গৃহবন্দির জবানবন্দি ৯
বাইরে ‘সুখ’। বাইরেই অসুখ। করোনা এফেক্ট। বাধ্যতামূলক ঘরে অন্তরিন। অমান্য মানে বিপদকে নেমন্তন্ন করে আনা। তাই সুখের চেয়ে স্বস্তি ভাল। ঘরে সেই স্বস্তি। ঘরেই অস্বস্তি। তবে উপায়? চিন্তাকে চিন্তামণির ওপর ছেড়ে মন হালকা রাখাই সবচেয়ে ভাল উপায়। এই ‘জরুরি অবস্থা’র দিনে আপনাদের জন্যেই ‘দ্য ওয়াল’ এনেছে একটি বিভাগ ‘হাসো তো দেখি’। সেখানে আছে হাসির ছবি। এবার এল হাসির লেখা ‘বারোয়ারি নকশা’। পড়ুন, মন ভাল রাখুন।
জয়দীপ চক্রবর্তী
দীর্ঘ লকডাউনের ক্লান্তি আর একঘেয়েমি কাটানোর জন্যে দেশের সরকারের চিন্তার অন্ত নেই। কখনও বলছেন ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে হাততালি দিতে, কখনও বলছেন শাঁখ-কাঁসর বাজাতে, আবার কখনও মিনিট নয়েকের স্বেচ্ছা অন্ধকারের অস্বস্তি থেকে পুনরায় আলোতে ফেরার কথা ঘোষণা হচ্ছে টিভির পর্দায়। কিছু লোক এতে বেজায় বিরক্ত যেমন হচ্ছেন বেশ কিছু লোকের উৎসাহেরও অন্ত নেই। তবে উৎসাহের নিরিখে সব কিছু ছাপিয়ে গেছে টিভিতে রামানন্দ সাগর আর চোপরা সাহেবের রামায়ণ, মহাভারতের পুনঃসম্প্রচার। পরিসংখ্যান বলছে, এই দুই অনুষ্ঠান দর্শক টানার ব্যাপারে ইতিমধ্যেই সুপার-ডুপার হিট। সমগ্র ভারতবর্ষেই।
আমার বাড়িতেও যথারীতি দু’বেলা চলছে রামায়ণ আর মহাভারত। দু’বেলা নির্দিষ্ট সময়ে আমাদের টেলিভিশনের সামনে বসে পড়ার একটা কারণ যদি হয় মহাকাব্যের সর্বজনীন গ্রহণযোগ্যতা, তবে তার চেয়েও বড় কারণ নিশ্চিতভাবেই একটা হারিয়ে যাওয়া সময়কে আবার অনুভব করার নস্টালজিয়া। প্রথম যখন টেলিভিশনে রামায়ণ-মহাভারতের সম্প্রচার হয়েছিল, নিজের বাড়িতে বসে তা দেখার অবকাশ ছিল না আমার। টিভি তো দূরঅস্ত, ইলেক্ট্রিসিটিই ছিল না আমাদের গ্রামের বাড়িতে। অন্যের বাড়িতে গিয়ে দেখে আসতাম কিছু কিছু এপিসোড। তাইতেই কী উন্মাদনাই না ছিল সেকালে। কত স্মৃতি। গ্রামের মানুষের একসঙ্গে ভিড় করে বসে দেখা মহাকাব্যের পর্দায়নের পিছনে কত কিছু ঘটে যেতে দেখেছি সেই শিশুবয়েসেই। অপেক্ষাকৃত বড়দের গোপন ছোঁয়াছুঁয়ি, চোখে চোখে সাবধানি ইশারা…
এখন সেই বয়েস নেই। সংসারে কিছু না পাওয়ার রোমাঞ্চও উধাও হয়ে গেছে স্বাচ্ছন্দ্যর ঝোড়ো বাতাসে। এখন সোফায় গা এলিয়ে নিজের বাড়িতে ঠান্ডাঘরে রঙিন টিভিতে চোখ ডুবিয়ে আলস্যে ছোটবেলায় ফিরে যাবার বিলাস।
মহাভারতের থেকে রামায়ণের জনপ্রিয়তা আমার বাড়িতে বেশি। আমার গিন্নি বলেছেন, ‘মহাভারত দেখার কথা তবু খানিক মনে আছে। সাজানো-গোছানো সব রাজসভা। ভীষ্মের মারকাটারি অভিনয়। তখন একটু-আধটু বড় হয়েছি। অবাক হয়ে দেখতাম দ্রৌপদীর কী লম্বা চুলই না ছিল। বারো বছর বনেবাদাড়ে ঘোরার সময় তেল নয়, শ্যাম্পু নয়, বিউটি পার্লার নেই, কী করে মেনটেন করত কে জানে! আর হ্যাঁ, পাঁচ-পাঁচটা জোয়ান মদ্দকে ম্যানেজ করা… যাই বলো, ক্যালি ছিল মেয়েটার। তবে মহাভারত দেখার অত উৎসাহ এখন আর পাই না। সময়ও নেই। রামায়ণ কোন মেয়েবেলায় দেখেছি তা ভুলতেই বসেছি। এটা মিস করা যাবে না কিছুতেই…’
