পাচ্ছে হাসি চাপতে গিয়ে, পাচ্ছে হাসি চোখ বুজে
চিরকালই পৃথিবীর এক চোখে চাঁদের হাসির বাঁধ ভেঙে যায় তো অন্যচোখে অশ্রুনদীর সুদূর পারের ঘাট দেখা যায়। এই তো জীবন!
অংশুমান কর
হাসি মিলিয়ে গেছে এই পৃথিবী থেকে। উৎকণ্ঠার এক অদ্ভুত জগতে আমরা বাস করছি। কবে যে এই উৎকণ্ঠা থেকে পরিত্রাণ পাব আমরা কে জানে! যাঁরা প্রথমদিকে ভেবেছিলেন আমাদের রাজ্য তুলনায় নিরাপদ আছে, তাঁরাও ক্রমশ সেই ভুল ভাবনার থেকে বেরিয়ে আসছেন, কেননা এখনও রোজই নতুন নতুন নাম সংযুক্ত হচ্ছে আক্রান্তের তালিকায়। নতুন এলাকায় পাওয়া যাচ্ছে সংক্রমণ। এই যেমন আমাদের জেলা পূর্ব বর্ধমানে গতকালই পাওয়া গেছে একজন সংক্রমিত ব্যক্তিকে। খবরটি জানার পর থেকেই অনেকেরই মুখের হাসি মিলিয়ে গেছে। কম টেস্ট হওয়া, কিছু মানুষের ক্ষমতার কাছাকাছি থাকার সুবাদে দাদাগিরি (খণ্ডঘোষের এই মানুষটিই যেমন লকডাউনের মধ্যেই কী উপায়ে কে জানে কলকাতা থেকে গ্রাম ফিরে গ্রামবাসীদের অনুরোধ সত্ত্বেও অন্তরিন তো থাকেনইনি, বরং অংশ নিয়েছেন নানা কর্মসূচিতে; খবরে প্রকাশ তাঁর দাদার রাজনৈতিক প্রভাব আছে; এলাকার মানুষেরা বিক্ষোভও দেখিয়েছেন বিষয়টি নিয়ে) করা, আর কয়েকজন মানুষের নির্বুদ্ধিতার কারণে আমাদের রাজ্যের মানুষ প্রথমদিকে যতখানি হাসিখুশি ছিলেন, এখন আর ততখানি হাসিখুশি নেই।
তা বলে কি এই দুঃসময়ে হাসিনি আমরা? হেসেছি তো। মাঝে মাঝে জানতে ইচ্ছে করে যে, মানুষ প্রথম হেসেছিল কবে? কী দেখে প্রথম হেসেছিল মানুষ? নিজের কোনও নির্বুদ্ধিতায়? নাকি প্রকৃতির পরম সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে? নাকি বেদনাকে ভুলে থাকতে গিয়ে ঠোঁটের কোণে চলকে উঠেছিল হাসি? বিজ্ঞানীরা বলতে পারবেন। প্রত্নতাত্ত্বিকেরাও। অনুমানে গিয়ে আমাদের কাজ নেই। কিন্তু আমরা তো দেখেছি কঠিন পরিস্থিতিতেও মানুষ হেসে উঠেছে বারবার। মৃত্যুভয় তুচ্ছ করেও মানুষ হেসে উঠেছে হা হা। আমরা কি ভুলে যাব যে, “কবির মৃত্যু: লোরকা স্মরণে কবিতায়” সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় লিখেছিলেন: ‘দ্বিতীয় গুলিতেই তাঁর বুক ফুটো হয়ে গেল/ কবি তবু অপরাজিতের মতন হাসলেন হা-হা শব্দে’? এই দুঃসময়ে কেউ কেউ একটু হাসাহাসি করেছেন বলে যাঁরা চটে আছেন বিস্তর, আমি তাই তাঁদের দলে নই। মৃত্যুর আগের মুহূর্তেও আমি হুঁকোমুখো হ্যাংলা হয়ে বাংলায় বসে থাকতে রাজি নই।
