Latest News

গৃহবন্দির জবানবন্দি ৫

বাইরে ‘সুখ’। বাইরেই অসুখ। করোনা এফেক্ট। বাধ্যতামূলক ঘরে অন্তরিন। অমান্য মানে বিপদকে নেমন্তন্ন করে আনা। তাই সুখের চেয়ে স্বস্তি ভাল। ঘরে সেই স্বস্তি। ঘরেই অস্বস্তি। তবে উপায়? চিন্তাকে চিন্তামণির ওপর ছেড়ে মন হালকা রাখাই সবচেয়ে ভাল উপায়। এই ‘জরুরি অবস্থা’র দিনে আপনাদের জন্যেই ‘দ্য ওয়াল’ এনেছে একটি বিভাগ ‘হাসো তো দেখি’। সেখানে আছে হাসির ছবি। এবার এল হাসির লেখা ‘বারোয়ারি নকশা’। পড়ুন, মন ভাল রাখুন।

জয়দীপ চক্রবর্তী

অংক যে একটা ভালবাসবার মতো বিষয় হতে পারে কস্মিনকালে মনে হয়নি আমার। বরং ছোটবেলা থেকে মনে হত সাবজেক্টটায় কী জানি একটু গণ্ডগোল আছে। নইলে যে চৌবাচ্চায় ফুটো আছে জানি, তাইতেই জল ঢেলে বেকার সময় এবং জলের অপচয় করতে যাব কেন এই মাগ্গিগন্ডার বাজারে? সচেতন নাগরিক হিসেবে সবাই জানি, আগামী দিনের সবচেয়ে বড় যুদ্ধ পানীয় ও পরিস্রুত জলের চাহিদা মেটানো। আর সেই জল কিনা…

তাছাড়া নিরীহ অবলা প্রাণী বাঁদরের ওপরেও কত অত্যাচার ঠেসে দেওয়া থাকে অংকের ভেতরে। আমি তো কোনও মনুষ্যেতর প্রাণীকে তৈলাক্ত বাঁশে চাপিয়ে দিয়ে ওঠানামার অনুপাত দেখার মতো অমানবিকতার কথা ভাবতেই পারি না। বলতে গেলে একরকম বিদ্রোহ হিসেবেই অংক ছোটবেলা থেকে কোনওদিনই মন দিয়ে করিনি আমি। পাস নম্বর তোলার তাগিদে যেটুকু না কষলে নয়, ব্যাস ওইটুকুই। মাঝে মাঝে মনে হয় সেকালে যদি আজকের মতন রামরাজত্ব থাকত, মানে ফেল করলেও পাস, তাহলে ওটুকু মেহনতও করতে হত না আমাকে।

মুশকিল হল এইসব অত্যন্ত যুক্তিসম্পন্ন অনুভূতির কথা আমার ছেলেকে বলা যায় না। বিশেষ করে স্ত্রীর সামনে তো নয়ই। আজকাল এই বাংলার মধ্যবিত্ত পরিবারের সব মায়েরাই চান তার ছেলেমেয়ে সব কিছুতেই ফার্স্ট হোক। ইস্কুলের পরীক্ষায় ফার্স্ট, আঁকার ক্লাসে ফার্স্ট, সাঁতারের প্রতিযোগিতায় ফার্স্ট। মায়েরা কোনওদিন কোনও কিছুতেই ফার্স্ট না হলে কী হবে, ছেলেমেয়েদের কোনও কিছুতেই সেকেন্ড হবার হক নেই। কিন্তু মুশকিল হল, ফার্স্ট একসঙ্গে সকলের হবার জো নেই। যে হল সে বাঁচল। অন্যদের চরম দুর্গতি।

আমার ছেলে আমারই মতো। ফার্স্ট হয় না কোনওদিন। ফলে যা হবার… মা ছেলেকে পড়াতে বসানো মানেই ঝঞ্ঝা, ভূমিকম্প, বজ্রপাত। বাড়ির আশপাশে কাক, চিল বসার উপায় থাকে না আর। এক্ষেত্রে বাঁচার তাগিদে আমার একটা নিরাপদ পদ্ধতি হল মুখে রা না কেড়ে চুপচাপ বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়া। রমতা সাধুর মতো এক জায়গা থেকে আর এক জায়গায় উদ্দেশ্যহীন ঘুরে বেড়িয়ে, চার-পাঁচ কাপ চা খেয়ে রাত বেশ প্রৌঢ়া হলে গুটি গুটি বাড়ি ফিরে আসা। ততক্ষণে বাড়িতে শান্তিপ্রতিষ্ঠা হয়েছে। দুই রণক্লান্ত সৈনিক পা ছেতরে দু’দিকে বসে আছে। একজন টেলিভিশন আর অন্যজন সেলফোনে মুখ ডুবিয়ে। এই প্রতিদিনের যুদ্ধ লড়াইয়ে আমি পারতপক্ষে ঢুকি না। আমি চালাক-চতুর নই ঠিকই, কিন্তু এত বোকাও নই যে, এ ক্ষেত্রে অহেতুক নাক গলিয়ে নিজের বিপদ ডেকে আনব।

