরীতমুখী মত ও পথে সে আকর্ষণ বোধ করেছে। তাই যুগ যুগ ধরে ডাকাত সাধু হয়েছে, কমুনিস্ট হয়েছে শিষ্য।
এসব ছেড়ে চলুন এবার সাধারণ গৃহস্থের ঘরে উঁকি দিই। এও প্রায় সত্তর বছর আগে, পঞ্চাশের দশকের কাহিনি। মৃত্যুঞ্জয় ভটচাজের একান্নবর্তী পরিবার। প্রতিবার প্রায় তিরিশখানা পাত পড়ে। অথচ আহার্যের পরিমাপ ঠিক ঠিক, কোথাও কম হবার জো নেই। শুধু তিরিশজনকে নিয়েই পরিবার নয়। দুটো কুকুর, চার-পাঁচটা বেড়াল, হাঁস মুরগিটুরগিও ফ্যামিলি মেম্বার। বিরাট বড় ভাতের হাঁড়ির অন্তত দশ লিটার পরিমাণ ফ্যান রোজ গোয়ালঘরের ডাবায় দিয়ে আসা এখানকার নিয়ম। প্রতিদিনকার এত বড় কর্মকাণ্ড চলে যার তীক্ষ্ম নজরদারিতে তিনিই এই পরিবারের বড়কর্তা মৃত্যুঞ্জয় ভটচাজ। গোয়ালের গোরু থেকে ছাদের ঘরে যোগসাধনায় মগ্ন অকৃতদার ছোটভাই, কেউ তার দৃষ্টির বাইরে নয়।
অথচ এই মানুষেরও উৎসব মোচ্ছবে এক ছিলিম গঞ্জিকা সেবনের জন্য কী প্রাণান্তকর প্রয়াস! অষ্টমীর সন্ধেতে তিনি বড়বউকে বললেন, ‘একটু দোর আগলে বসো তো…।’
তীব্র অভিমানে বড়বউ বললেন, ‘সারাদিন হেঁশেল ঠেলছি, এখন ওসব পারব না…।’
‘তাহলে ভেতরে এসো, দোর দিই…’
বড়বউ চোখ বড় বড় করে বললেন, ‘ওমা, তুমি-আমি ভেতরে, দোর বন্ধ… ছি ছি, ভীমরতি হয়েছে গা—’
অনেক অনুনয় বিনয়ের পর বউ দোর আগলে বসলেন। তবে এমনি নয়। সারাদিন হাড়ভাঙা খাটুনির পরও সুচ-সুতো ও বাহারি একটুকরো কাপড় নিয়ে বসেছেন। সুতো দিয়ে কাপড়ে লেখা হবে। ভেতরে বড়কর্তা মৌতাতে আচ্ছন্ন, বাইরে তখন সূচিশিল্পে লেখা হচ্ছে ‘সুখে থাকো।’
আর একটি মাত্র কাহিনি বলে নতুন বছরে পৌঁছে যাওয়া আপনাদের ছেড়ে দেব। সত্তরের দশক, এখনকার মতো পেইং গেস্ট প্লাবিত শহর নয়। এটা একটা মেসবাড়ির কাহিনি। বউবাজারের মেসে ম্যানেজার বিশ্বম্ভর ভটচাজের পরিচালনায় পালিত হয়েছিল বাংলা নববর্ষ। দুপুরের ঘুমের অন্তে মেস মেম্বাররা যে যার হন্তদন্ত হয়ে বেরিয়ে যাওয়ায় মিনিমাম রিহার্সালটুকুও দেওয়া হয়নি। থলে ভর্তি ক্যালেন্ডার ও মিষ্টির প্যাকেট সংগ্রহ করে মেম্বারদের দিয়ে আসতে আসতে সাতটা-সাড়ে সাতটা। তারপর বচ্ছরকার দিনে সামান্য নেশাভাং। চৌকির নীচে রাখা টিনের তোরঙ্গ থেকে বেরিয়ে এল একপুরিয়া গাঁজা বা ছোট পাঁইট। এতসব করার পর প্রায় রাত্রি ন’টায় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। শোনা যায়, একই রবীন্দ্রসংগীত তিনজন তিনরকম সুরে গেয়েছিলেন। এবং মেসের কমল ঠাকুর অত্যন্ত দরদ দিয়ে একটি মরমী শ্যামাসঙ্গীত পরিবেশন করেছিল। তবে তার শেষ তিন লাইনের সুর হয়ে গিয়েছিল চালু হিন্দি গানের অনুরূপ। এছাড়া উপায়ই বা কী? আচ্ছন্ন বাবুরা ঘুমিয়ে পড়লে এত রান্না খাবে কে?
ছ্যাঁচড়া থেকে মিক্সড ভেজিটেবিলে পৌঁছে যাওয়া বাঙালি নববর্ষের উইশ ইংরেজদের থেকে ধার করেছে ঠিকই, কিন্তু মৌতাতে সে এখনও ষোলআনা বাঙালি।
সুন্দর মুখোপাধ্যায়ের ‘বারোয়ারি নকশা’র আগের পর্বগুলি…