গৃহবন্দির জবানবন্দি ৬
বাইরে ‘সুখ’। বাইরেই অসুখ। করোনা এফেক্ট। বাধ্যতামূলক ঘরে অন্তরিন। অমান্য মানে বিপদকে নেমন্তন্ন করে আনা। তাই সুখের চেয়ে স্বস্তি ভাল। ঘরে সেই স্বস্তি। ঘরেই অস্বস্তি। তবে উপায়? চিন্তাকে চিন্তামণির ওপর ছেড়ে মন হালকা রাখাই সবচেয়ে ভাল উপায়। এই ‘জরুরি অবস্থা’র দিনে আপনাদের জন্যেই ‘দ্য ওয়াল’ এনেছে একটি বিভাগ ‘হাসো তো দেখি’। সেখানে আছে হাসির ছবি। এবার এল হাসির লেখা ‘বারোয়ারি নকশা’। পড়ুন, মন ভাল রাখুন।
জয়দীপ চক্রবর্তী
বড়লোক, মানে বিত্তবান লোক হলেই যে মানুষের মন বড় হবে এমন কোনও কথা নেই। আমাদের ছোটবেলায় গ্রামে থাকতে বোস জেঠিমাকে দেখেছিলাম বাড়িতে পুজোগন্ডা হলেই খরচা হবার ভয়ে কেমন যেন নেতিয়ে পড়তেন। বাজারে গিয়ে পোকা ধরা চাল, চেলি গামছা, কুরুন্ডে শসা আর দানা বোঝাই সবচেয়ে কম দামের কলা কিনে আনতেন ঠাকুরমশাইকে দেবার জন্যে। আর যে পুজোই হোক, বামুনের দক্ষিণা পাঁচ সিকি। আমি যখন ইস্কুলে যাইনি তখনও শুনেছি পাঁচ সিকি, আঠেরো বছর বয়েসে যখন গ্রাম ছেড়ে চলে আসছি তখনও সেই পাঁচ সিকিই। নারকেল নাড়ু বানানোতেও তার অদ্ভুত চমৎকারিত্ব ছিল। অত ছোট নাড়ু আর কেউ কোনওদিন বানিয়েছেন কিনা আমার জানা নেই। নকুলদানাও সে নাড়ুর কাছে নস্যি। জন্মাষ্টমীতে বানানো নাড়ু তিনি বিজয়া দশমীর দিন ঠাকুর জলে পড়ার পরে আমাদের হাতে দিতেন একখানা করে।
ওই বোস জেঠিমার গপ্পো শুনেই আমার ছোটমাসি একটা কুড়ি টাকার প্রাইজ ঘোষণা করেছিল আমাদের জন্যে। যেকোনও বোর্ড এক্সাম পাস করলেই কুড়ি টাকা বরাদ্দ পুরস্কার। মাধ্যমিক পাস করেও আমি মাসির কাছে কুড়ি টাকা পুরস্কার পেয়েছি, এমএ পাস করেও সেই কুড়ি। একেবারে পারফেক্ট সাম্যবাদ যাকে বলে। ততদিনে বাসের ভাড়া তিনগুণ বেড়ে গেছে, অটোর ভাড়া দ্বিগুণ। অন্য সব কিছুর দামই পাল্লা দিয়ে বেড়েছে। বাড়েনি শুধু মানুষের জীবনের দাম আর মাসির এই পুরস্কারের অর্থমূল্য।
বিশু হালদার অবশ্য এই দলে পড়েন না। তিনি দরাজ মনের মানুষ। আমদানি যেমন দু’হাতে, খরচ করতেও তিনি পিছপা নন কোনও কিছুতেই। পাড়ার পুজোপার্বণে, ফাংশন থিয়েটারে যখনই ছেলেছোকরারা তার কাছে হাত পেতেছে, তাদের খুশি করে দিয়েছেন বিশু হালদার। তার দোষের মধ্যে যদি কিছু থাকে তা একটাই। বিশুদার মাত্রাতিরিক্ত পানাসক্তি। সূর্য ডুবলেই তিনিও ধীরে ধীরে ডুবতে থাকেন। জগৎ তখন তার কাছে মায়া বই কিছু নয়। সত্য শুধু ভরা পানের ডিবে আর পূর্ণ পানপাত্র। আমাদের মতো বেরসিককে প্রায়ই দুঃখু করে বলেনও, ‘তোমরা মানুষ হলে না হে। সাবালকত্ব থেকে যোজনখানিক দূরেই থেকে গেলে চিরদিন।’