তবে হ্যাঁ, হাসির অনেক রকমফের আছে। এসব নিয়ে তাত্ত্বিকদের বড় বড় তত্ত্ব আর লক্ষ লক্ষ গবেষণাপত্র ছড়িয়ে আছে বিশ্বজুড়ে। সেসব ভারী ভারী তত্ত্বকথায় ঢুকে কাজ নেই। কিন্তু একটা কথা আমি বিশ্বাস করি, আমার বিদ্রূপে কেউ যদি এমনই আঘাত পান, যে তিনি ভেঙে পড়লেন, তাঁর চোখ ভরে এল আনন্দাশ্রুতে নয়, লবণাক্ত তেতো জলে, তাহলে সে মশকরা না করাই ভাল। হাসতে এবং হাসাতে গিয়ে যখন আমাদের মাত্রাজ্ঞান থাকে না, তখনই হয় বিপদ। আমরা যদি নিজেদের নিয়ে মজা করতে পারি, তাহলে কিন্তু আমাদের মধ্যে এই মাত্রাবোধের জন্ম হয় যে, অন্যেরা তাঁদের নিয়ে করা আমাদের হাসি-মশকরা ঠিক কতখানি গ্রহণ করতে পারবেন। এইরকম ঠাট্টা মশকরা করতে জানতেন শিবরাম চক্রবর্তী। কিন্তু সকলে তো আর শিবরাম নন, তাই মাত্রা-ছাড়া কিছু মশকরাও এই দুঃসময়ে করা হয়েছে বইকী! সেই ঠাট্টাগুলি হয়তো না হলেই ভাল হত।
কিন্তু কিছু কিছু মানুষ এমনই চমৎকার সব ভিডিও আর অডিও ক্লিপিংস বানিয়েছেন যে, দেখে বা শুনে আমি তো অন্তত না হেসে থাকতে পারিনি। যেমন ওই যে, সেই মানসভ্রমণের কথা বলেছিলাম। ওই যে গুগল ম্যাপের কল্যাণেই যিনি ঘুরে আসছিলেন নিউজিল্যান্ড আর আমেরিকা এমন এক নির্লিপ্তি ছিল তাঁর ওই কথাক’টি বলায় যে আমি তো অন্তত হাসি চাপতে পারিনি। বা মনে করুন ওই ভিডিওগুলির কথা যেখানে বিস্কুটের ফুটো গুনছেন একজন। কী গম্ভীর তাঁর মুখ! দেখে মনে হচ্ছে এই তিনি করোনার ভ্যাকসিন আবিষ্কার করলেন বলে! ওই গাম্ভীর্যই তো আমাদের পেটে সুড়সুড়ি দিয়ে হাসিয়ে নিচ্ছে। একটি অডিও মেসেজ শুনলাম। সেটিও শেষমেশ ওই কন্ঠস্বরের গাম্ভীর্যের কারণে হাসিয়েই দিল। একজন মহিলা ঘোষণা করছেন বাড়িতে লকডাউনের নোটিশ। যাতে বলা হচ্ছে যে, বাড়ির সকলকে (টার্গেট, সঠিকভাবেই পুরুষরা) নিজেদের খাবারের থালা নিজেদেরই ধুয়ে নিতে হবে। বারবার চা করে দেওয়ার ফরমান জারি করা যাবে না। অডিও ক্লিপিংটি শেষ হচ্ছে এই বার্তা দিয়ে যে, ‘না হেসে মেসেজটি ফরোয়ার্ড করুন’। এই বাক্যটি শুনে হাসি চেপে রাখতে পারবেন এমন মানুষ কিছুতেই বেশি হতে পারেন না। আর একটি ঠাট্টা ঘুরছে এই বিষয় সংক্রান্তই। সেখানে স্ত্রী স্বামীর ওপরে খাপ্পা কেননা স্বামী খাওয়ার পরে বাসন মেজে দিয়েছেন। স্ত্রী এতে বিষম চটে গিয়ে এক ধমক দিচ্ছেন স্বামীকে। বলছেন যে, স্বামী বাসন ধোওয়ায় তাঁর মানসম্মান আর কিছু রইল না। কেন? কী ব্যাপার? এতে তো স্ত্রীর খুশিই হওয়ার কথা! বোঝা গেল যে, স্ত্রী কুপিত কারণ করোনার কাল অতিক্রান্ত আর মুক্ত পৃথিবীতে তাঁরা ডিনারে এসেছেন এক রেস্তোরাঁয়, কিন্তু করোনার দিনগুলির অভ্যাসবশত রেস্তোরাঁতেও খাওয়ার পরে নিজের প্লেটটি নিজেই ধুয়ে দিয়েছেন স্বামী! কিছু কিছু ঠাট্টায় পুরুষদের নিয়ে একটু বেশিই মজা করেছেন মহিলারা। অনেকেই