
দেখা হোক রাস্তায় আবার
পথেই তো দেখা হয় ‘অপরিচয়ের’ সঙ্গে। পথে নামলেই ‘অপরিচিত’ আর ‘অপরিচিত’ থাকে না। অচেনা পথও সঙ্গী পেলে চেনা হয়ে ওঠে।
অংশুমান কর
লকডাউন ঠিকঠাক মানা হচ্ছে কি না তা সরেজমিনে খতিয়ে দেখতে কেন্দ্রীয় সরকার পর্যবেক্ষকদের পাঠিয়েছে আমাদের রাজ্যে। এ নিয়ে রাজনীতির চাপান-উতোর চলছে। মুখ্যসচিব জানিয়েছেন যে, কেন্দ্রীয় দল আসছে এই খবর তিনি পাওয়ার পনেরো মিনিটের মধ্যেই এই দলের কিছু সদস্য নাকি কলকাতায় পৌঁছে যান। এইসব তরজা এখন চলবে। কিন্তু খালিচোখেই তো দেখা গেছে যে, লকডাউন আমাদের রাজ্যেই শুধুই নয়, ভারতের নানা জায়গায়ও ঠিকঠাক মানা হচ্ছে না। ঠিকঠাক মানা হচ্ছে না বটে, কিন্তু একেবারেই মানা যে হচ্ছে না তাও কিন্তু বলা যাবে না। সারাদেশ জুড়ে যে করোনা পরিস্থিতির ওপরে লকডাউনের প্রভাব পড়েছে, কিছুটা হলেও সুফল মিলেছে তা কেন্দ্র সরকারের স্বাস্থ্যমন্ত্রক জানিয়েছে। লকডাউন না হলে কী হতে পারত পরিস্থিতি সেটারও একটা আভাস দিয়েছেন লভ আগরওয়াল।
লকডাউন যেখানে যেখানে মানা হচ্ছে না, তার পেছনে ঠিক কী কী কারণ আছে, তা নিয়ে ইতিমধ্যেই আলোচনা হয়েছে বিস্তর। আমিও এই ব্লগেই সেইসব কারণের কথা লিখেছি মাঝে মাঝেই। সেইসব কারণের বাইরে গিয়ে আজ একটু অন্যকথা ভাবতে ইচ্ছে করছে। খেয়াল করলে দেখবেন যে, শুধু যে আমাদের দেশেই লকডাউন ভাঙছেন বেশ কিছু মানুষ তা নয়। পৃথিবীর নানা দেশেই কিন্তু লকডাউন ভাঙা হচ্ছে। কোথায় লকডাউন ভাঙলে ঠিক কীরকম শাস্তি জুটছে তা নিয়েও তো আমরা গবেষণা করেছি বিস্তর! নানা দেশের পুলিশের প্রহারের নানা ছবি আর ভিডিও ভাইরালও হয়েছে। কিন্তু, মানুষ এভাবে ঘর ছেড়ে পথে নামতে চাইছে কেন? সামাজিক, মনস্তাত্ত্বিক আর অর্থনৈতিক যেসব বহুবিধ ব্যাখ্যা এ প্রশ্নের ইতিমধ্যেই দেওয়া হয়েছে সেইসব ব্যাখ্যাকে মেনে নিয়েও একটা-দুটো গোড়ার কথা বলতে ইচ্ছে করছে আজ। যেমন এই যে ঘরবন্দি থাকতে মানুষ চাইছে না তার একটা কারণ মনে হয় এই যে, মানুষ সামাজিক জীব। সে একলা থাকতে পারে না। চায়ও না। আর ঘরের উঠোন না ডিঙোলে সে কী করে গড়বে সমাজ? এতকাল তো সে সমাজের মধ্যেই বেঁচেছে। সমাজের সঙ্গে বেঁচেছে। দু-একজন একলষেঁড়ে মানুষ চিরকালই থাকে, তারা ছিল। কিন্তু অধিকাংশ মানুষ সমাজকে মেনে নিয়েই বেঁচে থেকেছে। রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে সে অনেক সময়েই বিদ্রোহ করেছে বটে, কিন্তু সমাজের বিরুদ্ধে তেমনটা করেনি। আজ যদি হঠাৎ সেই মানুষকে বলা হয়, থাকো সমাজ-বিচ্ছিন্ন হয়ে, তবে সে শুনতে চাইবে কেন সে কথা? তার মন তো বিকেলের চায়ের আড্ডার জন্য, হরিবোল তলায় বসে পাশের গ্রামগুলোর ভালমন্দ খবরগুলো নেওয়ার জন্য ছটফট করবেই!