আমি জানি, আরও একটা কারণ মনে মনে পোষা রয়েছে ওর। মধ্যবিত্ত বাঙালি ঘরের বউমাত্রেই ভাবেন, তিনি সংসারে উপেক্ষিতা। সীতারই মতো। স্বামী কর্তব্যের দোহাই দিয়ে যেকোনও সময় অগ্নিপরীক্ষার মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিতে পারেন তাঁকে। পরিত্যাগও করতে পারেন সামান্য ছুতোয়-নাতায়। আশ্চর্যের বিষয় হল, সীতারা চিরকালই যে তাঁদের চারপাশের অদৃশ্য লক্ষ্মণরেখা অতিক্রম করেছেন চূড়ান্ত অবিমৃশ্যকারিতায় এবং চরম বিপর্যয় ডেকে এনেছেন জীবনে, এই কথাটা অনুক্তই থেকে যায় আধুনিক সংসারে। শুধু তাই নয়, সীতাদের ওই যে চাই চাই ভাবটা… স্বর্ণমৃগ দেখলাম তো আমার চাই। এই মানসিকতা শপিং মল থেকে শুরু করে পাড়ার ‘ভজহরি বস্ত্রালয়’ সর্বত্রই বাঙালি বিবাহিত পুরুষ অনুভব করেছেন আশা করি। অথচ মুশকিল হল এই যে, সব সত্যি কথা সবসময় মুখের সামনে বলা যায় না। বলতে নেইও। সংসার আসলে সমরাঙ্গন। অস্ত্রের ঝনঝন ছাড়াও সেখানে কূটনীতি নামক একটি মহাবিদ্যার প্রয়োগ করতে হয় প্রতি পদে পদে।
আমি অবশ্য যা কিছুই কূট, চিরকালই তার ঊর্ধ্বে। বংশ পরম্পরায় আমি কালীর উপাসক। কাজেই সংসারে স্ত্রীর পায়ের নীচে পড়ে থাকাই আমার নিয়তি, আমি জানি। এইসব গুহ্য কথা স্ত্রীকে মনে করিয়ে দেবার ভয়ংকর প্রচেষ্টার মধ্যে আমি যাই না। প্রকৃত সন্ধিতেই আমরা পাশাপাশি বসে রামায়ণ দেখি দু’বেলা। সোয়া এক ঘণ্টা করে পাক্কা আড়াই ঘণ্টা। লকডাউনের আগে দু’জনে দু’জনের পাশে সিনেমা হল ছাড়া আর কখনও এতক্ষণ বসে থেকেছি বলে মনেই পড়ে না। চুপি চুপি বলি, মাঝেমাঝে দু’জনে দু’জনের আঙুলে আঙুল ছুঁইয়ে পরখ করেও দেখি এই আমরা সত্যিই আমরাই কিনা…
আমার ছেলে রামলক্ষ্মণের ভক্ত নয়। তার হিরো হনুমান। এটার মধ্যে অবশ্য অস্বাভাবিকতা থাকার কথা নয়। শৈশব থেকেই হনুমানের সঙ্গে তার চির একাত্মতাবোধ। অমনই হুপহাপ শব্দে লাফালাফি, অমনই অহেতুক বাঁদরামি দিনভর। রামায়ণ দেখা শুরু করার পর থেকে সে হনুমানভাবেই রয়েছে সর্বক্ষণ। ‘সীতা মাইয়া, সীতা মাইয়া’ বলে মায়ের কোলে গিয়ে মুখ ঘষছে আর বলছে, ‘ধীরজ রাখিয়ে। শ্রীরাম প্রভু অবশ্য আ যায়েঙ্গে অউর রাবণকা বিনাশ কর কে আপকো লে যায়েঙ্গে।’
মাঝেমাঝেই আবার গাল ফুলিয়ে লাফিয়ে পড়ছে কখনও সোফা কখনও বিছানার ওপরে। আমি স্টপওয়াচ হাতে অপেক্ষায় আছি সোফা, বিছানা অথবা তার হাড়গোড় কোনটা আগে ভাঙে তার রেকর্ড রাখার জন্যে। ছেলেটাকে কিছুতেই বোঝানো যাচ্ছে না, প্রয়োজনে তার গামছা পাকিয়ে তৈরি করা ল্যাদলেদে লেজে পেঁচিয়ে কোনও সুষেনকেই তুলে আনা সম্ভব নয় কোয়ারেন্টাইন থেকে। মাঝেমাঝে আমার পুত্র আবার তার প্রাক-বয়ঃসন্ধির ভাঙতে থাকা গলায় ‘জয় শ্রীরাম, জয় শ্রীরাম’ বলে চিৎকার করেও উঠছে তারস্বরে। সেই জয়ধ্বনিতে আমি যারপরনাই চমকে চমকে উঠছি। দৌড়ে যাচ্ছি জানালার পাশে। বাইরে তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করছি এই সিংহনাদ আর কেউ শুনে ফেলল কিনা। বালক বোঝে না, অথচ আমি তো জানি, এই মুহূর্তে পশ্চিমবঙ্গে এমন উচ্চৈঃস্বরে ‘জয় শ্রীরাম’ ধ্বনি তোলা কতটা বিপজ্জনক!