‘এতে সাবালকত্বের কী আছে?’ আমরা তাকে তাতিয়ে দেবার জন্যে বলি।
‘আগেকার দিনে বড় বড় বাড়িতে আঠেরো বছর পূর্ণ হলেই ছেলেপিলেদের গড়গড়া আর সুরাপাত্র ধরানো হত উৎসব করে’, বিশুদা মাথা নেড়ে বলেন, ‘গুরু ধরে এনে দস্তুরমতো শেখানো হত, কোন সময় কী ব্র্যান্ড কী চাট দিয়ে খেতে হবে। সেসব দিনে বেঁচে থাকাটা একটা উদযাপন ছিল হে। তখন ছিল জীবনের সেলিব্রেশন। এখনকার মতো মেনিমুখো হয়ে প্রতিমুহূর্তে মরতে মরতে ন্যাকা ন্যাকা বেঁচে থাকা দেখলে গা ঘিনঘিন করে মাইরি…।’
এই বিশুদার সঙ্গেই বাজার করতে গিয়ে হঠাৎ দেখা। এই লকডাউনের সময়ে বাজার করায় হেবি হ্যাপা। এক্কেবারে ভোরবেলায় মাত্র ঘণ্টাতিনেকের জন্যে বাজার খোলে। ইদানীং সে বাজার নির্দিষ্ট জায়গা থেকে সরে গিয়ে বসছে একেবারে আদি গঙ্গার ধারে। খোলামেলা জায়গায়। মানুষে মানুষে ডিস্ট্যান্স বাড়িয়ে দেবার প্রয়োজনে। মানুষের সঙ্গে মানুষের মানসিক ব্যবধান কোভিড নাইন্টিন আসার ঢের আগে থেকেই বাড়ছে, এখন শারীরিক ব্যবধানও বেড়ে চলেছে ক্রমাগত।
আমি চিরকালের লেট রাইজার। আমার বীজমন্ত্র, ‘লেট টু বেড অ্যান্ড লেট টু রাইজ’…এখন করোনা আর বউয়ের জোড়া ধাক্কায় সকাল সকাল উঠে মুখে মাস্ক, হাতে গ্লাভস ব্যাগ হাতে বাজারে চলেছি। চোখ জ্বলছে। মনে বিরক্তি। ফাঁকা রাস্তায় অদ্ভুত পোশাকে আমি যেন মধ্যযুগীয় নাইট যুদ্ধে চলেছি একা একা। এদিক-ওদিক তাকাচ্ছি। আজকাল পথের কুকুরগুলো রাস্তায় মানুষ দেখলে বিরক্ত হয়। অনেকদিন পরে তাদের কাছে একটা মওকা এসেছে পৃথিবীতে নিজেদের অধিকার বুঝে নেবার। সে অধিকারে বেয়াড়া মানুষের পুনরায় অনুপ্রবেশ দেখলে হেবি কিচাইন করছে তারা। আজও আমাকে দেখে তাদের দু-চারজন ভুকভুক করে প্রতিবাদ করে উঠল। আমি অপরাধীর মতো মুখ করে তাদের বকুনি মাড়িয়ে এগিয়ে যাচ্ছি, এমন সময় আর একটা মুখোশ ঢাকা মুখ আমাকে ফুট তিনেক দূর থেকে নাম ধরে ডাক দিল। চেয়ে দেখি বিশুদা। হাতে ব্যাগ ঝুলিয়ে ফিরে আসছেন বাজারের দিক থেকে। ব্যাগটা দেখেই বোঝা যাচ্ছে বেশ ভারী।
আমি বললাম, ‘বাজার হয়ে গেল?’
বিশুদা আমার দিকে করুণার দৃষ্টিতে চেয়ে বলল, ‘আমি কি পাতি আনাজ-কোনাজ শাকসবজি কেনার লোক হে?’
‘তাহলে?’
বিশুদা হাসলেন, ‘আরে সে সব তো সাইকেল-ভ্যানে করে পাড়ায় পাড়ায় ফিরি করছে লোকে। তার জন্যে খামোকা বাজারে ভিড় করতে আসব কেন?’
‘তাহলে থলে বোঝাই করে কী কিনলেন এত?’
