Latest News

শিশুদের ভাল রাখার উপায় সম্বন্ধে যে দু-একটি কথা আমি জানি

অংশুমান কর

শিরোনামে লিখলাম বটে যে, দু-একটি কথা আমি জানি। কিন্তু আসলে আমি একটি কথাই জানি। বাকি কথাগুলি শোনা কথা।

এই অন্তরিন অবস্থায় শিশুদের নিয়ে মা-বাবারা পড়েছেন বেশ সমস্যায়। বড়রাই হাঁফিয়ে উঠেছে। মুক্তি চাইছে। তো শিশুদের কীভাবে সামলাবেন তারা? আমার চেনা-পরিচিত অনেকেই ছোটদের সামলাতে হিমশিম খাচ্ছেন। এক্কেবারে ছোট যারা, যারা বিছানাতেই হাতের মুঠোয় পেয়ে যায় ভুবন, সমস্যা তাদের নিয়ে নয়। কিন্তু যারা একটু বড়, যাদের চুলে বাইরের হাওয়া বিলি কেটে দিয়েছে, আলো যারা বাইরে বেরোলেই তুলে নিয়েছে কোলে, তাদের সেই বাইরের আলো-হাওয়ার আদর থেকে ঘরের মধ্যে অন্তরিন করে রাখা কি চাট্টিখানি কথা? খুব খুব দুরূহ কাজ এটা।

আমার চেনা দু-একটি শিশুকে তাদের বাবা-মায়েরা কীভাবে সামলাচ্ছে, একটু জানাই আপনাদের। এদের একজনের নাম তোড়া। মুখে সবসময় কথার খই ফোটে তার। বিদ্যুতের চেয়েও বেগে চলে তার মাথা। তোড়া আমার ছাত্রী (সে অবশ্য এখন ইংরেজি সাহিত্যের ডাকসাইটে অধ্যাপিকা) অন্তরার মেয়ে। উহু। ভুল বললাম। সে আমার ছাত্র (সেও ঘটনাচক্রে ইংরেজি সাহিত্যের নিষ্ঠ অধ্যাপক, ভারী গবেষণার পত্রিকার গুরুগম্ভীর সম্পাদক) রামানুজেরও মেয়ে। তোড়াকে সামলানো কিন্তু চাট্টিখানি কথা নয়। তোড়া যেদিন একটু বড় হয়ে (মানে জ্ঞানট্যান যখন দিব্বি হয়েছে তার, মুখেও ফুটতে শুরু করেছে খই) প্রথম আমাদের বাড়ি আসে, সেদিন ওর মা ওকে বলে নিয়ে এসেছিল যে, আমি মানে ‘একে স্যার’ খুব গুরুগম্ভীর মানুষ। বাড়িতে তোড়া যা যা করে সেসব একেবারেই আমার সামনে করা যাবে না। আমি হলাম গিয়ে ওর বাবা-মায়ের ‘স্যার’। এইসব কথা শুনে তোড়া আমাদের বাড়িতে এসে প্রথমটা বেশ গম্ভীর হয়েই বসেছিল বটে। এদিকে হয়েছে কী, আমাকে যে ওর সামনে গম্ভীর থাকতে হবে এই তথ্যটি অন্তরা আমাকে জানাতে ভুলে গিয়েছে। কথা বলতে বলতে কী একটা কথা শুনে আমি হেসে ফেলেছি। ব্যাস! আর যায় কোথায়! সঙ্গে সঙ্গে তোড়ার ওর মাকে প্রত্যাঘাত: “তুমি যে বলেছিলে একে স্যার গম্ভীর লোক। কিন্তু এ তো দেখছি হাসে!” গেল। মুহূর্তের মধ্যে তোড়াকে শান্ত রাখার সব প্ল্যান গেল ভেস্তে। নাচে-গানে ও ভরিয়ে তুলল সন্ধেটি।

