গৃহবন্দির জবানবন্দি ৭
বাইরে ‘সুখ’। বাইরেই অসুখ। করোনা এফেক্ট। বাধ্যতামূলক ঘরে অন্তরিন। অমান্য মানে বিপদকে নেমন্তন্ন করে আনা। তাই সুখের চেয়ে স্বস্তি ভাল। ঘরে সেই স্বস্তি। ঘরেই অস্বস্তি। তবে উপায়? চিন্তাকে চিন্তামণির ওপর ছেড়ে মন হালকা রাখাই সবচেয়ে ভাল উপায়। এই ‘জরুরি অবস্থা’র দিনে আপনাদের জন্যেই ‘দ্য ওয়াল’ এনেছে একটি বিভাগ ‘হাসো তো দেখি’। সেখানে আছে হাসির ছবি। এবার এল হাসির লেখা ‘বারোয়ারি নকশা’। পড়ুন, মন ভাল রাখুন।
জয়দীপ চক্রবর্তী
বাড়ির বাইরে বেরনোর উপায় নেই। আর সকলের মতোই আমার জগৎ এখন ঘর, বারান্দা, ছাদ আর আর বাড়ির সামনের এক ফালতি ফাঁকা জমি। প্রথম প্রথম অস্থির লাগছিল। এখন ক্রমশ সয়ে আসছে। যেমন প্রতিবছরে সহ্য করে নিই বোশেখ-জষ্ঠির কাঁঠাল পাকানো গরম অথবা পুজোআচ্চার পরে বিসর্জনের শোভাযাত্রায় ম্যাটাডর বোঝাই আকাশচুম্বী ডিজে-র অজানা ভাষায় হৃদপিণ্ড উপড়ে আনা শব্দব্রহ্মের সঙ্গে উদ্দাম নাচনকোঁদন।
আমার তবু নিজস্ব ছাদ আছে। বাড়ির সামনে একচিলতে জমিতে হরজাই ফুলের গাছ আছে, ঘাস আছে, মাটি আছে। সেই গাছে এখন সকাল-দুপুর পাখিরা এসে বসে। হইচই করে গল্প করে নিজেদের মধ্যে। প্রজাপতিরা পতপত করে উড়তে উড়তে এই ফুল ওই ফুলে বসে খবর বিনিময় করে নিজেদের মধ্যে। মাটির ওপরে সার বেঁধে পিঁপড়েরা হাঁটে, স্লো ওয়াকিং রেসে নামে শামুকেরা। কিন্তু যাদের ঘুপচি ফ্ল্যাটের জীবন তাদের ছাদও নেই, বাগানও নেই। তাদের জন্যে দুঃখ হয় এখন। অথচ কিছুদিন আগে পর্যন্ত অমন একটা ফ্ল্যাটেরই স্বপ্ন দেখতাম। নিজেকে দলছুট মনে হত।
এখন ওই পাখিদের বন্ধু মনে হয়। প্রজাপতি, পিঁপড়ে সকলের আসার জন্যেই প্রতীক্ষায় থাকি আমি। মনে হয় আমার বাড়িটা যেন সন্ন্যাসীর তপোবন। আমি ক্ষেত্রসন্ন্যাস নিয়ে এই চৌহদ্দির মধ্যে সাধনায় রয়েছি। ধীরে ধীরে উষ্ণতা বাড়ছে। আমিও সত্যিকারের যোগী হয়ে উঠছি দিন দিন। ঊর্ধ্বাংশের আবরণ ত্যাগ করেছি। নিম্নাঙ্গের আবরণও ক্রমশ ছোট হয়ে আসছে। পাট করে কৌপিনের মতো করে পরা ধুতি ছেড়ে পাজামা, তারপর বারমুডা… জানি না বৈরাগ্য কত দূরে নিয়ে যাবে এরপর।
সেলুন বন্ধ বলে মাথার চুল বেড়েই চলেছে। রুদ্রাক্ষের মালার অভাবে গিন্নির থেকে কাছাকাছি রঙের পুঁথির মালা দিয়েই চুলের গুছি মাথার ওপরে চুড়ো করে বাঁধব ভাবছি। দু’হাতের বাহু এবং কব্জিতেও দু’ছড়া করে মালা বেঁধে নেওয়া যেতে পারে। সব মিলিয়ে দশ ছড়া মালা লাগবে। হাতের মালাগুলো একটা ছিঁড়েও দুটো করে নেওয়াও সম্ভব। তাহলে মালার সংখ্যা অর্ধেক কমে গেল। আশা করছি প্রয়োজনীয় সংখ্যক মালা পেয়ে যেতে অসুবিধা হবে না। গার্হস্থ্যাশ্রমের ঋষিমাত্রেই জানেন, সাধনসঙ্গিনীর হেপাজতে আভরণের অভাব থাকে না। যত রঙের শাড়ি, তত রঙের দুল, টিপ, হার, চুড়ি, মায় ওষ্ঠরঞ্জনী…