লকডাউনে কাজ খানিক কমেছে অস্বীকার করার উপায় নেই। সোফায় গা এলিয়ে বসে থাকার জন্যেই কিনা জানি না, ক’দিন দেখছি পিঠে একটা ব্যথা ব্যথা ভাব। ভাবলাম, ছেলে যখন হনুমানভাবেই আছে, এই মওকায় ওকে দিয়ে খানিক সেবা করিয়ে নিই নিজের।
ছেলেকে মোলায়েম করে ডাক দিলাম, ‘বৎস্ হনুমান…।’
ছেলে উঠে এসে বিরক্তির সঙ্গে মুখ বেঁকিয়ে নিখাদ বাংলায় জিজ্ঞেস করল, ‘কী হয়েছে?’
আমি আরও নরম হয়ে বললাম, ‘হনুমান, প্রভু শ্রীরামকে সাথ ইস তরিখে সে বাত করনা আপকো শোভা নেহি দেতা।’
ছেলে আমার গায়ের ওপরে ঝাঁপিয়ে পড়ে বলল, ‘তুমি রাম হতে যাবে কোন দুঃখে? তুমি তো রাবণ। সীতা মাইয়াকে জোর করে ধরে আনার জন্যে আমি তোমাকে শাস্তি দেব।’
‘এই মেরেচে, আমি রাবণ হই কোন যুক্তিতে?’ গায়ের ওপর থেকে ওকে ঝেড়ে ফেলতে ফেলতে বলি, ‘তোর মা যদি সীতা হয়…।’
‘আমি তোমাদের বিয়ের সিডি দেখেছি।
‘কী করে দেখলি? পেলি কোথায়?’ ওর সঙ্গে লড়াই করতে করতেই আমি হাঁফাতে হাঁফাতে বলি।’
‘মা দেখছিল ক’দিন আগে ডেস্ক টপে’, ছেলে আমার বুকের ওপরে দু’দিকে পা ঝুলিয়ে বসে বলল, ‘তুমি যখন মাকে মামার বাড়ি থেকে চুরি করে নিয়ে গাড়িতে তুলছিলে এই লঙ্কাপুরীতে নিয়ে আসার জন্যে, তখন মা কী কান্নাই না কাঁদছিল। ঠিক সীতা যেমন কাঁদছিল রাবণ এসে তাঁকে হরণ করে নিয়ে যাবার সময়…।’
‘চুরি করব কেন?’ আমি আত্মপক্ষ সমর্থন করে বলি, ‘মা তো নিজের ইচ্ছেতেই আমার সঙ্গে এসে উঠেছে এই বাড়িতে, স্বয়ম্বরসভায় আমার গলায় মালা পরিয়ে…।’
‘হতেই পারে না’, ছেলে দু’হাতে আমাকে চেপে ধরল, ‘তাহলে মা কিছুতেই অমন হাউমাউ করে কাঁদত না। প্রাণপণে জাপটে ধরে থাকত না দাদুভাইকে। বেচারা দাদুভাই, বৃদ্ধ জটায়ু…।’
কী জ্বালা, এইটুকু ছেলেকে বোঝাই কী করে, দীর্ঘ রুক্ষ গ্রীষ্মের দাবদাহে প্রার্থনায় থাকা মানুষের জন্যে আকাশ যখন বৃষ্টি হয়ে কাঁদে সে কী কষ্টের কান্না?
আমি চুপ করেই রইলাম। আবার ছেলেবেলায় ফিরলাম মনে মনে। গ্রাম্য বয়ঃজ্যেষ্ঠরা খুব বেশি দুষ্টুমি করলে রেগে গিয়ে আমাদের বলতেন, ‘বাপের বিয়ে দেখিয়ে ছেড়ে দেব বেয়াদব…।’
হুট বলতেই বাবার বিয়ে দেখার উপায় সেকালে আমাদের ছিল না। দেখলে কী বা এমন অসুবিধে তাও বুঝতাম না সেই বয়েসে।
এত দিনে বুঝলাম ব্যাপারটা ঠিক কতখানি ভয়ংকর। অন্তত বাবাদের কাছে…।
চিত্রকর: রাজ রায়
জয়দীপ চক্রবর্তীর ‘বারোয়ারি নকশা’র আগের পর্বগুলি…