গৃহবন্দির জবানবন্দি ১১
বাইরে ‘সুখ’। বাইরেই অসুখ। করোনা এফেক্ট। বাধ্যতামূলক ঘরে অন্তরিন। অমান্য মানে বিপদকে নেমন্তন্ন করে আনা। তাই সুখের চেয়ে স্বস্তি ভাল। ঘরে সেই স্বস্তি। ঘরেই অস্বস্তি। তবে উপায়? চিন্তাকে চিন্তামণির ওপর ছেড়ে মন হালকা রাখাই সবচেয়ে ভাল উপায়। এই ‘জরুরি অবস্থা’র দিনে আপনাদের জন্যেই ‘দ্য ওয়াল’ এনেছে একটি বিভাগ ‘হাসো তো দেখি’। সেখানে আছে হাসির ছবি। এবার এল হাসির লেখা ‘বারোয়ারি নকশা’। পড়ুন, মন ভাল রাখুন।
জয়দীপ চক্রবর্তী
এক মাস হতে চলল ঘরের মধ্যেই আটকা পড়ে আছি। রোদে পুড়ছি না। জলে ভিজছি না। এই গরমে কুলকুল করে ঘামতে ঘামতে ক্লাসে চিৎকার করছি না সারাদিন। মাঝেমধ্যে এক-আধ দিন সকালে উঠে বাজার যাওয়া। বাজার-টাজারে গেলে একটু হাঁটাহাঁটি হয়, দু-পাঁচজনের সঙ্গে দেখাসাক্ষাৎও হয়। বাড়িতে একই মুখ সারাদিন দেখা। মাঝেমধ্যে বৈচিত্র ভালই তো লাগে। ছোটবেলায় ইতিহাস বইতে একটা আপ্তবাক্য মুখস্থ করেছিলাম। এই বিশাল জনগণতান্ত্রিক দেশের মূল সম্পদ নাকি আমাদের ‘বৈচিত্রের মধ্যে ঐক্য’। এই কথাটা যত বারই মিলিয়ে নিতে গেছি, অনিবার্য ফ্যাচাংয়ে পড়েছি বার বার। ‘ঘর ও বাহির’ সর্বত্র বৈচিত্র দেখেছি, বৈপরীত্য দেখেছি, কিন্তু ঐক্য বড় একটা চোখে পড়েনি। বাড়িতে অবসর সময়ে টিভির সামনে গুছিয়ে বসে আমি যেই উত্তমকুমারের সাদাকালো বাংলা সিনেমা দেখতে গেছি, আমার ছেলে রিমোট কেড়ে নিয়ে চালু করেছে আইপিএল-এর পুরনো খেলা। এই দৃশ্যপটে বউ ঢুকলে আরও কেলো। তিনি খেলা, সিনেমা কিছুতেই নেই। তাঁর চাই রিয়েলিটি শো। এই চরম বিচিত্রতার রিয়েলিটিতে আমি হাঁসফাঁস করেছি চিরকাল। কিছুক্ষণ অসম লড়াইতে হাত-পা ছুড়ে টিকে থাকার ব্যর্থ চেষ্টা করেছি। তারপর অপটু যোদ্ধার মতো রণে ভঙ্গ দিয়ে পৃষ্ঠ প্রদর্শন করেছি বাধ্য হয়ে। নিজেকে প্রবোধ দিতে দার্শনিকের মতো ভেবেছি, রঙিন পর্দার প্রেম, বিরহ, মিলন সবই তো মায়া। সমস্তই মিথ্যে। ওই মিথ আর মিথ্যেতে ভুলে থেকে কীই বা লাভ।
বাড়ি থেকে বাইরের বৃহত্তর জগতে আড্ডা দিতে বেরিয়ে আপনমনে হাঁটতে হাঁটতে সে সময় কতবার মনে মনে স্বপ্ন দেখেছি, একদিন নিশ্চিত আমরা ‘এক জাতি, এক প্রাণ, একতা’ ইত্যাকার চিন্তাকে সফল করে গার্হস্থ্য আশ্রমে সহমত হয়ে সাধনালিপ্ত হবার ফুরসত পাব। পাবই যে সে বিশ্বাস আমার ছিল। তবে তা এমন নির্মমভাবে পাব, জানা ছিল না। জানলে এমন মন থেকে এই ঐক্য, এই সাম্য আমি চাইতাম না। আগে শুধুই সংসারে অর্ডার করেছি। চা দাও, ভাত বাড়ো, জামা এনে দাও, প্যান্টুল ইস্তিরি করে দাও, গেঞ্জির বগল ছ্যাঁদা হয়েছে, ছুচ-সুতো দিয়ে জুড়ে দাও…
এখন সব কাজ একসঙ্গে। একসঙ্গে বাসন মাজছি। রান্না করছি। ঘর ঝাঁট দিচ্ছি, মুছছি। কত কী শিখছিও প্রতিদিন। আগে এই সত্য কে জানত যে ঝাঁট দিতে যাওয়া মানে ক্রমশ এগিয়ে যাওয়া আর ঘর মোছা মানে নিরন্তর পিছু হটা!