এ হেন তোড়াকে গৃহবন্দি রাখা যে কী কঠিন কাজ সে তো বোঝাই যাচ্ছে। অন্তরা জানাল যে, মাঝে মাঝে সে স্কুলে যাওয়ার বায়না করছে বটে, কিন্তু ঘরে তার দিব্বি সময় কেটে যাচ্ছে। একটি ইংরেজিমাধ্যম স্কুলে সে পড়ে। ক্লাস থ্রিতে। স্কুলের সিস্টার লম্বা লিস্ট পাঠিয়েছেন শিশুদের ভাল রাখার। সেই লিস্ট মোতাবেক নানা কাজ তোড়া করে যাচ্ছে। সিস্টার একটি জরুরি কথা বলেছেন। বাবা-মায়েরা যেন এই সময়ে ছেলেমেয়েরা পড়াশুনো করছে না বলে অযথা আতঙ্কিত হয়ে না পড়েন। এই কথাটি দেখলাম অনেকজন মনোবিদই বলেছেন। এমনকি কলেজপড়ুয়া ছেলেমেয়েদেরও এই সময় “ভোরে ওঠো, তাড়াতাড়ি শোও” বলে চাপ দিতে না করছেন কেউ কেউ। মনোবিদরা তো আমাদের চেয়ে পরিস্থিতির ভাল ব্যাখ্যা করবেনই। তাই ওঁদের উপদেশ অনুসরণ করা যেতেই পারে। অনুসরণ করলে কিন্তু ফল পাওয়া যাবে মনে হয়। যেমন তোড়া। সে নিজেই নিজের ছোট্ট বিছানা তুলছে। ‘ফায়ারলেস কুকিং’ প্র্যাকটিস করতে চাইছে। গান শুনছে। সে গান অবশ্য হার্ড রক। রবীন্দ্রনাথের গান তার কাছে এখন ‘প্রেয়ার সং’। ‘পিস’-এর জন্য গাওয়া যেতে পারে। ছোট ছোট ‘মুড পিস’ লিখছে। আঁকছেও। এঁকেছে ‘ল্যান্ড অব পেঙ্গুইনস’। সেই ছবিতেও অবশ্য সোশ্যাল ডিসট্যান্সিং মেনেই ‘পেঙ্গু’রা সব দাঁড়িয়ে। এইসব কাজ কিন্তু অনেক বাচ্চাই করছে। চমৎকার সব গান গাইছে তারা। নাচছে। আঁকছে। সেইসব গান-নাচ-আঁকা আমাদের মতো বড়দেরও আদর করে দিচ্ছে ক্ষণে ক্ষণে। উসকে দিচ্ছে পুরনো কোনও স্মৃতি। এই যেমন আমার আর এক ছাত্রী স্রোতস্বিনী আর ওর জীবনসঙ্গী ঋত্বিকের পুত্র দেখলাম গিটারে যেমন খুশি আঙুল চালাতে চালাতে গাইছে “আর দেব না আর দেব না রক্তে বোনা ধান মোদের প্রাণ হো”। শুনে কত কিছুই যে মনে পড়ল একঝটকায়!

কিন্তু যারা আরও ছোট? যাদের অক্ষর পরিচয় এখনও হয়নি বা গিটারে যারা যেমন খুশি আঙুল চালাতে পারবে না? তাদের কীভাবে সামলে রাখা যাবে? চমৎকার ভাবে তাদের সামলাচ্ছে আমার সহকর্মী সোমাশ্রী আর তার জীবনসঙ্গী বিশ্বভারতীর অধ্যাপক বুম্বা দাম। সোমাশ্রী আর বুম্বা থাকে আমরা যে বিল্ডিংয়ে থাকি, সেই বিল্ডিংয়ের একতলায়। ওদের শিশুপুত্র আর শিশুকন্যার নাম টিন্টো আর টুঁই। যমজ ওরা। টিন্টো ছটফটে। টুঁই অনেক শান্ত। মনে হয় অনেক বেশি সমঝদারও। ওর ভাইকে বকা যাবে না। এমনকি ভাই যদি ওকে একটু পিট্টিও দেয়, তবুও বকা যাবে না। “মারব তোমার ভাইকে?” -–টিন্টো টুঁইকে পিট্টি দেওয়ার পরে যদি ওকে জিজ্ঞেস করা হ্য়, তাহলে টুঁই বলে, “না না, মেরো না। ওকে তোমরা বুঝিয়ে বোলো”। এই পুতুলের মতো টিন্টো আর টুঁইকে সামলাতে বুম্বা আর সোমাশ্রী অভিনব সব পদ্ধতি আবিষ্কার করেছে। মনে হয় এক্ষেত্রে বুম্বার উদ্যোগ এবং শ্রমই কিঞ্চিৎ বেশি। ফোল্ডিং টেবলকে সোফার সঙ্গে লাগিয়ে দিয়ে ঘরের ভেতরেই বুম্বা বানিয়ে নিয়েছে অস্থায়ী স্লিপ। কুচিনা চিমনির ফেলে দেওয়া অংশুগুলোকে জুড়ে জুড়ে টিন্টো আর টুঁইয়ের জন্য বানিয়ে দিয়েছে এক অদ্ভুত খেলা। অনেকটা যেন নকল ভুলভুলাইয়া। সেই ভুলভুলাইয়ার ভেতর দিয়ে ওরা মেঝেতে বুক ঘষে ঘষে যাচ্ছে আর আসছে। স্লিপ থেকে কতবার যে গড়িয়ে পড়ছে তার তো ইয়ত্তা নেই! ঘরের মধ্যেই ওরা পেয়ে গেছে ছোট্ট একটা পার্ক!