এতে আবার হাসার বদলে রেগে গিয়েছেন। না, পুরুষরা নন। মহিলারাই। তাঁদের বক্তব্য, এইসব ঠাট্টা আসলে এটাই প্রমাণ করছে যে, ঘরের কাজের দায়িত্ব আসলে মেয়েদেরই। আজ তার অন্যথা হচ্ছে বলেই এত হাসি-ঠাট্টা। কথাটি ভেবে দেখবার মতোই। কিন্তু, এইরকম একটি ঠাট্টার মুখোমুখি হয়ে তাঁরাও না হেসে পারেন না যাঁরা জানেন যে, ঠাট্টার আড়ালে চিরকালই এইভাবে পুরুষতন্ত্র কাজ করে গেছে।
তবে শুধুমাত্র ‘জেন্ডার’-এর ইস্যুটি নিয়ে নয়, যেকোনও রকমের হাসি-ঠাট্টাকেই এই সময়ে বেশ ক্রুদ্ধ, রাগত চোখে দেখছেন অনেকে। তাঁরা মনে করছেন, এই ভয়ংকর সময়ে আবার হাসি-ঠাট্টা কেন? সংবাদমাধ্যমগুলি তো জানিয়েছে যে, ইতিমধ্যেই আমাদের দেশে অনাহারে মারা গেছেন কয়েকজন। প্রতিবন্ধী ছেলে মাস্ক না পরায় সেই ছেলে আর অসুস্থ স্ত্রীর সেবা করতে করতে ক্লান্ত হয়ে পড়া বৃদ্ধ বাবা ছেলেকে খুন করে থানায় গিয়ে আত্মসমর্পণ করেছেন। সেদিক থেকে দেখলে এ তো সত্যিই হাসি-ঠাট্টার সময় নয়। কিন্তু হাসি তাও মানুষের পিছু ছাড়ে না। আসলে চিরকালই পৃথিবীর এক চোখে চাঁদের হাসির বাঁধ ভেঙে যায় তো অন্যচোখে অশ্রুনদীর সুদূর পারের ঘাট দেখা যায়। এই তো জীবন! হাসিকে ক্রান্তিকালেও তাই আটকানো মুশকিল হি নহি নামুমকিন হ্যায়! এমনকি যাঁরা সারাদিন রামগরুড়ের ছানা হয়ে থাকছেন, তাঁরাও কোনও একটা ঠাট্টার মুখোমুখি হয়ে হাসি চাপতে গিয়েই হেসে ফেলছেন। বা ঠাট্টাটি দেখবেন না বলে চোখ বুজে থেকে হেসে ফেলছেন চোখ বুজে রয়েছেন ভেবেই। এইসব ভাবতেই মনে পড়ে গেল সুকুমার রায়ের সেই অমর ছড়াটি। “আহ্লাদী”। সুকুমার লিখেছিলেন:
“ভাবছি মনে, হাসছি কেন? থাকব হাসি ত্যাগ করে।
ভাবতে গিয়ে ফিকফিকিয়ে ফেলছি হেসে ফ্যাক করে।
পাচ্ছে হাসি চাপতে গিয়ে, পাচ্ছে হাসি চোখ বুজে,
পাচ্ছে হাসি চিমটি কেটে নাকের ভিতর নখ গুঁজে।
হাসছি দেখে চাঁদের কলা জোলার মাকু জেলের দাঁড়
নৌকা ফানুস পিঁপড়ে মানুষ রেলের গাড়ি তেলের ভাঁড়।
পড়তে গিয়ে ফেলছি হেসে ‘ক খ গ’ আর শ্লেট দেখে–
উঠছে হাসি ভসভসিয়ে সোডার মতন পেট থেকে”।
একথা ঠিক যে, সোডার মতো ভসভসিয়ে পেট থেকে এখন হাসি উঠে আসছে না। সেই হাসি আমরা হাসব সেইদিন যেদিন লকডাউন উঠবে। পৃথিবী অতিমারী মুক্ত হবে। সেইদিন আর কতদূরে?
পড়ুন, আগের পর্বগুলি…
দূরের পথ দিয়ে ঋতুরা যায়, ডাকলে দরজায় আসে না কেউ
আমি কি এ হাতে কোনও পাপ করতে পারি?
শিশুদের ভাল রাখার উপায় সম্বন্ধে যে দু-একটি কথা আমি জানি
কেরল পারলে, বাকি দেশ পারবে না কেন?
বান্দ্রার পরে আর শুকনো কথায় চিঁড়ে ভিজবে কি?
ঘরের ভিতরে ঠিক কী কী আছে এখনও অজানা