রাস্তায় পুলিশ টহল দিচ্ছে সারাক্ষণ। ছিপ হাতে বসে থাকা মেছুড়ের মতো ফাতনা ফেলে অপেক্ষায় আছে তারা। ‘মুরগি’ পেলেই হেনস্থার চূড়ান্ত। হয় পিছনে ডান্ডা। নইলে কান ধরে ওঠবোস… সামাজিক সম্মান অনুযায়ী বন্দোবস্ত। রাজনৈতিক দাদা-টাদা হলে অবশ্য ছাড় আছে। তাঁরা নিজেদের কাজে কিছুতেই বের হতে পারেন না। তাঁরা জনগণের জন্যে চব্বিশ ঘণ্টাই উৎসর্গ করে রেখেছেন নিজেদের। রেশন, ত্রাণ সর্বত্র আমদানি-রফতানির সুষ্ঠু ও জটিল যোগ-বিয়োগ করতে হচ্ছে তাঁদের হিসেব কষে।
আমি নেতা নই। পাউরে লোক-টোকও নই। কাজেই বাইরে আড্ডা মারতে যাবার আমার উপায় নেই। দিনরাত বাড়ির চৌহদ্দির মধ্যে ঘুরঘুর করছি সোনাহেন মুখ করে। বাড়ির অন্য মানুষজনের জন্যে বেশ একটা গ্যাদগেদে আনুগত্য। খবরের কাগজে ভয় ধরে যাওয়ায় একটা কানা উঁচু গামলায় মুড়ি ঢেলে একসঙ্গে মুড়ি খেতে খেতে টেলিভিশনে চোখ রাখছি সবাই মিলে। মনে বেজায় ফুর্তি, এমন একটা ভাব ধরে রাখার চেষ্টা করছি চোখেমুখে।
বাড়িতে অন্তরিন থাকার সময় সাবধানে থাকাই নিরাপদ। এই একমাস ঘরে থেকে শিখেছি, যত মস্ত বাড়িই হোক আর সে বাড়ির যে প্রান্তে গিয়েই আপনি লুকোন না কেন, একজোড়া চোখ সবসময় আপনাকে দক্ষতার সঙ্গে পাহারায় রেখেছে। বেশি চনমন করলেই বিপদ। একগুচ্ছ অস্বস্তিকর প্রশ্নের মুখে পড়তে হবে আপনাকে। এই চাঞ্চল্য যে আপনার স্বভাবসিদ্ধ, এ চিত্তচাঞ্চল্য যেকোনও ব্যক্তিবিশেষের (পড়ুন, অন্য নারী) জন্যে নয় তা প্রমাণ করতে কালঘাম ছুটে যাবে আপনার। সে ঝক্কিতে গিয়ে অহেতুক সুগার, প্রেসার বাড়িয়ে না ফেলে বরং বাসন-টাসন মেজে এসে গিন্নির পাশে ঘন হয়ে বসে তাঁর রূপের প্রশংসা করুন আন্তরিক কণ্ঠে। গলায় পরম বিস্ময় এনে জিজ্ঞেস করুন, এত পরিশ্রমের পরেও কী করে এমন সোনার মতো ঝকমক করতে পারেন তিনি!