আর খেয়াল করে দেখবেন যে, ‘বাহির’ নিয়েই কিন্তু বেশি গোলমাল পৃথিবীতে। মানে কে দখল নেবে ‘বাহির’-এর তা নিয়ে সেই কোন মহাঅতীত থেকেই চলেছে মারাকাটারি ঝামেলা-ঝঞ্ঝাট! মেয়েদের ওই ক্ষমতার চক্রে অংশ নিতে দেওয়া হবে না বলেই তো তাদের কৌশলে ঘরবন্দি করা হয়েছিল একদিন। অর্থাৎ ‘বাহির’-এ যার আধিপত্য সেই রাজেশ্বর। তো, এই যদি হয় সভ্যতার অভিমুখ, তাহলে হঠাৎ করে সেই অভিমুখকে বদলে দেওয়া যাবে কীভাবে? করোনাও তাই পারছে না। মৃত্যুভয়ও তাই আটকাতে পারছে না মানুষকে। তার ভেতরে কোথাও যেন রয়ে গেছে ওই ‘বাহির’-এর দখল নেওয়ার লোভ।
কিন্তু শুধুই কি তাই? শুধুই কি এক নেতিবাচকতা মানুষকে ঘরের ‘বাহিরে’ টেনে নিয়ে আসে? তাহলে পথ কী করে? আকর্ষণ নেই পথের? টান নেই তার? তবে কেন বিভূতিভূষণ লিখেছিলেন: “পথ আমার চলে গেল সামনে, সামনে, শুধুই সামনে… দেশ ছেড়ে বিদেশের দিকে, সূর্যোদয় ছেড়ে সূর্যাস্তের দিকে, জানার গণ্ডি এড়িয়ে অপরিচয়ের উদ্দেশে… দিন রাত্রি পার হয়ে, জন্ম মরণ পার হয়ে, মাস বর্ষ, মন্বন্তর, মহাযুগ পার হয়ে চলে যায়… তোমাদের মর্মর জীবন-স্বপ্ন শেওলা-ছাতার দলে ভরে আসে, পথ আমার তখনও ফুরোয় না… চলে… চলে… চলে… এগিয়েই চলে… অনিবার্ণ তার বীণা শোনে শুধু অনন্ত কাল আর অনন্ত আকাশ…”? শুনতে হয়তো পায় না। কিন্তু পথের অনির্বাণ বীণা মানুষ শুনতে চায়। সে ইচ্ছেটুকু সম্বল করেই সে ঘরের বাইরে বেরিয়ে আসে। তাকে পথ ডাকে। তাকে রাস্তা হাতছানি দেয়। পথেই তো দেখা হয় ‘অপরিচয়ের’ সঙ্গে। পথে নামলেই ‘অপরিচিত’ আর ‘অপরিচিত’ থাকে না। অচেনা পথও সঙ্গী পেলে চেনা হয়ে ওঠে। জন্ম নেয় গান: “পথেই এবার নামো সাথি পথেই হবে এ পথ চেনা”। শুধু কি তাই? পথেই তো মানুষ দেখা পায় বেড়াফুল আর বুড়ো অশথের। ভাগ্য ভাল থাকলে ব্যাঙ্গমা-ব্যাঙ্গমীরও। তারাই আবার বাতলে দেয় নতুন রাস্তার ঠিকানা। পথের কুহকী মায়া মানুষকে নিশিডাকের মতো হাতছানি দিয়ে গেছে চিরকাল। এই ইশারায় সাড়া না দেওয়া কঠিন। খুব কঠিন।
বিশ্বজুড়েই, তবুও, এই ক্রান্তিকালে মোটের ওপর মানুষ চেষ্টা করেছেন পথে না নামতে। রাস্তা থেকে দূরে থাকতে। কোনও কোনও দেশে অন্তরিন অবস্থার অবসান ঘটেছে ইতিমধ্যেই। সেইসব দেশে মানুষ আবার পথের অনিবার্ণ বীণা শুনবে বলে রাস্তায় নেমেছে। আমাদের অন্তরিন দশা এখনও কাটেনি। যা অবস্থা, তাতে ৩ মে-র পরেও কাটবে কি না স্পষ্ট নয়। যদি এই অন্তরিন অবস্থা দীর্ঘায়িত হয়, কী করবেন আপনারা? একটি কাজ যে করবেনই তা তো আমিই বলে দিতে পারি। এই লেখাগুলি আর পড়বেন না। কেননা এটিই ‘দিন অন্তরিন’-এর শেষ পর্ব।
আর একটি কাজও করতে বলব। বাংলাভাষায় একজন কবি ছিলেন। তিনি যেসব লাইন লিখতেন প্রায়ই সেসব লাইন মধ্যবিত্ত বাঙালি জীবনে হয়ে যেত মন্ত্রের মতো। তাঁর নাম ভাস্কর চক্রবর্তী। অন্তরিন অবস্থার বাকি দিনগুলিতে ভাস্কর চক্রবর্তীর লেখা দু’লাইন মন্ত্রের মতো জপ করতে থাকুন:
‘হেসে বলো–দেখা হবে
রাস্তায় আবার’।
কবিরা সত্যদ্রষ্টা হন। আর তান্ত্রিকের মন্ত্রে জোর থাকে না, কিন্তু কবিদের মন্ত্রের জোর থাকে। অন্তরে বিশ্বাস রেখে এই মন্ত্র জপ করতে থাকুন, নিয়মকানুন মেনে চলুন, দেখবেন, ঠিক আবার রাস্তায় দেখা হবেই আমাদের। ভাল থাকুন, সুস্থ থাকুন সকলে।
পড়ুন, আগের পর্বগুলি…
দূরের পথ দিয়ে ঋতুরা যায়, ডাকলে দরজায় আসে না কেউ
আমি কি এ হাতে কোনও পাপ করতে পারি?
শিশুদের ভাল রাখার উপায় সম্বন্ধে যে দু-একটি কথা আমি জানি
কেরল পারলে, বাকি দেশ পারবে না কেন?
বান্দ্রার পরে আর শুকনো কথায় চিঁড়ে ভিজবে কি?
ঘরের ভিতরে ঠিক কী কী আছে এখনও অজানা
দুনিয়ার পর আরও দুনিয়ায় ভিড়ে গিয়েছে