আমার ক্লাস সেভেনে পড়ার সময় সাকুল্যে খান-সাতেক বই ছিল। ছেলের সতেরোটা। ইংলিশ মিডিয়াম। অংক বইই খান-তিনেক। আমি জানি, পড়াতে গিয়ে এই হইহল্লা মারধর নিয়ে কথা বলতে গেলেই দায়িত্বটা আমার ওপরে ট্রান্সফার হয়ে যাবে। বাঙালি মধ্যবিত্ত মাত্রেই জানেন, কোনও কাজের দায়িত্ব নিয়ে আপনি ঈশ্বরকে খুশি করতে পারেন, কিন্তু বউকে নয়। অতএব বোবার শত্রু নেই।

এই স্ট্র্যাটেজিতে দিব্বি চালিয়ে দিচ্ছিলাম এতদিন। কিন্তু বাধ সাধল লকডাউন। ছেলের নতুন ক্লাস অথচ ইস্কুলে যাওয়া হচ্ছে না। ইস্কুলে না যাওয়া মানে ছুটি নয়। ওয়ার্ক ফ্রম হোম। অনলাইনে গাদা গাদা পড়া আর হোমওয়ার্ক আছড়ে পড়ছে ল্যাপটপ আর মোবাইলের স্ক্রিনের ওপরে।

বাড়িতে কাজের লোক ঢোকা বন্ধ। গিন্নির হাতেও অবসর কম। ছেলে সেই সুযোগে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। ছাদে ক্রিকেট খেলতে গিয়ে ফুলের টব ভেঙেছে খান-তিনেক। নিচের ঘরে বল লোফালুফি করতে গিয়ে টিউব খসে পড়েছে দুটো, একটা চিনেমাটির ফুলদানিও দেহরক্ষা করেছে এই অতিমারির দিনে। আমি টিভির পর্দায় চোখ ডুবিয়ে দেখছি সারা দেশে মৃত্যুর সংখ্যা কোথায় গিয়ে দাঁড়াল।

গিন্নির ফর্সা মুখ কাজের চাপে, গরমে আর আমার ওপরে বিরক্তিতে গনগনে হয়ে আছে সারাক্ষণ। সেই আঁচ দিব্বি টের পাচ্ছি এখন। ঘরের বাতাস গরম হয়ে উঠছে ক্রমাগত। যেকোনও সময় এভাপোরেটেড হয়ে জানলার ফাঁক দিয়ে উড়ে বাইরের আকাশে ভেসে যেতে পারি বুঝতে পারছি। অথচ এই কঠিন পরিস্থিতি এড়িয়ে বাইরে বেরিয়ে গিয়ে যে স্বস্তিতে বাঁচব সে অবকাশ নেই। ছেলে গতিক সুবিধের নয় দেখে একটা বই আর একটা খাতা নিয়ে আগডুম বাগডুম হয়ে বিছানার ওপরে বসে পড়ল আমি কিছু না বলতেই। মনে মনে সাবাসি দিলাম ওকে। ছেলেটার বুদ্ধি আছে। আমাকে বাঁচিয়ে দিল এ যাত্রা। কিন্তু বিধিলিপি যাবে কোথায়? হাউজকোটের দু’পাশ থেকে ঝুলে থাকা দুটো ফিতে কোমরে বেঁধে রণমূর্তিতে আমার স্ত্রী সামনে এসে দাঁড়ালেন। আমি প্রমাদ গুনলাম। মিনমিন করে বললাম, ‘বড্ড ঝক্কি যাচ্ছে তোমার ওপর দিয়ে। আমার পাশে বোসো না খানিক। হাওয়া খাও। ঘাম জুড়িয়ে নিয়ে একটু পরে না হয়…।’