নিজেকে ঋষি ভাবতে মন্দ লাগছে না। এক এক করে সত্য স্বয়ং প্রকাশিত হচ্ছে। যে প্রতিবেশীকে সংসারে উদাসীন ভাবতাম, তাঁর গৃহাশ্রমের কর্মতৎপরতা অবাক করছে। যে পরিচিতকে ভাবতাম দয়ালু ও দানশীল, কথায় কথায় আড্ডার তর্কাতর্কিতে যিনি গরিবের জন্যে এক ঘটির কমে কাঁদতেন না, তিনি কারও কথা না ভেবেই বাড়িতে চাল-ডালের আড়ত নির্মাণ করছেন ভবিষ্যৎ দুর্ভিক্ষের আশংকায়। রেশন কার্ড কোথায় থাকে সে খোঁজও যাঁর ছিল না, তিনি কার্ড হাতে রেশন দোকানের দিকে দৌড়চ্ছেন…
আমার ক্ষেত্রসন্ন্যাসের ভাব আর ক্রমবর্ধমান বৈরাগ্য দেখে বাড়ির লোকেও বেশ সম্ভ্রম দেখাচ্ছে ইদানীং। মাছ মাংস ইত্যাকার তামসিক খাবারদাবারের জন্যে বায়না নেই বললেই চলে। বাড়ির দরজায় ফেরি করতে যা নিয়ে আসছে ফেরিওলা তাই দিয়েই দিব্বি ক্ষুন্নিবৃত্তি হয়ে যাচ্ছে বেশ ক’দিন হল। এর ফলে আমার উভয় দিকে সাশ্রয়। শ্রম এবং অর্থ। ব্যাপারটা বুঝেই যতখানি উদাসীন থাকা যায় চেষ্টা করছি। বাড়ির লোকজন এবং প্রতিবেশী সকলকেই বোঝানোর চেষ্টা করছি, অর্থ নয়, পরমার্থই কাম্য হওয়া উচিত আমাদের।
আমাদের ইষ্টদেবী কালী। ঠাকুরঘরে তাঁর বাঁধানো ছবি আছে। নিজহাতে পুজো করছি রোজ। আজ সকালেও পুজোয় বসার জন্যে বাড়ির বাগানে পিতলের সাজি হাতে ফুল তুলছি। পরনে পৈতের সময়কার গেরুয়া কাপড়। প্রায় কাঁধ পর্যন্ত নেমে আসা না কাটা চুল। কপালে রক্তচন্দনের তিলক। খালি গা। গলায় দু’ছড়া রুদ্রাক্ষের মালা। রুদ্রাক্ষ না কুলের বিচি নিজেই অবশ্য জানি না। রুদ্রাক্ষ ভেবে কিনেছিলাম এই পর্যন্ত। মনে ছিল দোকানদারের বলা আপ্তবাক্য, বিশ্বাসে মিলায় বস্তু তর্কে বহুদূর…
সূর্যের তাত যথেষ্ট বেশি। ঘেমে যাচ্ছি। এমন সময় বাড়ির গেটের বাইরে এসে দাঁড়ালেন পাড়ার গুপ্তদা। চোখেমুখে বেশ একটা বিগলিত ভাব। আমি চোখ তুলে তাঁর দিকে চাইতেই মৃদু হেসে বললেন, ‘বাড়ি থেকে বাইরে বেরনোর তো প্রশ্নই আসে না। তবু তোমাকে দেখেই বেরিয়ে এলাম ভায়া…।’
‘কী ব্যাপার বলুন তো?’ আমি একটু ব্যক্তিত্ব আনার চেষ্টা করি চোখেমুখে।
‘না মানে শুনলাম, আজকাল তুমি সাধনাটাধনার মধ্যে আছ। অনেক শক্তি-টক্তিও নাকি গুটিগুটি পায়ে তোমার দিকে আসতে শুরু করেছে…।’
‘না না তেমন কিছু নয়’, বললাম বটে, তবে মনে মনে বেশ খুশিই হলাম গুপ্তদার কথায়। গলা নামিয়ে বললাম, ‘কিন্তু এসব গুহ্য খবর আপনি পেলেন কীভাবে?’
‘তোমার বউদি বলছিল…।’
‘বউদি জানলেন কী করে?’ এবারে সত্যিই অবাক হলাম আমি।
‘সংসারের খবর সত্যিই রাখছ না ইদানীং, বুঝতে পারছি’, মাথা নাড়লেন গুপ্তদা, ‘পাড়ার সমস্ত গিন্নিই হোয়াটসঅ্যাপে জুড়ে আছে হে। প্রতিদিনের ইন্টিমেট ডিটেলস গ্রুপে চালাচালি হচ্ছে প্রতিদিন। সেখানে না আছে লকডাউন, না আছে ডিসট্যান্সিং… সে গ্রুপে সব সংসারের সব কিছুই একেবারে স্ফটিকের মতন স্বচ্ছ…।’
‘বলেন কী?’ আমি হাঁ।
‘তাছাড়া তোমার চেহারাতেও কিন্তু বেশ একটা ইয়ে ইয়ে ভাব এসেছে হে…।’
একথায় স্বতঃস্ফূর্তভাবে হেঁহেঁ করে হাসলাম খানিক।
গুপ্তদা বললেন, ‘একটা আর্জি আছে ভায়া।’
‘কী আর্জি দাদা?’