তো এইসব শোনা আর দেখা কথা আপনাদের জানালাম। এইবার আমার নিজের জানা কথাটি বলি। একটু উসকে দিন বাচ্চাদের কল্পনাকে। তাহলেই কেল্লা ফতে। মনে পড়ছে কি সেই কবিতাটার কথা যেটা আমরা অনেকেই নিচু ক্লাসে পড়েছিলাম? অশোকবিজয় রাহার “মায়াতরু”। ভুলে গিয়েছেন? চলুন আর একবার পড়ে নিই কবিতাটা:
‘এক যে ছিল গাছ
সন্ধ্যে হলেই দু’হাত তুলে জুড়ত ভূতের নাচ।
আবার হঠাৎ কখন
বনের মাথায় ঝিলিক মেরে মেঘ উঠত যখন
ভালুক হয়ে ঘাড় ফুলিয়ে করত সে গরগর
বিষ্টি হলেই আসত আবার কম্প দিয়ে জ্বর ।
এক পশলার শেষে
আবার কখন চাঁদ উঠত হেসে
কোথায়-বা সেই ভালুক গেল, কোথায়-বা
সেই গাছ,
মুকুট হয়ে ঝাঁক বেঁধেছে লক্ষ হীরার মাছ।
ভোরবেলাকার আবছায়াতে কাণ্ড হত কী যে
ভেবে পাইনে নিজে,
সকাল হল যেই
একটিও মাছ নেই,
কেবল দেখি পড়ে আছে ঝিকিরমিকির
আলোর
রুপালি এক ঝালর’।

কী মিষ্টি একটা কবিতা। গাছকে অনায়াসে ভালুক, একজন শিশু ভেবে নিতে পারে। সেই আবার চাঁদের আলোয় দেখতে পায় যে সেই গাছের মাথায় হীরের মাছের মুকুট রয়েছে; ভোরের নরম আলোয় সেই আবার দেখতে পায় যে মুকুট উধাও, পড়ে রয়েছে ‘রূপালি এক ঝালর’। কল্পনা। কল্পনা সব পারে।

এই পর্যন্ত পড়ে অনেকেরই মনে হতে পারে যে, যারা দু’বেলা খাবারই যোগাড় করতে পারছেন না, তারা কীভাবে কল্পনাকে অস্ত্র করে সামলাবেন শিশুদের? সে-কাজটি কঠিন, বেশ কঠিন। মানি। তাও বলব, সম্ভব হয়তো বা। সম্ভব কেন না কল্পনার রাজ্যে এক আশ্চর্য সাম্যবাদ আছে। কবি-লেখক-শিল্পীরা বারবার প্রমাণ করেছেন যে, ক্ষুধার রাজ্যে পৃথিবী কেবলই গদ্যময় নয়। আমরা কি “পথের পাঁচালী”র অপুকে ভুলে যাব?

আগের পর্বগুলি…

দূরের পথ দিয়ে ঋতুরা যায়, ডাকলে দরজায় আসে না কেউ

একটা পূর্বদিক বেছে নিতে হবে

খুব সহজেই আসতে পারে কাছে…

আমি কি এ হাতে কোনও পাপ করতে পারি?

খসে যেত মিথ্যা এ পাহারা…

যতবার আলো জ্বালাতে চাই…

দাদাগিরি ‘আনলিমিটেড’

লকডাউন কি বাড়ানো উচিত হবে?

You might also like