আমার কথা শেষ হবার আগেই ঝড়টা আছড়ে পড়ল, ‘আমি বসে থাকলে খ্যাঁটনের যোগাড় কে করবে? ফেসবুকে প্রতিদিন দেখছি স্বামী-স্ত্রী দু’জনে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কেমন সংসার করছে। একসঙ্গে ঝাড়ামোছা, কুটনো বাটনা, রান্নাপাতি… যেন পিকনিক চলছে। আর আমার কপালটা দেখো। খাটতে খাটতে মুখে কালি পড়ে গেল। আজ সাতদিন হল ফেসবুকে একটা সেলফি আপলোড করিনি। দশদিন চলছে সেম ডিপি…।’

‘খুবই অন্যায়’, মাথা নেড়ে বলি।

‘বাজে কথা বন্ধ করো’, সে আবার মুখঝামটা দিয়ে উঠল, ‘আমি না হয় কেউ নয় তোমার। ভাবতে হবে না আমার কথা। কিন্তু ছেলেটা তো তোমার। তাকে তো আসার সময় বাপের বাড়ি থেকে ট্যাঁকে করে সঙ্গে নিয়ে এসে উঠিনি। তা সেও যে ভেসে যাচ্ছে সে খেয়াল আছে তোমার?’

‘ওর আবার কী হল?’ আড়চোখে ছেলের দিকে একবার তাকিয়ে নিয়ে বললাম, ‘ঠিকই তো আছে। খেলছে ধুলছে, নিজে নিজেই পড়তে বসছে…।’

‘হায় আমার কপাল’, বলেই কেঁদে ফেলল আমার স্ত্রী, ‘কার পাল্লায় এসে পড়েছি আমি।’

আমি থতমত খেয়ে উঠে দাঁড়াই, ‘আহা কাঁদছ কেন?’

‘তাহলে কি ধেই ধেই করে নাচব?’ চিৎকার করে উঠল ও, ‘বাবুর ইস্কুল কি অনন্তকালের মতন বন্ধ হয়ে গেছে? আর খুলবে না কোনওদিন? ওর বন্ধুদের সকলের অংকের তিন-চারটে চ্যাপ্টার কমপ্লিট। আর তোমার ছেলে চুপ করে বই মুখে করে বসে আছে। কী করছে না করছে দেখবার পর্যন্ত কেউ নেই। আমি মরলে ওর পড়াশুনো বন্ধ হয়ে যাবে আমি জানি। ছেলেটাকে রাস্তায় বসে ভিক্ষে করতে হবে তখন।’
আশ্বস্ত হলাম ওর সেই জোশ আবার ফিরে এসেছে। আর এও বুঝতে পারলাম ছেলেকে অংক কষানোর মতন ভয়ংকর কাজটা আমাকেই করাতে হবে এখন।

ঈশ্বরের নাম করে বসে পড়লাম অগত্যা। গুরু স্মরণ করলাম আন্তরিকভাবে। মনে মনে বললাম, ‘এই ঘোর বিপদে তুমিই একমাত্র বাঁচাতে পারো নাথ। ইলেভেনে মোটা অংকের বইটা বেচে দিয়ে কৃষ্ণ সিনেমা হলে নুন শো দেখেছিলাম। উচ্চমাধ্যমিকে দুই পেপার মিলিয়ে বাইশ। তেমন পুণ্যও করিনি যে, রিকোয়েস্ট করলেই ধরণী দু’ভাগ হয়ে আমাকে কোলে তুলে নিতে ওপরে উঠে আসবেন…

এই সময়েই হঠাৎ একটা ছোট্ট পোকা ফস করে ঢুকে গেল আমার মুখের মধ্যে। মুখ থেকে গলা… খক, খক, খক, খক কাশতে শুরু করলাম আমি। একটুক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে থেকেই আমার বউ দৌড়ে এল আমার দিকে। ছেলেকে হিড়হিড় করে টেনে নিল আমার কাছ থেকে। আমাকে একা রেখে বাইরে থেকে দরজা টেনে দিয়ে বলল, ‘আমরা পাশের ঘরে রইলাম। এদিকে এসো না। আপাতত চোদ্দো দিন ওই ঘরের মধ্যেই থাকো আর ঘর লাগোয়া টয়লেটটাই ব্যবহার কোরো দয়া করে…।’

মনে মনে হাসলাম। এ জগতের সব কিছুরই ভাল মন্দ দু’দিকই আছে। অংক কষাতে গিয়ে ছেলের কাছে বেইজ্জত হবার চেয়ে চোদ্দো দিনের কোয়ারেন্টাইন ঢের ভাল।

আগের পর্বগুলি…

গৃহবন্দির জবানবন্দি

গৃহবন্দির জবানবন্দি ২

গৃহবন্দির জবানবন্দি ৩

গৃহবন্দির জবানবন্দি ৪

You might also like