‘দেখবে?’ বলে আমার সামনে এগিয়ে এসে দু’হাত বাড়িয়ে থলের মুখ ফাঁক করলেন বিশুদা, ‘একসঙ্গে অনেকগুলো বোতল তো, বড় ব্যাগ ছাড়া হত না বুঝলে! একজনকে বলা ছিল। এই সময়ে টুক করে দোকানটা খুলে দিয়ে দিল। সপ্তাখানেকের মতন ব্যবস্থা হয়ে গেল’, বলেই আক্ষেপের সুরে বলেন বিশুদা, ‘কেন যে সরকার এই বস্তুটিকে জরুরি পণ্যের মধ্যে ফেলছেন না… এই তো দেখো, বিড়িখোরদের কী সুন্দর একটা বিলিবন্দোবস্ত হয়ে গেল। এটাকেও যদি একটু ছাড় দেওয়া যেত, নিদেন পাড়ায় পাড়ায় কিয়স্ক করে, অথবা হোম ডেলিভারি… এই তো সেদিন ফেসবুকে দেখছিলাম কোথায় যেন বাড়ির বাইরে রাখা পাত্রে সরকারি লোকেরা মদ ঢেলে দিয়ে যাচ্ছে নির্দিষ্ট সময় অন্তর অন্তর। আহা দেখেও সুখ… সরকার তো এমনই হবে। এমনই দায়িত্বশীল। নাগরিকের জন্যে সহানুভূতিশীল।’
বিশুদাকে তাতিয়ে দিতে আমার দিব্বি লাগে। একটু রেগে যাবার ভান করে বললাম, ‘তাহলে আপনি চাইছেন ঘরে ঘরে মানুষ মদ্যপান করুক?’
‘আলবাত বলছি।’
‘সব্বোনাশ’, আমার মুখ থেকে ছিটকে আসে শব্দটা।
‘সব্বোনাশের কী দেখলে হে?’ বিশুদা চোখ সরু করে জিজ্ঞেস করেন।
‘এমন কথা প্রকাশ্যে বলা যায় নাকি?’ আমি মৃদু প্রতিবাদ করি, ‘আপনি নেশা করেন এটা আপনার ব্যক্তিগত ব্যাপার। তাই বলে যুবসমাজকে ওপেনলি অ্যাডিক্টেড হতে প্রোভোক করছেন, এটা কি ঠিক হচ্ছে দাদা?’
‘প্রোভোক?’ বিশুদা চোখ কপালে তুলে বলেন, ‘আমার প্রোভোকেশনের কি কোনও দরকার আছে? ওপরঅলারাই সার বুঝেছেন। আর যাই হোক, তারা তো আর তোমার মতো গাড়োল নয় হে। মোড়ে মোড়ে ফরেন লিকারের দোকান গজাচ্ছে কি এমনি এমনি? সাধ থেকে শ্রাদ্ধ, সম্পন্ন বাঙালির যেকোনও অনুষ্ঠানে এখন ককটেল পার্টি হয় না?’
‘তা হয়তো হচ্ছে’, আমি আমতা আমতা করে বলি, ‘কিন্তু ব্যাপারটা দোষেরই। আপনাদের মতো কিছু মানুষের জন্যেই…।’
‘আমার দোষটাই দেখছ ভায়া?’ বিশুদা মাঝপথে আমাকে থামিয়ে দিয়ে দু’দিকে মাথা দুলিয়ে হতাশ গলায় বললেন, ‘এই যে চারদিকে রাজনৈতিক দাদাদের এত প্রতাপ, দলে দলে মানুষ দলের ছায়ায় থেকে পাকা চোর, গুন্ডা, লুম্পেন হয়ে উঠছে তার বেলা? আমার প্রোভোকেশন কি এই প্রোভোকেশনের থেকেও খারাপ বলতে চাইছ?’
কথাটা ভাববার। চুপ করে রইলাম। মাস্কের আড়ালে দীর্ঘশ্বাস ছাড়লাম বারকয়েক। আমরা মধ্যবিত্ত চাকুরিজীবী বাঙালি ওই গোপন হাহুতাশটুকুই তো করতে পারি শুধু।
বিশুদা বলে চলেছেন, ‘মজবুত দেশ গড়ার স্বার্থে এ বরং আমাদের বলিদানই বলতে পারো। আমরা এ সব খাই বলেই দেশ রেভিনিউ পায়, সবচেয়ে বেশি রেভিনিউ। আর তা পায় বলেই এই দুর্দিনেও মানুষের পাশে দাঁড়ানোর কথা ভাবতে পারে। প্যাকেজ ঘোষণা করে। আমরাই প্রকৃত দেশপ্রেমী। একসময় মানুষ দেশের জন্যে প্রাণ দিয়েছে। আমরা দিচ্ছি আমাদের লিভার…।’
ফাঁকা রাস্তায় একা এগিয়ে যাচ্ছেন বিশুদা। আমি চোখ ফেরাতে পারছি না।
আজকাল সোশাল মিডিয়া খুললেই দেশপ্রেম আর দেশবিরোধিতার হরেক সংজ্ঞা দেখতে পাই। দেখি আর তালগোল পাকিয়ে যায় নিজস্ব বিচার, বোধ। বিশুদার কথা শুনে সব যেন আরও তালগোল পাকিয়ে গেল।
মনে হল, বিষয়টা ভাববার। সত্যিই ভাববার। ভাবা প্র্যাকটিস করার সময় এসেছে এইবার।
আরও বারোয়ারি নকশা…