এ কথায় মৃদু লাজুক প্রতিবাদ উঠবে। যদিও সে প্রতিবাদ আদপে সানন্দ সম্মতিই। আপনি সেই ছদ্ম প্রতিবাদে দৃঢ় আপত্তি করে বলুন, বাইরে বের হওয়া নেই বলেই বোধহয় তাঁর চামড়ায় আর কোনও ট্যান নেই।
চামড়ায় ট্যান মানে মনেও কালচে রঙ ধরা। আর মনের সেই কালো রঙ, কুচকুচে বৃষ্টির মতন একমাত্র আপনাকেই ভেজাবে, আপনি জানেন। কাজেই তাঁর এই খাদহীন ঝকমকানির তত্ত্ব একবার যদি তাঁকে বিশ্বাস করাতে পারেন এই বাধ্যতামূলক কোয়ারেন্টাইন আপনার কাছে শুধু সহনীয়ই নয়, মোহময় হয়ে উঠবে সন্দেহ নেই। হয়তো সংসারে আপনার কাজের বোঝাও খানিক লাঘব হতে পারে। বাসন মাজায় মিলতে পারে ছুটি, রান্নায় নিত্যনতুন এক্সপেরিমেন্টের ছটা আপনার রসনাকে তৃপ্তি দেবে। এমনকি অপ্রয়োজনে দু-একবার বাজারে
যাবার অছিলায় বাড়ির একই মুখ বার বার দেখার ক্লান্তি ঘোচাতে আপনি নিরাপদে বাইরে বেরিয়ে পড়তেও পারেন। অপরপক্ষ বাধা দেবে না।
আমি তেমনই অমোঘ উপায়ে হাতে বাজারের থলি নিয়ে সাতসকালে বাড়ির বাইরে বেরিয়ে এলাম। রোদ্দুর এখন সহনশীল। দূষণহীন আকাশ আরও ঝকঝকে নীল। প্রশ্বাসে অতিরিক্ত অক্সিজেন ঢুকছে শরীরে। গতায়ু বসন্তেও ফুলগাছগুলি ফুলে ফুলে ভরে আছে। পাখি এসে বসছে গাছে। প্রজাপতি উড়ছে। মৌমাছিরা গুনগুন করে গান গাইতে গাইতে এ গাছ ও গাছ উড়ে বেড়াচ্ছে মনের আনন্দে। যেন প্রকৃতিজোড়া খুশির উদযাপন। কিন্তু সেই বর্ণিল আয়োজনে মানুষ কই, মানুষ? এমন অলৌকিক সুন্দর সকালও কি স্বভাব বৈপরীত্যে কলহপ্রিয় এবং ঈর্ষাকাতর মানুষ জাতিকে একে অপরের থেকে দূরেই সরিয়ে রাখবে? ভেবেছিলাম যে বৈচিত্র এবং বৈপরীত্য আমাকে ক্লান্ত করেছে এতদিন, আমাকে ক্ষতবিক্ষত করেছে মনে মনে, আজ তার থেকে মুক্তি হবে আমার। কিন্তু কোথায় সেই মুক্তি?
রাস্তায় চলতে চলতে আরও খানিক পথ পেরিয়ে গেলাম। মাথা তুলে চাইলাম সামনের দিকে। হ্যাঁ, ওই তো ইতস্তত ছড়িয়ে থাকা কিছু মানুষ। একে অন্যের থেকে নিরাপদ দূরত্ব রেখে আমারই মতো মুখে মুখোশ এঁটে নিজেদের পথে এগিয়ে যাচ্ছে তারা। গন্তব্য না জেনেই। হয়তো অপ্রয়োজনেও। বৈপরীত্য নয়। অনন্ত ঐক্যের সুতোয় বাঁধা মানুষ। যারা প্রত্যেকে একা। যাদের প্রত্যেকের মুখ মুখোশে ঢাকা।
অচানক আমার বুক ভারী হয়ে উঠল। একটা অদৃশ্য ভাইরাসের এত ক্ষমতা যে সে আমাদের পরস্পরের থেকে এত দূরে সরিয়ে দেবে, প্রত্যেকের মুখে পরিয়ে দেবে অনিবার্য রঙিন মুখোশ?
আমি মাথা নাড়লাম। উঁহু। কোভিড নাইন্টিন আসলে এক আশ্চর্য আয়না। মানুষে মানুষে দূরত্ব তৈরি হয়েছিল আগেই। আমরা মুখোশের আড়ালে মুখও ঢেকেছি বহু আগেই। সে শুধু সামনে এসে জগতের সামনে এই সত্যকে নগ্ন করেছে মাত্র।
চিত্রকর: রাজ রায়
জয়দীপ চক্রবর্তীর ‘বারোয়ারি নকশা’র আগের পর্বগুলি…