‘আগে বলো, মায়ের পায়ে আমার হয়ে অ্যাপ্লিকেশনটা ফেলে যেকোনও রকমে পাস করিয়ে আনবে তুমি…।’
‘আমি?’ ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গিয়ে বলি। বুঝতে পারছি গিন্নির সামনে ভেক ধরতে গিয়ে এইবার একটা কিছু কেস খেতে চলেছি।
‘তোমায় ছাড়া কাকেই বা বলি বলো’, গুপ্তদা অসহায় মুখে বললেন, ‘বিপদে আপদে ভবানী মন্দিরে যেতাম ঠাকুরমশাইয়ের কাছ থেকে আশীর্বাদী ফুলমাটি আনতে। তাইতেই অনেক বিপদ আপদ থেকে উদ্ধার পেয়েছি এতদিন। এখন তো সে পথ বন্ধ। কাজেই তোমার বউদি বললেন…।’
‘কী হয়েছে গুপ্তদা?’ আমি ভয়ে ভয়ে বলি।
‘আমার বাবার কথা তো জানোই। বয়েস হয়েছে। দীর্ঘদিন বেড রিডন। ডাক্তার একরকম জবাবই দিয়ে দিয়েছেন। বারকয়েক পরলোক থেকে মিসড কলও এসে গেছে। বলতে গেলে যেকোনও সময়েই…।’
‘কিন্তু আমাকে কী করতে বলছেন গুপ্তদা? আমি তো ডাক্তারবদ্যি নই…’ আতঙ্কিত হয়ে বলি।
‘একটু ধরে রাখো প্লিজ। মানে এই লকডাউনের পিরিয়ডটা যেভাবেই হোক উতরে দাও। বিশ্বাস করো এর মধ্যে ভালমন্দ একটা কিছু হয়ে গেলে… জানোই তো পলিটিক্যাল ক্যাচ আমার তেমন নেই। ডেথ সার্টিফিকেট, স্বর্গরথ, বারনিং ঘাটে যাবার পারমিশন… আমি নিজেই মরে যাব ভাই। ছেলেটা নাবালক। তোমার বউদি হাউজ ওয়াইফ। আমি মরে গেলে…।’ গুপ্তদার গলা বুজে আসে।
‘আহা প্রশাসন তো আছে। ঠিক ব্যবস্থা হয়ে যাবে। পুলিশ যথাসাধ্য চেষ্টা করছে, দেখছেন তো…।’
‘রুলিং পার্টির সঙ্গে দহরম-মহরম না থাকলে সবই ফক্কা ভাই। আর আমার ব্যাপার তো তুমি জানোই…।’
আমি কথা খুঁজে পাচ্ছি না।
গুপ্তদা বললেন, ‘একটু দেখো ভাই। তুমি আমাদের নিজের লোক। আপনজন। তোমার বউদি বার বার তোমার কথাই বলছেন…।’
আমি তবুও চুপ করেই রইলাম।
‘জানি এই ধরনের কাজ করতে গেলে নিজের ওপরেও খানিকটা অর্শায়। নিজেকেও কর্মফল নিয়ে ভুগতে হয় খানিক। তবু দেখো…।’ বলে গুপ্তদা মাথা নেড়ে নিজের বাড়ির দিকে এগিয়ে গেলেন।
আমার মাথা ঘুরতে লাগল। সাধুসন্ত মুনিঋষি হতে গেলে অন্যের কর্মফলও নিয়ে নিতে হয় নিজের শরীরে? ঘাম হচ্ছে, তবু শিরদাঁড়া শিরশির করে উঠল আমার। সর্বনাশ, সারা জীবনে কে কী পাপকাজ করে রেখেছেন তার কতটুকু জানি আমি!
ঘরে ফিরে চললাম। চুলটা কেটেই ফেলতে হবে যেমন করেই হোক। ঋষিভাবটা থেকেও বেরিয়ে আসতে হবে। কাল না হয় সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠে বাজারের দিক থেকে ঘুরেই আসি একবার।
অনেকদিন কষা মাংসের গন্ধ ওড়েনি বাড়িতে।
ভুল কিনা জানি না, মনে হল যেন গিন্নি দু-একবার আড়চোখে আমার দিকে তাকিয়ে ফিকফিক করে হেসে উঠল আপনমনে।
চিত্রকর: রাজ রায়
আরও বারোয়ারি নকশা…